৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ১০:৪৭

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: জমি কেনা নিয়ে নয়ছয়; দলিলে দাম সাড়ে ৩ কোটি টাকা সিন্ডিকেটে অনুমোদন ১১ কোটি

অতিথি নিবাস বানানোর জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাজধানীর হাতিরপুল এলাকায় সাড়ে তিন কাঠা জমি কিনেছে। দলিলে এই জমির দাম দেখানো হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। কিন্তু সিন্ডিকেটে চুক্তিপত্র অনুমোদন করানো হয়েছে ১১ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতি কাঠা ৩ কোটি ১৪ লাখ টাকার কিছু বেশি।
তবে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাতিরপুল পুকুরপাড় এলাকায় ছোট জমির দাম প্রতি কাঠা ৪০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা। বড় আয়তনের ও বাণিজ্যিক জমির দাম অবশ্য এর চেয়ে অনেক বেশি। তাঁরা বলেন, এই জমি যেহেতু বাণিজ্যিক নয়, তাই সাড়ে ৩ কাঠা জমির দাম ১১ কোটি টাকা হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, কর্তৃপক্ষ ঢাকার খালিদ মাহমুদের কাছ থেকে গত বছর অক্টোবরে সাড়ে তিন কাঠা জমি কেনে। কাগজপত্রে দেখা যায়, খালিদ মাহমুদ গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি এই জমি কেনেন ৭৮ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। অর্থাৎ কয়েক মাসের ব্যবধানে শুধু কাগজে-কলমে জমির দাম বেড়েছে চার গুণের বেশি। কাঁঠালবাগান এলাকাটি পড়েছে ধানমন্ডি মৌজায়। সরকারি হিসাবে এখানে প্রতি কাঠার ন্যূনতম দাম সাড়ে ২২ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রয় কমিটির আহ্বায়ক ও সহ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, এখানে অসততা ও অস্বচ্ছতার কোনো কিছু নেই। তবে চুক্তিপত্র আগে-পিছে হওয়ার বিষয়টি তিনি হিসাব শাখায় খোঁজ নিয়ে বলতে পারবেন।
দামের বিষয়ে জমির বিক্রেতা খালিদ মাহমুদ বলেন, যেখানে চাইলেই এক টুকরো জমি কিনতে পাওয়া যায় না, সেখানে এই দাম অস্বাভাবিক নয়।জানা গেছে, ঢাকায় জমি কেনার জন্য নিয়ম অনুযায়ী দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়। দুটি দরপত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে এলডোরাডো ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের দেওয়া মূল্য গ্রহণ করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি।
পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য চৌধুরী সারওয়ার জাহানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের ক্রয় কমিটি এই দরপত্রটিও বাতিল করে। এরপর পুনঃ দরপত্র আহ্বান না করেই খালিদ মাহমুদের কাছ থেকে সরাসরি এই সম্পত্তি কেনা হয়। অথচ এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন উপদেষ্টা রফিকুল হাসানের দেওয়া মতামতের সাধারণ মন্তব্যে বলা হয়েছে যে, কাগজপত্রে দেখা যায়, এলডোরাডোর দেওয়া কোটেশন বা দরপত্র বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহীত হলে সম্পত্তির মূল্য তদানুযায়ী পরিশোধ হওয়া আবশ্যক। এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বা অন্য কোনোভাবে কারও বরাবর মূল্যের টাকা পরিশোধ করা হলে সম্পত্তির কোনো টাকা পরিশোধ হয়নি মর্মে গণ্য হবে। তিনি আরও বলেন, জমির স্বত্বের ধারাবাহিকতা সুষ্ঠু নয়। ফলে স্বত্বের জটিলতার উদ্ভব হতে পারে।
গত বছরের ২০ অক্টোবর এই দলিল নিবন্ধন করা হয়। এতে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। দলিলের হলফনামার শেষে ‘উহা অবমূল্যায়ন করা হয় নাই’ বলে হলফ করা হয়েছে। এ বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষক, উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের দপ্তর তথা বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীরা জানার পরে ক্রয় কমিটি সমালোচনার মুখে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দলিল নিবন্ধনের ৩৬ দিন পর গত ২৬ নভেম্বর জমির মালিকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সায়েন উদ্দীন আহমেদ ও রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ এন্তাজুল হক একটি চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন। এই চুক্তিপত্রে জমির মূল্য দেখানো হয়েছে ১১ কোটি টাকা। আর ভবন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সায়েন উদ্দীন আহমেদ বলেন, প্রতিটি এলাকায় সরকারিভাবে জমির মূল্য নির্ধারণ করা থাকে। এই মূল্যের নিচে কেউ দলিল নিবন্ধন করতে পারে না। সেই আইন মেনেই সাড়ে ৩ কোটি টাকায় জমি নিবন্ধন করা হয়েছে। তার নিচে করা হয়নি। তিনি বলেন, দলিলে প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সাশ্রয় করেছেন। নিয়ম মেনেই সেটা তাঁরা করেছেন। দলিলে জমির প্রকৃত মূল্য প্রদর্শন না করলে ওই অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাতের সুযোগ থাকে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা গোপন না করার জন্যই তাঁরা দাতার সঙ্গে জমির প্রকৃত মূল্য উল্লেখ করে চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করেছেন। সাধারণত এ ধরনের চুক্তি দলিল নিবন্ধনের আগে করা হয়ে থাকে। নিবন্ধনের পরে কেন করা হয়েছে, এ ব্যাপারে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে তিনি বলেন, আগে হোক আর পরে হোক সেটা করা হয়েছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দরপত্র ছাড়াই বিশেষ ‘আইটেম’ কেনা যেতে পারে। পিপিআর-এ ‘ডাইরেক্ট পারসেজ মেথড’ বলে বিধানও রয়েছে।
গতকাল ঢাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ওই জমিতে একটি সাততলা ভবনের কাজ চলছে। চারপাশে টিন দিয়ে ঘেরা। তবে কারা কাজ করছে, কাদের জন্য করছে, তা জানা যায়নি। কারণ, কথা বলার চেষ্টা করেও ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এলাকার লোকজন বলছেন, এখানে জমির সর্বোচ্চ মূল্য ৬০-৭০ লাখ কাঠা হতে পারে। একটি বড় ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সড়কের পাশে বাণিজ্যিক জমির দাম নির্ভর করে অতি প্রয়োজন কি না, তা বুঝে। এই জমি যদি সে রকম হয়, তাহলে দাম বেশি হতেই পারে। তবে আবাসিক জমির ক্ষেত্রে এই দাম বাস্তবসম্মত নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, আপতভাবে এটাকে দেখলে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত। ক্রয় কমিটি অনেক কিছু বিবেচনা করে জমিটি নির্বাচন করেছে। সংক্ষেপে পুরো বিষয়টি বোঝানো সম্ভব নয়। তাই তাঁরা আজ রোববার সাংবাদিকদের ডেকে পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1074465/%E0%A6%9C%E0%A6%AE%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A7%9F%E0%A6%9B%E0%A7%9F