১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৩২

বিমানের ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ: বাছাই পর্যায়েই ‘ঘুষ বাণিজ্য’

 

এবার বাংলাদেশ বিমানে ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ পরীক্ষাকে সামনে রেখে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রার্থী যাচাই-বাছাই পর্যায়েই ‘ঘুষ বাণিজ্য’ হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এক্ষেত্রে চূড়ান্ত তালিকায় নাম উঠাতে অনেক পরীক্ষার্থীকে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ঘুষ না দেয়ায় প্রার্থী তালিকা থেকে ২১ জন বাদ পড়েছে বলেও অভিযোগ তাদের। ২৪ ফেব্রুয়ারি এই লিখিত পরীক্ষা হওয়ার কথা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখা (ডিএফও) থেকে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে ৮৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। পরে এ তালিকায় স্থান পাওয়া ২১ জনের নাম বাদ দেয় বিমানের মানবসম্পদ শাখা। অভিযোগ আছে, বিমানের মানবসম্পদ শাখার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই ২১ জনের কাছ থেকে মোটা অংকের ঘুষ দাবি করেছিল। টাকা না দেয়ায় তাদের পরীক্ষা দেয়ার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এই ২১ জনের এসএসসি সার্টিফিকেটের মান আমেরিকার গভর্মেন্ট অব ডিস্ট্রিক কলম্বিয়ার ‘এ-লেভেলধারী’ জেনারেল এডুকেশন অব ডিপ্লোমা (জিইডি)। এটা বিমানের অপারেশন ম্যানুয়েল কভার করে না।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিইডি পাস করা সবাই ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের এইচএসসি সমমানের (জিইডি) সার্টিফিকেট ধারী কোর্স। এদের সবাই জিইডি পাস করে পরবর্তীকালে নর্থ সাউথসহ দেশের উন্নত মানের বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করেছে। কেউ কেউ এখন মাস্টার্স পড়ছে। আবার কেউ কেউ জিইডি শেষ করে বিভিন্ন ফ্লাইং একাডেমি থেকে ফ্লাইং শেষ করেছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে অনেকে কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স নিয়ে (সিপিএল) দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ও বিদেশী এয়ারলাইন্সে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বিমানের মানবসম্পদ বিভাগের একটি সিন্ডিকেট দ্বিতীয় দফায় যাচাই-বাছাইয়ে ওই ২১ জনের নাম বাতিল করে দিয়েছে।
এ অবস্থায় ২১ জন জিইডি সার্টিফিকেটধারীসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাথমিকভাবে যোগ্য প্রার্থী পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছে না। অভিযোগ আছে, প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত তালিকায় স্থান পাওয়া ৬৫ জনের মধ্যে বিমানের মানবসম্পদ বিভাগের একজন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারসহ একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার ৩৩ জন আত্মীয়-স্বজন রয়েছেন। জিইডি সার্টিফিকেটধারীরা অপেক্ষাকৃত মেধাবী ও বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের অভিজ্ঞ পাইলট হওয়ায় তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এরা টিকতে পারবে না বলে কৌশলে তাদেরকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, আগে জিইডি সার্টিফিকেটধারী একাধিক ব্যক্তি বিমানের পাইলট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ২০১৫ সালে বিমানের অপারেশন ম্যানুয়েলে জিইডিধারীদের বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অপারেশন ম্যানুয়েলে এ ধরনের কোনো শর্ত নেই বলে জানালে তিনি বলেন, তাহলে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। তবে বিমানের এমডি বলেন, যদি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড তাদের এইচএসসি পাস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তাহলে তারা পরীক্ষা দিতে পারবেন।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে বলেন, বিমানের মানবসম্পদ বিভাগের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এর আগেও তিনি এ ধরনের অভিযোগ পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জিইডি’ আমেরিকার এ লেভেলের সার্টিফিকেট- এটা সবাই জানে। এর মান বাংলাদেশের ইন্টারমিডিয়েটের সমান। তাছাড়া বিমান ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ পরীক্ষায় জিইডিধারীরা অংশ নিতে পারবে না বলে কোনো শর্তও দেয়া হয়নি। তাহলে কেন পরীক্ষা দিতে পারবে না এটা রহস্যজনক। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি বিমানের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলবেন। যদি কোনো স্টাফ এ নিয়ে মিথ্যা বাড়াবাড়ি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। জিইডি সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কাছে মতামতও নেয়া যেতে পারে বলে তিনি জানান।
জানা গেছে, গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর বিমান ক্যাডেট পাইলট নিয়োগের জন্য বিভিন্ন মিডিয়ায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এইচএসসি বিজ্ঞান ও সমমানের পাস করা (অংক ও পদার্থ বিজ্ঞান) ছাত্ররা (জিপিএ-৩) আবেদন করতে পারবে। এছাড়া বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সিপিএলধারী আবেদনের যোগ্য।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুুরি কমিশনের পরিচালক মো. সামসুল আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, জিইডি ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে পারবে। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, জিইডি পরীক্ষার প্রতিটি কোর্স অর্থাৎ ৫টি কোর্সের পৃথকভাবে ৮০০ নম্বরের মধ্যে ৪১০ এবং গড়ে ৪৫০ নম্বর প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রী বেসরকারি বিশ্বাবিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির যোগ্য বিবেচিত হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মঞ্জুরি কমিশনের অপর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ইন্টারমিডিয়েট পাস না করে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি হতে পারবে না। কাজেই জিইডি ইন্টারমিডিয়েটের সমমানের কোর্স। এই ক্ষেত্রে বিমান কোনোভাবে জিইডিধারীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বাদ দিতে পারে না। এটা মানবাধিকারের লংঘন।
মানবাধিকার কমিশনের সদস্য এনামুল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এই অভিযোগ যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে ওই ছাত্রের মানবাধিকার লংঘন হবে। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী বৈষম্যমূলক অপারেশন ম্যানুয়েল তৈরি করতে পারে না। এই ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ছাত্র যদি মানবাধিকার কমিশনে লিখিত আবেদন করে তাহলে বিষয়টি তদন্তে করে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশ বিমান পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, জিইডিধারী অনেকে এখন বিমানের পাইলট আছেন। তারা ভালো ফ্লাইং করছেন। জিইডি (আমেরিকান এ লেভেল) হল ইন্টারমিডিয়েটের সমমানের কোর্স। বিমান কোনোভাবেই তাদের বাদ দেয়ার ইখতিয়ার রাখে না। এটা রহস্যজনক। তিনি বলেন, বিমানের ফ্লাইট অপারেশন থেকে তারা যাচাই-বাছাই করে ৮৬ জনের চূড়ান্ত তালিকা জমা দিয়েছিলেন মানবসম্পদ বিভাগকে। কিন্তু ওই বিভাগ থেকে রহস্যজনক কারণে ২১ জনকে বাদ দিয়ে লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাদ পড়া এক প্রার্থী যুগান্তরকে বলেন, তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক পড়ছেন। ইন্টারমিডিয়েট পাস না করলে তিনি কিভাবে স্নাতকে ভর্তি হলেন। ১৫১ ঘণ্টা ফ্লাই করার অভিজ্ঞতা আছে তার। সরকারের সিপিএল লাইসেন্সধারী একজন কমার্শিয়াল পাইলটও। ওই আবেদনকারী আরও বলেন, জিইডিধারীরা আবেদন করতে পারবে না বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়নি। জিইডি সনদপ্রাপ্তদের সিভিল এভিয়েশন লাইসেন্স দিচ্ছে অথচ বিমান সিভিল এভিয়েশনকেও মানছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে বিমানের মানবসম্পদ বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. বারীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কোনো কথা বলবেন না। চূড়ান্ত তালিকায় নাম উঠানোর জন্য জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা মিথ্যা অভিযোগ। এরপর জিএম শাকিল মেরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি টেলিফোনের সংযোগ কেটে দেন। মানবসম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, এর আগেও ২০১৫ সালে বিমানের ক্যাডেট পাইলট নিয়োগের সময় বারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তখন তাকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয়েছিল। তদন্তে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণও হয়েছিল। এরপর ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ঘনিষ্টভাজন হওয়ায় ওই সময় শাস্তি পাওয়া থেকে তিনি রক্ষা পান।
এর আগে বিমানের ৮টি ক্যাটাগরিতে নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তখন বিমান মন্ত্রণালয় ও পরিচালনা পর্যদের নির্দেশে কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার কেন্দ্র পরিবর্তন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ থেকে পরীক্ষা কেন্দ্র সরিয়ে তা মিলেটারি ইন্সটিটিউট অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) বিমানের সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্বে দেয়া হয়। প্রথম দফায় এমআইএসটির অধীনে একটি পরীক্ষা সফলও হয়। জানা গেছে, ওই পরীক্ষায় বিমানের দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট কোনো ধরনের অনিয়ম করতে পারেনি।
http://www.jugantor.com/first-page/2017/02/17/101720/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%9B%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%87-%E2%80%98%E0%A6%98%E0%A7%81%E0%A6%B7-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%A3%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E2%80%99