১৭ জুন ২০১৮, রবিবার, ৮:২৪

বৈচিত্র্যের ঐক্য চেতনা কি বিলুপ্তির পথে?

কিছুটা ভ্রমণ, কিছুটা বিনোদন মানুষের প্রিয় বিষয়। বিষয়টি সামনে রেখে বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প, পর্যটন নগরী। তবে পর্যটন নগরী গড়ে তোলার ব্যাপারেও চলে আসে জীবনদর্শনের ব্যাপার। বেপরোয়া ভোগবাদকে প্রাধান্য দিলে পর্যটন নগরী নির্মিত হবে একভাবে। আবার নৈতিক মূল্যবোধকে গ্রাহ্য করলে পর্যটন নগরী গড়ে উঠবে অন্যভাবে। এমন ভাবনা লক্ষ্য করা গেছে তুরস্কে। ফলে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে, ‘মুসলমানদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে তুরস্কের হালাল হলিডে।’
গত ৭ জুন ডয়েচে ভেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে ‘হালাল হলিডে’ ব্যবস্থা। একটু ছুটি পেলেই বেশির ভাগ মানুষ ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিদিন ভিড় জমান কোটি কোটি মানুষ। তবে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য সব পর্যটন নগরী উপযুক্ত নয়। আবার অনেক জায়গায় পর্দা করে পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে পারেন না ধর্মপ্রাণ মুসলিম নারীরা। এমন প্রেক্ষাপটে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মালয়েশিয়ার পর ইউরেশিয়ার দেশ তুরস্কে চালু হয়েছে ‘হালাল হলিডে’ ব্যবস্থা। হালাল-হলিডের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দেশটি। বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

হালাল হলিডে উদ্যোগের ফল মিলছে হাতে নাতে। গত বছর তুরস্কে সাধারণ পর্যটকদের সংখ্যা কমলেও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে হালাল হলিডে পর্যটকদের সংখ্যা। তুরস্কে ৬০টির বেশি হোটেল ও রিসোর্টে মুসলিম পর্যটকদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা আছে। এর মধ্যে রয়েছে নারী ও পুরুষদের জন্য আলাদা সুইমিংপুল ও সৈকতের ব্যবস্থা। প্রতিটি হোটেলে আছে জায়নামাজ ও কুরআন শরীফ। আর আছে হালাল খাবার। এসব হোটেলে কোনো অ্যালকোহল পাওয়া যাবে না। নারীদের সুইমিংপুলে আছে নারী নিরাপত্তা কর্মীরা। ফোন আর ক্যামেরা জমা দেয়ার পরই অতিথিরা সেখানে প্রবেশ করতে পারেন। এই ব্যবস্থাগুলো পছন্দ করছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। হালাল হলিডে চালুর পর তুরস্কে বিদেশী পর্যটকের সংখ্যাও বাড়ছে। বাংলাদেশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দেশ। হালাল হলিডে ব্যবস্থা এখানেও চালু করা যায়।
স্বকীয়তা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন চিন্তাচেতনার স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের তেমন নিশ্চয়তা নেই।

বিশিষ্ট লেখিকা অরুন্ধতী রায় বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদি সরকারের শাসনামলে সংখ্যালঘুদের বিপণœতা বেড়েছে। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গড়তে মুসলমানদের সমাজবিচ্ছিন্ন ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানাতে চাইছেন মোদি। বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় আরো বলেন, গোটা বিশ্বেই একটি একমুখী বাজার ব্যবস্থার অধীনে মানুষকে বৈচিত্র্যহীন একমুখী করে তোলা হচ্ছে।
‘বিবিসি নাইট’ নামের অনুষ্ঠানে অরুন্ধতী রায়কে প্রশ্ন করা হয়, ‘মোদিকে আপনি খুব একটা ভালো চোখে দেখেন না। আপনার বইয়ের প্রশ্নেও তিনি খুব একটা খুশি নন। তিনি কি ততটা খারাপ, আপনি তাকে যতটা ভয় পান’? উত্তরে অরুন্ধতী বলেন, ‘হ্যাঁ তাই। কারণ আজকে ভারতে এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়কে সমাজের মূল স্রোত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। রাস্তাঘাটে নির্বিচারে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। তাদের পূর্বতন পেশা আর অর্থনৈতিক কর্মকা- থেকে বিমুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। গোশতের দোকান কিংবা চামড়াজাত পণ্য কিংবা হস্তশিল্পের মত অর্থনৈতিক কর্মকা-গুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।’ অরুন্ধতী আরো বলেন, ভারতজুড়ে সহিংসতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

বিজেপি ও এর ভাবাদর্শিক সহযোগীদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, একটি সম্প্রদায় সেখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় মত্ত। সেখানে হিন্দুরা ছাড়া সবাই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হবে। বিবিসির পক্ষে জানতে চাওয়া হয়, এটি ভারতের নাকি গোটা বিশ্বের অবস্থা? উত্তরে অরুন্ধতী বলেন, ‘আমি মনে করি আপনি যা দেখছেন, এক কথায় বললে বিশ্বজুড়ে সমগ্র মানবসমাজকে একমুখী সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির অধীনে নিয়ে আসা হচ্ছে। একটা বাজারতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সবাই একই রকম পণ্য কিনতে প্ররোচিত হবে, একই রকম জিনিস চাইবে। আর এভাবেই তৈরি হয় বিকৃত মনোগত অপরায়ণ। যারা ওই সমন্বিতকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেদের ‘অপর’ বিবেচনা করবে, সেখান থেকে বিচ্ছিন্নবোধ করবে এবং সমন্বয় প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চাইবে।’

অরুন্ধতী রায়ের বিশ্লেষণে উপলব্ধি করা যায়, ভারতসহ বর্তমান সভ্যতার বড় বড় দেশগুলোতে মানুষের স্বকীয় জীবনযাপন ও চিন্তাচেতনার স্বাধীনতা সংকীর্ণ হয়ে আসছে। অর্থাৎ বলবান তথা ক্ষমতাসীনদের উগ্র ও সংকীর্ণ মানসিকতা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করছে। এমন আগ্রাসন এখন মানব জাতির জন্য বড় সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই প্রশ্ন জাগে, ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ চেতনা কি ভারতসহ বড় বড় দেশগুলো থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছে?

http://www.dailysangram.com/post/334310