১৫ আগস্ট ২০১৮, বুধবার, ১০:২৮

দুর্ভোগই সঙ্গী!

আসছে ঈদ। বাড়ি ফিরবে কোটি মানুষ। ঈদুল ফিতরে মহাসড়কে আগের তুলনায় দুর্ভোগ কম হলেও শেষ দিনে ছিল দীর্ঘ যানজট। ফিরতি যাত্রায় ছিল পথে পথে দুর্ভোগ। ঈদুল আজহায় মহাসড়কে থাকবে কোরবানির পশুবাহী গাড়ির ঢল। এবার তাই দুর্ভোগের ভয় আরও বেশি। সরকারি হিসাবে, গত ঈদযাত্রায় সড়কে নিহতের সংখ্যা ১৪৯; তবে বেসরকারি হিসাবে সংখ্যাটি ৪০৫। সব মিলিয়ে দুর্ভোগ ও দুর্ঘটনা যেন সঙ্গী হয়ে উঠেছে ঈদযাত্রায়।

তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আশাবাদী, এবারের ঈদযাত্রা হবে স্বস্তিদায়ক। ঢাকা-আরিচা ও নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক পরিদর্শনে গিয়ে তিনি জানান, গত ঈদের মতো এবারও রাস্তা সচল থাকবে। যাত্রীরা স্বস্তিতে যাত্রা করতে পারবেন। ভারি বর্ষণের কারণে পশুবাহী গাড়িগুলোর গতি কিছুটা কম হলেও যান চলাচল অব্যাহত থাকবে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-মাওয়া-খুলনা মহাসড়ক ও ঢাকা-মাওয়া-বরিশাল মহাসড়ক- এই ছয়টি রাস্তা দেশের ৬৩ জেলাকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত করেছে। এগুলোর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হয়েছে। যদিও দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তিনটি সেতু এখনও দুই লেনের। সরু সেতুর কারণে কয়েক বছর ধরেই দীর্ঘ যানজট হচ্ছে। দুর্ভোগ এড়াতে এবারও আগেভাগে বৈঠক করে প্রস্তুতি নিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। যদিও দুর্ভোগ পিছু ছাড়বে- তেমন সম্ভাবনা কম। এ মহাসড়কে দুর্ভোগের আরেক কারণ, নারায়ণগঞ্জের শিল্পঘন এলাকায় রাস্তার পাশে কলকারখানার গাড়ি পার্কিং। একই অবস্থা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা অংশে। দুই মহাসড়কে অবৈধ পার্কিং ঠেকাতে গত মাসে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। সমকাল প্রতিনিধিরা সরেজমিনে ঘুরে জানিয়েছেন, পরিস্থিতি আগের মতোই রয়েছে।

বাকি মহাসড়কগুলো দুই লেনের। সেখানে রয়েছে পুরনো দুর্ভোগ। বিভাজকবিহীন এসব মহাসড়কে গত ঈদে শতাধিক মানুষের প্রাণ গেছে। জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা ও ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। উন্নয়নকাজের কারণে এই পথের যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহাসড়কে গত ঈদে যমুনা নদীর দুই পাড়েই দীর্ঘ যানজট হয়েছে। এবারও একই ভয় রয়েছে।

সড়কের মতো দুর্ভোগের ভয় রয়েছে ঘাটগুলোতেও। আরিচা ঘাটে ফেরি পারাপার এখনও স্বাভাবিক থাকলেও মাওয়া ঘাটে নাব্য সংকটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। চলতি সপ্তাহের শুরু থেকেই এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। গাড়ির দীর্ঘ সারি লেগেই আছে ঘাটে। ঈদে যানবাহনের সংখ্যা বাড়লে দুর্ভোগ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সরকারি হিসাবে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাতটি, ঢাকা-উত্তরবঙ্গ মহাসড়কের চারটি, ঢাকা-ময়মনসিংহের তিনটি স্থান যানজটপ্রবণ। ভাঙাচোরা সড়ক, নির্মাণকাজ ও অব্যবস্থাপনায় এসব স্থানে যানজট হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে গত মে মাসে সড়ক পরিবহন বিভাগ বিস্তারিত পরিকল্পনা করে। ঈদুল ফিতরের আগে এসব কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি এখনও। এবারও তাই দুর্ভোগের শঙ্কা রয়ে গেছে।

দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক সরেজমিনে ঘুরে সমকালের প্রতিনিধিরাও জানিয়েছেন, রাস্তার অনেক জায়গা ভাঙাচোরা। আগের বছরগুলোর মতো এবারও ঈদযাত্রায় দুর্ভোগের কারণ হবে মহাসড়ক। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পর ভাঙাচোরা 'মেরামতে' ইট-বালু ফেলছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। কিন্তু তা ঈদ পর্যন্ত টিকবে কি-না, সংশয় রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক সমকালকে বলেছেন, প্রতিবছরই ঈদের আগে সড়কের ভাঙাচোরা মেরামত করা হয়। দুই মাস আগেও করা হয়েছে। সঠিকভাবে করা হলে আবার মেরামত করার প্রয়োজন পড়ত না। ঈদের আগে মেরামতের পুরো প্রক্রিয়াই ত্রুটিপূর্ণ। ইট-বালু ফেলে খানাখন্দ ভরাট করা হয়। এক বৃষ্টিতেই তা ধুয়ে যায়।

সওজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এইচডিএম) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, সারাদেশের প্রায় পৌনে চার হাজার কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের ৮০০ কিলোমিটার ভাঙাচোরা। ২৩৯ কিলোমিটারের অবস্থা খুবই খারাপ। আঞ্চলিক মহাসড়কের ৯২০ কিলোমিটার কমবেশি ভাঙাচোরা। ২৯৪ কিলোমিটার চলাচলের অযোগ্য। জেলা সড়কের অবস্থা আরও খারাপ। প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার জেলা সড়ক খানাখন্দে ভরা ও ভাঙাচোরা।

তবে সওজ বলছে, জরিপ প্রকাশের পর গত চার মাসে অনেক জায়গায় ভাঙা মেরামত করা হয়েছে। সংস্থাটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) আফতাব হোসাইন খান জানিয়েছেন, মহাসড়কের অবস্থা অতীতের তুলনায় ভালো। সড়কে নিয়ম মেনে চললে যানজটের দুর্ভোগ হবে না।

প্রতি ঈদেই ঘোষণা দেওয়া হয়, ঈদযাত্রায় মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না। ঈদের আগে তিন দিন করে সাত দিন মহাসড়কে পণ্যবাহী যান চলবে না। কিন্তু বাস্তবে সিদ্ধান্তের প্রতিফলন দেখা যায় না। গত ঈদেও ট্রাকের চাপায় গাইবান্ধায় হতাহত হয়েছে মানুষ। সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি বিকল হওয়ায় দীর্ঘ যানজট হয়েছে চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহাসড়কে।

শিক্ষার্থীদের আলোচিত নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরতে আগের চেয়ে কঠোর হয়েছে সরকার। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেছেন, 'এবার কোনো ফিটনেসবিহীন গাড়ি মহাসড়কে চলতে দেওয়া হবে না।'

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যানজট নিরসনে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে মহাসড়কের পাশের খালি জায়গা ভরাট করে বাস বে নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কথা ছিল, ঈদুল ফিতরের আগেই শেষ হবে এর কাজ। সিদ্ধান্ত হয়েছিল শিমরাইলে সার্ভিস লেন ও বাস বে নির্মাণের। যানজটপ্রবণ কাঁচপুরে রাস্তা চওড়া করার কথা ছিল। কিন্তু এখনও এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। বাস্তবায়নের দায়িত্ব সওজের নারায়ণগঞ্জ জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী আলিউল হোসাইনের। তবে এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার সড়ক যোগাযোগের একমাত্র পথ জয়দেবপুর-চন্দ্রা-এলেঙ্গা মহসড়ক। এটিকে চার লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে, যা গত মার্চে শেষ হওয়ার কথা হ্নিছল। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২০ সালের জুনে। পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, এ মহাসড়কের ঢাকা ইপিজেএড, বিকেএসপি, কালিয়াকৈর সেতু ও এলেঙ্গা বাজার যানজটপ্রবণ।

ঢাকা-রংপুর রুটের আগমনী পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা আজাদ চৌধুরী সমকালকে বললেন, চন্দ্র-জয়দেবপুর-এলেঙ্গা মহাসড়কের উন্নয়নকাজের কারণে রাস্তা ভাঙাচোরা, বাস ধীরে চলে। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর সিরাজগঞ্জের রাস্তাও ভাঙাচোরা। ঢাকা থেকে রংপুর ৩৩৫ কিলোমিটার পথ যেতে স্বাভাবিক সময়েই ১০ ঘণ্টা লাগে। ঈদযাত্রায় সড়কে গাড়িসংখ্যা যখন কয়েক গুণ বেড়ে যায়, সময় তখন আরও বেশি লাগে।

সমকাল প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ভোগড়া বাইপাস থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার পথের কিছু কিছু অংশ চার লেনে উন্নীত হয়েছে। বাকিটা ভাঙাচোরা। কোনাবাড়ী এলাকায় ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলছে। নিচের পথ চলাচলের অযোগ্য।

দুর্ভোগের ভয় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও। কারণ, বৃষ্টিতে খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। এ মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় চলছে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ। ভুলতা মোড় পার হতেই লেগে যায় দু-তিন ঘণ্টা।

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা আগে থেকেই বেহাল। এ অংশে বাসের জন্য পৃথক লেন (বিআরটি) নির্মাণকাজ চলছে। দুই পাশে ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। গত ১৮ জুলাই সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এক সভায় এখানে যানজটের জন্য সড়কের দু'পাশের ময়লার স্তূপ ও যত্রতত্র পার্কিংকে দায়ী করা হয়। প্রায় এক মাস পার হতে চললেও ময়লার স্তূপ এবং পার্কিং দূর হয়নি।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেন, ঈদ এলেই ভাঙাচোরা মেরামত করা হয়। বহু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন না থাকায় দুর্ভোগ কমে না।

http://samakal.com/bangladesh/article/1808831