৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৫১

২১ সাংবাদিক খুন মহাজোট সরকারের ৮ বছরে

বর্তমান মহাজোট সরকারের গত ৮ বছরের শাসনামলে দেশে খুন হয়েছেন ২১ জন সাংবাদিক। বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকা-সহ ১৮টি হত্যাকান্ডের কোনো বিচার হয়নি। চাঞ্চল্যকর এ জোড়া খুনের প্রকৃত আসামীরাও গ্রেফতার হয়নি এখনও। এদিকে এ সরকারের দ্বিতীয় দফায় গত তিন বছরে অন্তত ৬শ সাংবাদিক হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। দুই বছরে ৫৫৫টি ঘটনায় ১৮২ সাংবাদিক আহত ও ৩৪ জন লাঞ্ছিত হয়েছেন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অধিকারের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। সর্বশেষ ২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে পৌরসভার মেয়র হালিমুল হক মিরু’র গুলীতে দৈনিক সমকালের সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল মারা যায়।
সংশ্লিষ্ট তথ্যানুযায়ী ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে অন্তত ২০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রাজাবাজারের ভাড়া বাসা থাকে নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাগর বেসরকারি চ্যানেল মাছরাঙা টিভির বার্তা সম্পাদক ও রুনি এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছিলেন। গত চার বছরে এই মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হয়ে র্যাব-এর হাতে পৌঁছেছে। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার কারণে শুরুতেই আদালতের নির্দেশে র্যাব গত চার বছর ধরে এই মামলার তদন্ত করছে। কিন্তু এত দীর্ঘ একটা সময়ে কোনো আসামীকেই চিহ্নিত বা আটক করতে পারেনি র্যাব। সাগর-রুনিকে কেন খুন করা হয়েছিল, মানে তাদের ওপর হামলার ‘মোটিভ'-ও তারা এখনো জানে না। র্যাব-এর তদন্ত, কবর থেকে দু'জনের লাশ তুলে ‘ভিসেরা' (রাসায়নিক) পরীক্ষা এবং ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ‘ফরেনসিক' পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর নিখোঁজের তিনদিন পর মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরের ধলেশ্বরী নদী থেকে গতকাল বুধবার সাংবাদিক আওরঙ্গজেব সজীবের লাশ উদ্ধার করা হয়। সজীব বেসরকারি টেলিভিশন ইন্ডিপেন্ডেন্টে ও বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ বেশ কয়েকটি মিডিয়ার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিএমআরএ) সাবেক সভাপতি। এর আগে তিনি দৈনিক আমার দেশ এর ঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধি ছিলেন।
এরআগে ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি শনিবার টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক মূলস্রোত পত্রিকার সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদকে গুলী করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই হত্যাকা-ের নেপথ্যে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদেরই দায়ী করেছেন নিহতের পরিবারের লোকজন। এর আগে গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে সন্ত্রাসীদের গুলীতে খুন হয়েছেন সাপ্তাহিক অপরাধ দমন পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক দুর্জয় চৌধুরী দীপু। নিজ অফিসে নির্মমভাবে গুলী করে খুন করা হয়েছে তাকে। ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর নরসিংদীতে খুন হন নরসিংদীর বাণী পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার তালহাদ আহমেদ কাবিদ।
এর আগে ১৬ জুন যশোরের শার্শা উপজেলায় দৈনিক গ্রামের কাগজের শার্শা প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন, ১০ জুলাই হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে দৈনিক বিবিয়ানার স্টাফ রিপোর্টার জুনায়েদ আহমদ জুনেদ, গত বছরের ২৮ জানুয়ারি নয়াপল্টনের বাসায় খুন হওয়া প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক জনতার সহসম্পাদক ফরহাদ খাঁ (৬০) ও তার স্ত্রী রহিমা খাঁ (৫৫), ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কুকরাইল এলাকায় গলাকেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের গোবিন্দগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে, একই বছর ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের পোর্ট কলোনি এলাকায় দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুটুল ও একই দিন ঢাকার উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে ২০১০ সালের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার সিনিয়র ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম টুটুল, ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হামলার পর ২৮ এপ্রিল নিহত হন সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ফতেহ ওসমানী, ২০১০ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন বরিশালের মুলাদী প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন রাঢ়ী, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীতে এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, একই বছর জুলাই মাসে ঢাকার পাক্ষিক মুক্ত মনের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম ওরফে রানা, আগস্ট মাসে গাজীপুরে ঢাকার সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময়-এর নির্বাহী সম্পাদক এমএম আহসান হাবিব বারী, ডিসেম্বরে রূপগঞ্জে দৈনিক ইনকিলাব সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন। যদিও পুলিশ দাবি করেছে আবুল হাসান আসিফ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি-বিষয়ক সংস্থা (ইউনেসকো) থেকে প্রকাশিত ‘প্রতিরোধ ও শাস্তি : সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মোকাবিলা ও সমাধানের সন্ধান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সাংবাদিক খুনের সংখ্যা বিবেচনায় বিশ্বের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ১৯৯২ থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি খুন ও মৃত্যুর শিকার হওয়া ২০টি দেশের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা যাওয়া এবং খুন হওয়া উভয় তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ইরাকের নাম। যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের ওই দেশটিতে গত দুই যুগে ১৬৭ জন সাংবাদিক মারা গেছেন। যার মধ্যে খুন হয়েছেন ১০৪ জন। এরপরই পর্যায়ক্রমে রয়েছে সিরিয়া, ফিলিপাইন, আলজেরিয়া, সোমালিয়া, পাকিস্তান, রাশিয়া, কলম্বিয়া ও ভারতের নাম। ভারতে এই সময়ে ৩৫ জন সাংবাদিক মারা গেছেন, খুন হয়েছেন ২২ জন। এর মধ্যে একটি ঘটনারও বিচার শেষ হয়নি। পাকিস্তানে ৫৬ জন সাংবাদিক মারা গেছেন, এদের মধ্যে খুন হয়েছেন ৩২ জন। বিচার হয়েছে দুটি ঘটনার, বাকি ঘটনাগুলোর বিচার চলমান। তবে ওই প্রতিবেদনে গত দুই যুগে বাংলাদেশে ১৮ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছেন উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে খুন হয়েছেন ১৭ জন। আর ১৪টি খুনের ঘটনার এখন পর্যন্ত বিচার শেষ হয়নি।
http://www.dailysangram.com/post/270502-%E0%A7%A8%E0%A7%A7-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%96%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A7%8B%E0%A6%9F-%E0%A6%B8%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A7%AE-%E0%A6%AC%E0%A6%9B%E0%A6%B0%E0%A7%87