১৪ জুন ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:৩১

শুল্ক ফ্রির চাল বর্ধিত মূল্যে বিক্রিতে বাজার অস্থির

প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি শুল্ক পুনর্বহালের অজুহাতে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে বাজারে। কিছু চালের দাম এক কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা করে বেড়ে গেছে। এসব চাল আনা হয়েছে শুল্ক ফ্রি। গত আট মাসে এই শুল্ক ফ্রি চাল আমদানি হয়েছে ৬৭ লাখ টন। দেশে আসার পথে আছে আরও ২২ লাখ ৭১ হাজার ৫৪ মেট্রিক টন। শীঘ্রই এ চালও দেশে এসে পৌঁছবে। এলসি খোলা হয়েছে আরও প্রায় ২০ লাখ টনের। গত বছর আগাম বন্যার কারণে চালের উৎপাদন কম হয় ১০ লাখ টন। বিপরীতে আমদানি করা হয়েছে ১ কোটি মেট্রিক টন চাল। তাহলে এত চাল গেলো কোথায়? খাদ্য আমদানি ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোন একক বছর হিসাবে এত বেশি খাদ্য কখনো আমদানি হয়নি। বিপুল পরিমাণ এই খাদ্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি হয়েছে। এত কিছুর পরেও চালের দাম কমেনি। তাহলে এত চাল গেলো কোথায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত জুলাই থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত আট মাস ১০দিনে খাদ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টনের। জুলাই-ফেব্রুয়ারি আট মাসে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৮৯ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টনের। এর মধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে ৬৭ লাখ ৩৯৪ মেট্রিক টন। বাকী খাদ্য দেশে আসার পথে রয়েছে।
জুলাই-ফেব্রুয়ারি মোট ৮৯ লাখ ৭১ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন খাদ্যের মধ্যে চালের এলসি ৪১ লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৭ মেট্রিক টনের। বাকী ৪৮ লাখ ১৫ হাজার ৯০০ দশমিক ৭০ মেট্রিক গম। দেশে চাল এসে পৌঁছেছে ৩২ লাখ ৫৪ হাজার ৬০৯ মেট্রিক টন। আর গম পৌঁছেছে ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭৮৯ মেট্রিক টন।
গত বছরে আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ ধান ডুবে যায়। অব্যবহতি পরে বন্যায় উত্তরাঞ্চলেও ডুবে যায় ধান। সরকারি হিসাবে উভয় বন্যায় দেশের প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় চালের দাম বৃদ্ধি পেয়ে সর্বোচ্চ উঠে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগে দেশের খাদ্য উদ্বৃত্ত ছিল। সে কারণে চাল আমদানি নিরুৎসায়িত করতে শুল্ক নির্ধারণ করে চালের ধরন ভেদে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এ সময় চাল আমদানি নেমে আসে ৫/৬ লাখ মেট্রিক টনে। তাও ছিল চিকন চাল। বন্যার কারণে চালের ঘাটতি দেখা দিলে সরকার শুল্ক কমিয়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনে। এরপর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি শুরু হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সর্বোচ্চ চাল আমদানির পরিমাণ ছিল ৭/৮ লাখ মেট্রিক টন। পরের বছরগুলোতে শুল্ক কমিয়ে নিলে চাল আমদানি কমতে শুরু করে। ২০১৬-১৭ বছরে আমদানি কমে আসে সর্বনিম্নে।
এদিকে প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে ‘উপেক্ষা’ করে মোট বাজেটের মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করায় তাকে ‘অপ্রতুল’ বলছে কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগ্রাম পরিষদ। তারা বলছে, এই অপ্রতুল বরাদ্দ দিয়ে কৃষি খাতের বিদ্যমান সঙ্কট নিরসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
এবার বাজেটে কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে ৫৮ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বরাদ্দের মধ্যে রয়েছে কৃষি ভর্তুকি, সার, বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ প্রণোদনা ও সহায়তা কার্ড, সেচ সুবিধা ও খামার যান্ত্রিকীকরণ, শষ্য বহুমুখীকরণ ও বিপণন, কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা প্রদান। এর মধ্যে ভর্তুকি রয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা।

কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার বলেন, সরকার নিজেদের কৃষিবান্ধব বলে দাবি করলেও বাজেটে বরাদ্দে তার প্রতিফলন ঘটেনি। দেশের প্রধান উৎপাদনশীল খাত কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি এবারও উপেক্ষিত হয়েছে। এই বরাদ্দ খুব অপ্রতুল, যা দিয়ে কোনোভাবেই কৃষির বিদ্যমান সঙ্কট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
কৃষিতে অর্থায়নের সুবিধা সিন্ডিকেট ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ভোগ করছে এমন অভিযোগ এনে আব্দুস সাত্তার বলেন, বরাদ্দের অধিকাংশ খোদ উৎপাদক চাষি পায় না। কৃষি খাতের যে ভর্তুকি খোদ চাষি তার মুখ দেখে না। ভর্তুকির টাকায় প্রকৃত কৃষি পণ্যে তেমন কোনো মূল্য সহায়তা পায় না। এই ভর্তুকির অধিকাংশ টাকা চলে যায় ফড়িয়া, মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও সরকারি দলের প্রভাবশালীদের হাতে।
সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল না কেনায় এবং কৃষি বরাদ্দের দ্বারা হাওর অঞ্চলের কৃষক, পাট ও আখ চাষিসহ গ্রামীণ উৎপাদকেরা কিভাবে নিজেদের জন্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিৎ করবে, তারও কোনো প্রস্তাব বাজেট বক্তৃতায় আসেনি বলে হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
বাজারে যে চাল রয়েছে তা শুল্ক ফ্রি সুবিধায় আনা হয়েছে। অথচ এখনও শুল্ক বহালের অজুহারে তারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার এমন অন্যায়ের কোন প্রতিবাদও করতে পারছে না। সরকার গঠিত বাজার কমিটি নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আর চাল ব্যবসায়ীরা নিজেদের মত করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

দেশে যে পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে তাতে চলতি বছরে চালের কোন সংকট হবে না। বাজেটে যে শুল্ক পুনর্বহাল করা হয়েছে তা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। নতুন করে চাল আমদানি করতে চাইলে এলসি খুললে তা আসতে আরও সময় লাগবে কম পক্ষে এক মাস। সরকারের বর্তমান হিসাব মতে চাল আমদানির কোন দরকার নেই। আর এ কারণেই আমদানি ঠেকাতে শুল্ক বহাল করা হয়েছে। তাহলে কেন শুল্ক বহালের দাবিতে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, যে বাজার ব্যবস্থায় কৃষির উদ্বৃত্ত মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা আত্মসাৎ করে এবং যে উদ্বৃত্ত কৃষি খাতে পুনর্বিনিয়োগ না হয়ে অকৃষিখাতে চলে যায়, তা সংস্কারেরও কোনো পদক্ষেপ এবারের বাজেটে দেখা যায়নি।

ইতোমধ্যে চাল আমদানি সম্পন্ন হওয়া এবং এলসি খোলার পর আমদানির ওপর শুল্ক আারোপ করার সিদ্ধান্তে কৃষকরা বাস্তবে কতটা লাভবান হবে, তা নিশ্চিৎ নয় বলেও মন্তব্য করেন ক্ষেতমজুর সমিতির এই নেতা।
দেশে চালের পরিস্থিতি অত্যন্ত ভালো। কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার জন্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা দরকার। তাই আবার শুল্ক আরোপ করা হয়েছ, বলে জানিয়েছেন এক খাদ্য কর্মকর্তা।
কিন্তু মিল মালিকরা চালের দাম কেন বাড়াচ্ছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশে মিল মালিকদের সমিতির সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলি বলেন, শুল্ক পুনর্বহাল করার ফলে ভারত থেকে আর নতুন চাল আসছে না। না আসার কারণে বাঙালীরা আমরা যখনই একটু হাওয়া পাই, যেমন খুচরা বলেন বা পাইকারি, কৃষক বলেন বা মিলার সর্বত্রই একটা ভাব থাকে যে এটা বেড়ে যাবে এবং সেই বেড়ে যাওয়াটা শুরু হয়েছে।

কিন্তু যে চাল শুল্ক মুক্ত সুবিধার সময় আনা হয়েছে সেই চালের দাম কেন বাড়বে? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, আগের আর পরের বিষয়টি কিন্তু ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে কখনো থাকে না। দামটা যখন কমে যায় তখন কিন্তু সবাইকে আগের জিনিস কম দামেই বিক্রি করতে হয়।
তিনি আরো বলেন, ধান কাটা পুরো শেষ হয়েছে। কিন্তু সরকার বাজার থেকে ধান চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। যতটুকু উঠেছে তাতে মণ প্রতি সরকার নির্ধারিত এক হাজার ৬০ টাকায় ধান বিক্রি সম্পন্ন হলে সামনে চালের দাম আরো বাড়তে পারে।
তার মতে আমদানি শুল্ক কমিয়ে ভারত থেকে চাল আনলেই খুচরা বাজারে দামের সামঞ্জস্য হবে।কিন্তু ধানের দাম কমানো অথবা আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিলে শেষ পর্যন্ত তার ফল কৃষকের উপরে কতটা পড়বে সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/334272