১ জানুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ৩:৩২

দশ টাকার চাল নিয়ে তেলেসমাতি কারবার

বিদায়ী বছরে যে সংবাদটি একাধারে দীর্ঘ দিন গণমাধ্যমে গুরুত্ব নিয়ে গেড়ে বসেছিল সেটি হলো ১০ টাকা কেজি দরের চাল। দেশের হতদরিদ্র মানুষগুলোর জন্য দুই বেলা দুই মুঠো ভাত নিশ্চিত করতে নেয়া হয় এ উদ্যোগ। ঘোষণা দেয়া হয়, ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে ১০ টাকা দরে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল বিতরণের। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কর্মসূচি চলমান থাকার কথা থাকলেও সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায় ক্ষমতাসীনদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে। অসহায় মানুষকে ১০ টাকার চাল নিয়ে চলে তেলেসমাতি কারবার।
খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চালের মূল্য যখন ৩৮ থেকে ৫২ টাকা, তখন ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির ঘোষণায় উন্মাতাল হয়ে ওঠে দুর্নীতি-অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক প্রশাসন। গরিব মানুষকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীনদের নামযুক্ত তালিকা তৈরি, তালিকার বাইরের লোকদের চাল দেয়া, ওজনে কম দেয়া, ৩০ কেজির টিপসই নিয়ে ১০-১৫ কেজি দেয়া, তালিকা অনুমোদনের আগেই চাল বিতরণ শুরু করা, অনভিজ্ঞ দলীয় নেতাকর্মীদের ডিলার হিসেবে নিয়োগ দেয়া, ১০ টাকার চাল খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে দেয়াসহ এমন কোনো অনিয়ম নেই যা এ ক্ষেত্রে হয়নি।
প্রতি মাসে দেড় লাখ টন হারে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে সাড়ে চার লাখ টন চাল বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অনিয়মের কারণে অপূর্ণ থেকে যায় লক্ষ্যমাত্রার বেশির ভাগই। অনিয়মের অভিযোগে চাল বিক্রি বন্ধ হয়ে যায় অন্তত ২৫ জেলায়। কোনো কোনো জেলায় চাল বিতরণ শুরুই হয়নি। আর যেগুলোয় হয়েছে সেখানেও গরিবের চাল গেছে বড়লোকদের পেটে বা পকেটে। এর ফলে ঘন ঘন বিক্ষোভ হয়েছে, ডিলারশিপ বাতিল হয়েছে কোথাও কোথাও; আর চেয়ারম্যান-মেম্বারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে নড়েচড়ে বসে খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতরও।
১০ টাকার চাল বিতরণে অনিয়মের বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। চাল বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। অনিয়মের লাগাম টানতে কেবল খাদ্য অধিদফতর নয়, তদারকিতে যুক্ত হতে হয়েছে মন্ত্রণালয়কেও। অনিয়ম চিহ্নিত করে প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে আট সদস্যের তদারকি কমিটি করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে প্রত্যেক জেলা প্রশাসককে। অনিয়মের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে মাঠে নামানো হয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে।
১০ টাকার চাল বিক্রিতে অনিয়ম প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদফতরের পরিচালক সুকুমার চন্দ্র রায় নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রামে ‘খাদ্যবান্ধব’ কর্মসূচির আওতায় দেশের ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজিদরে চাল বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। কর্মসূচি বাস্তবায়নে নারী, বিধবা ও প্রতিবন্ধী নারীপ্রধান পরিবারকেই প্রাধান্য দেয়ার কথা থাকলেও প্রথমবারের মতো নেয়া এ উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনিয়মের অসংখ্য অভিযোগ আসে আমাদের কাছে। তার ভিত্তিতে আট বিভাগের জন্য আটটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কর্মমূচি বাস্তবায়নে ভবিষ্যতে যাতে অনিয়ম কমিয়ে আনা যায় সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
১০ টাকার চাল বছরের আলোচিত সংবাদের তালিকায় স্থান পাওয়ায় কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, ১০ বিঘা জমির মালিককেও চাল দেয়ার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। তবে গরিবের চাল আত্মসাতের অভিযোগ আসার সাথে সাথেই আমরা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। অনিয়মের অভিযোগে ৪৪ জনের ডিলারশিপ বাতিল করা হয়েছে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে দলমত নির্বিশেষে সব অপরাধীর বিরুদ্ধে। আগামী মার্চ ও এপ্রিল মাসে আবার ১০ টাকা কেজিদরে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারে চাল বিতরণ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, সামনের দিনগুলোতে অভিযোগের ব্যাপকতা ও অপরাধের মাত্রা কমে আসবে বলে আমরা আশা করছি।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/183548