৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৪৮

রিজার্ভের অর্থ চুরির এক বছর: কমে আসছে অর্থ ফেরতের আশা

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি করতে ওই দিনের গভীর রাতটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। পরের দুই দিন ছিল ছুটি। এ দিন রিজার্ভের হিসাব থেকে চুরি হয় ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২ কোটি ডলার ফেরত আসে। বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলিপাইনে।
ফিলিপাইন থেকে এখন পর্যন্ত ফেরত এসেছে মাত্র দেড় কোটি ডলার। বাকি রয়েছে আরও সাড়ে ৬ কোটি ডলার (৫১০ কোটি টাকা)। চুরির এক বছর পর বাকি অর্থ দ্রুত ফেরত পাওয়ার আশাও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ঝিমিয়ে পড়েছে অর্থ উদ্ধারের তৎপরতাও। এ ঘটনায় সরকার তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েও তা প্রকাশ করেনি। ফলে বিশ্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সাইবার জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত কারও বিরুদ্ধে এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে চুরির পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে।
৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি হলেও বিষয়টি জানাজানি হয় প্রায় দেড় মাস পর। তথ্য লুকিয়ে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ঘটনায় ১৫ মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান। একই দিন সরিয়ে দেওয়া হয় দুই ডেপুটি গভর্নরকে। তৎকালীন ব্যাংকিং সচিবকেও করা হয় বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এরপর সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবিরকে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান হিসেবে রিজার্ভ চুরির অর্থ আদায়ের বিষয়টি তদারক করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। গতকাল শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাকি অর্থ ফিরে পেতে সময় লাগবে, তবে আমরা আশাবাদী। আমরা ভাগ্যবান। কারণ চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে নগদ কিছু পেয়ে গেছি। কিছু অংশের জন্য মামলা হয়েছে, রায় হলে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, ঘটনার পর শুরুতে ফিলিপাইন সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সহযোগিতার মনোভাব দেখালেও এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিনেট শুনানিও বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যেই আবার বাংলাদেশের করা তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় নতুন করে বিপত্তি দেখা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী প্রতিবেদনটি প্রকাশের জন্য একাধিকবার তারিখ দিয়েও শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গেছেন। বাংলাদেশ মনে করছে, তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে অর্থ ফেরত পাওয়া আরও কঠিন হবে। বাংলাদেশে তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
ফিলিপাইনে অর্থ বের করে নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনকে (আরসিবিসি)। ব্যাংকটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে কোনো অর্থ ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা আরসিবিসির নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের অবহেলা ও অসাবধানতার কারণেই রিজার্ভের ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়েছে। এই ঘটনার দায় আরসিবিসি নেবে না। ফিলিপাইনের পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদনটিও চাওয়া হয়েছে। জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার গাফিলতির কথা বলা হয়েছে। যদিও ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে আরসিবিসি ব্যাংককে ২ কোটি ১০ লাখ ডলার জরিমানা ও তাদের ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানিলন্ডারিং কাউন্সিল মামলা করা হয়েছে।
আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান এ বিষয়ে বলেন, ‘ফিলিপাইনের পক্ষ থেকে আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। তাদের সহায়তা করতে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হবে। আর চুরির সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা দায়িত্বে ছিল, তাদের অন্য বিভাগে বদলি করা হয়েছে।’
এর মধ্যে অবশ্য চুরির অর্থ আদায়ে গত ডিসেম্বরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল ফিলিপাইনে যায়। তবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ফিলিপাইনের প্রেসিেডন্ট রদ্রিগো দুর্তাতের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সভা শেষ পর্যন্ত হয়নি।
সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম থেকেই সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ঘটনা তদারকিতে দ্বিধাবিভক্তি দেখা যাচ্ছিল। নির্দিষ্ট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়নি। এ সুযোগ নিয়েছে ফিলিপাইন। যে তদন্ত প্রতিবেদন করা হলো, তা প্রকাশ না করুক, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা তো নিতে পারত। দেশে কিছু ব্যবস্থা নিলে ফিলিপাইনের ওপর চাপ বাড়ানোর সুযোগ ছিল। এখনই দেশে ব্যবস্থা নিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে না পারলে অর্থ উদ্ধার অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ফিলিপাইনের নতুন প্রেসিডেন্ট সহযোগিতার মনোভাব আর দেখাচ্ছেন না। অর্থমন্ত্রী দুবার সময় দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে আলোচনা করে আর টাকা ফেরত পাওয়া যাবে না। আইনগত পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্থ উদ্ধার করতে হবে, এ জন্য চার-পাঁচ বছর লেগে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে অর্থ আদায়ের আশা ক্ষীণ হয়ে এলেও এ ঘটনার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থার খানিকটা উন্নতি হয়েছে। কিছু প্রক্রিয়ার পরিবর্তন করা হয়েছে। নিরাপত্তাব্যবস্থাও উন্নত করা হচ্ছে। আগামী মার্চের মধ্যে এতে নতুন সফটওয়্যার যুক্ত হবে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তদারকিও বাড়ানো হয়েছে ব্যাংকগুলোর ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কর্মকর্তাকে সাইবার নিরাপত্তা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তা ঘাটতি মোকাবিলায় সুইফটের মাধ্যমে অর্থ প্রেরণের প্রটোকল পরিবর্তন করা হয়েছে। অবকাঠামোতেও পরিবর্তন শুরু হয়েছে। পাশাপাশি পুরো খাতের সাইবার নিরাপত্তা জোরদারেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থ ফেরত আনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অর্থ ফেরত আনাটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, এটা চলছে। অর্থ ফেরত আনতে সুইফট ও ফেডের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1074515/%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A7%87-%E0%A6%86%E0%A6%B8%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%85%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A5-%E0%A6%AB%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%B6%E0%A6%BE