১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৩২

আমদানি শুল্ক কমাতেই চালের দামে কারসাজি

 

কৃষকদের ন্যায্য মূল্য দিতে চালের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ভারত থেকে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি কমে গেছে। এ শুল্ক প্রত্যাহারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যেই আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট কারসাজির মাধ্যমে মোটা চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য দফায় দফায় বাড়ছে মোটা চালের দাম। এছাড়া চাল পরিবহনে ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজিও চালের দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।


জানা গেছে, চালকল মালিকরা কৃষকদের প্রকৃত মূল্য দিচ্ছেন না। অথচ কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে তা চাল আকারে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছেন খোলাবাজারে চালকল মালিকরা। যা এখন সাধারণ ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অন্যদিকে বড় বড় মিল মালিকরা কৌশল করে ধান থেকে চাল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। তারা কৃত্রিমভাবে বাজারে সরবরাহও কমিয়ে এনেছেন। ফলে চালের চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ কম হওয়ায় বেড়ে যাচ্ছে চালের দাম। এতে করে গুটিকয় ব্যবসায়ীর পকেট ভারি হলেও পকেট কাটা যাচ্ছে সাধারণ ভোক্তার। একইভাবে প্রকৃত দাম না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক।

বৃহস্পতিবার চালের পাইকারি আড়ত ঢাকার বাদামতলী এবং কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরাও স্বীকার করেছেন, দেশে চালের কোনো সংকট না থাকলেও সরবরাহ পরিকল্পিতভাবে কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে মোটা চাল নিয়ে সবচেয়ে বেশি কারসাজি চলছে। এ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারের চাল বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে চালের সিন্ডিকেট হওয়া সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। আগে কোনো কিছুর দাম বাড়লেই সরকারের পক্ষ থেকে তদারকি করা হতো। কিন্তু এখন তা না হওয়ায় মিল মালিকরা তাদের ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এতে ভোক্তাদের পাশাপাশি

সাধারণ ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া দেশের

বিভিন্ন স্থান থেকে চাল নিয়ে ঢাকায় আসতে পথে পথে পুলিশ ও স্থানীয় লাইনম্যানকে একাধিকবার চাঁদা দিতে হয়। জানা গেছে, গত বছর চাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের উদ্দেশ্যই ছিল দেশে কৃষকের উৎপাদিত ধান-চালের ন্যায্য মূল্য দেয়া। যাতে কৃষক মিল মালিকদের কাছে ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করতে পারেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এ উচ্চ হারের শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, সেটি পূরণ হচ্ছে না এক শ্রেণীর চালকল মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে। সাধারণত মোটা চাল গরিবের খাদ্য। তাই আমদানি শুল্ক কমাতে কৌশল হিসেবে খক্ষ বসানো হচ্ছে গরিবের মোটা চালের ওপরই।

সরেজমিন রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাদামতলী পাইকারি চালের বাজার ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে চালের দাম খুব একটা বাড়েনি। পাইকারি বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩৩ থেকে ৩৪ টাকায়। পারিজা মান ভেদে ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা, বি আর-২৮ বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকায়, নাজিরশাইল ৪৩ টাকায়। এই চালই খুচরা বাজারে এসে কেজি প্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বেড়ে যায়। খুচরা বাজারে বৃহস্পতিবার মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৯ থেকে ৪০ টাকায়। এছাড়া পারিজা প্রতিকেজি ৪০ থেকে ৪১ টাকা, বি আর-২৮ ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা এবং নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়।

এদিকে খোদ খাদ্যমন্ত্রীও কারসাজির বিষয়টি স্বীকার করে জানিয়েছেন, অসাধু চাল ব্যবসায়ীদের কারসাজিতেই কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। সচিবালয়ে বুধবার চালকল মালিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এবার মোটা চালের দাম বৃদ্ধির মূল কারণটা হচ্ছে, গত বছর এই সময়ে ভারত থেকে আড়াই থেকে ৩ লাখ টন চাল এসেছে বিনা শুল্কে। এখন সরকার শুল্ক আরোপের পর এ বছর এই সময়ে ভারত থেকে চাল এনেছে ৩৭ হাজার টন।’ মন্ত্রী বলেন, ‘এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী পাইকারি বাজারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যভাবে চালের দাম বৃদ্ধি করেছেন। কোনো রকম একটা অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে শুল্ক প্রত্যাহার করতে পারেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, কোনো অবস্থাতেই চালের ওপর আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হবে না।’

রাজধানীর পাইকারি চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চাপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, শেরপুর, নওগাঁসহ দেশের আরও বিভিন্ন স্থানের মিল মালিকরা দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। উত্তরাঞ্চলের ৮ থেকে ১০টি বড় চালকল মালিক এবং ভারতীয় চাল আমদানিকারকরা মিলে সিন্ডিকেট করে চালের বাজার দর বাড়িয়ে দিয়েছেন। এছাড়া অধিকাংশ কৃষক এসব মিল মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে জমিতে ধান উৎপাদন করেন। ফলে আগে থেকেই তারা কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে বাফার মজুদ গড়ে তোলেন। যখন কৃষকের কাছে ধান শেষ হয়ে যায় তখন মিল মালিকরা ধীরে ধীরে ওই চাল বাজারে ছাড়তে শুরু করেন। কিন্তু তাদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ সত্ত্বেও বাজারে চাহিদার তুলনায় চাল কম ছাড়ায় দাম বেশি পড়ছে।

কারওয়ান বাজার শপিং কমেপ্লেক্সের আল্লার দান রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বাজারে পর্যাপ্ত চাল রয়েছে। কিন্তু মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে রেখেছেন। যার কারণে বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। তিনি বলেন, ঢাকায় যে ক’টি চালের আড়তে চাল মজুদ আছে তার থেকে অনেক বেশি চাল মজুদ হয়ে আছে মিল মালিকদের কারখানায়। তারা কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে চাল বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। যার প্রভাব পড়ছে ভোক্তা পর্যায়ে। জানতে চাইলে দেশের চালের বৃহৎ পাইকারি বাজার বাদামতলী ও বাবুবাজার আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমরা চালকল মালিকদের দিকেই তাকিয়ে থাকি। তারা চালের যে দাম ঠিক করেন আমরা সে দামেই কিনে বিক্রি করি। যদি দাম বাড়ে বা কমে মিল মালিকরাও বাড়ান বা কমান। তিনি দাবি করেন, চালের দাম বাড়া বা কমার ক্ষেত্রে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দায়ী নন।
http://www.jugantor.com/last-page/2017/02/17/101911/%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%B6%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%95-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BF