১৩ জুন ২০১৮, বুধবার, ২:৩১

ঈদে ঘরমুখো মানুষের পদে পদে ভোগান্তি

রাজধানী ঢাকার টেকনিক্যাল মোড় থেকেই যানজট। কখন এই জট খুলবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মানুষের আর তর সইছে না। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটেই রওনা হন অনেকে। গন্তব্য গাবতলী বাস টার্মিনাল। একই চিত্র দেখা যায় মহাখালী, সদরঘাট ও সায়েদাবাদেও। ইংলিশ রোডের মোড় থেকেই দেখা যায় মানুষ আর মানুষ। এ যেন মানুষের মিছিল। মিছিল ছুটছেন নাড়ির টানে। এরা সবাই ফিরছেন স্বজনের কাছে। আজ পবিত্র লাইলাতুল কদর হওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার ঘরমুখো মানুষের ভিড় ছিল খুব বেশি। এই প্রতিবেদক নিজে কমলাপুর রেল স্টেশনে গিয়ে আগামী শুক্রবারের জন্য কোনো টিকিট পাননি। ঘরমুখো মানুষের প্রতি মুহূর্তে চরম দুর্ভোগও তাদের গতিকে রোধ করতে পারছে না। ঘর থেকে বের হয়ে সেই ভোগান্তির শুরু। ভোরে লঞ্চে গিয়ে একটু বসার জায়গার জন্য হুড়োহুড়ি, গাড়িতে অগ্রিম টিকিট কেটেও ঠিকমতো সিটে বসতে না পারা, ট্রেনের টিকিট থাকতেও অতিরিক্ত যাত্রী হওয়া, বাসে সিট না পেয়ে ছাদে ওঠা, পদে পদে অতিরিক্ত টাকা গোনা- আরো কত যন্ত্রণা। তারপরেও মানুষ ছুটছে।

বাসা থেকে বের হতেই ভোগান্তি: গাবতলী বাস টার্মিনালে একাধিক যাত্রী গতকাল সকালে জানালেন, ঘর থেকে বের হয়েই পড়তে হয় নানা ভোগান্তিতে। সুমন নামে এক যাত্রী জানালেন, সকালে গাড়ি ধরার জন্য সেহরি খেয়ে আর ঘুমাননি। মুগদাপাড়ার বাসা থেকে বের হয়ে দেখেন কোনো রিকশা নেই। পরে প্রায় হেঁটেই সায়েদাবাদ পৌঁছে সেখান থেকে বাসে গাবতলী যান। গাবতলী গিয়ে দেখেন গাড়ি নেই। ৮টায় ছাড়ার কথা থাকলেও প্রায় একঘণ্টা পরেও গাড়ি ছাড়েনি। সায়েদাবাদ টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। গাড়ি আছে। যাত্রীরাও গাড়িতে উঠে বসে আছেন। কিন্তু যানজটের কারণে গাড়ি টার্মিনাল ছাড়তে পারছে না। এভাবেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা টার্মিনালেই বসে থাকতে হচ্ছে গাড়িগুলোকে।

ছাদেও মানুষ: কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো, গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে মানুষ ছাদেও চড়েছেন। কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় ট্রেনে যে যাত্রী আছেন তার চেয়ে বেশি যাত্রী আছেন দাঁড়িয়ে ও ছাদে।
অনেকে ছুটছেন বিকল্প পথে: যারা বাস বা ট্রেনে সিট পাননি তারা প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মিনিবাস, আবার কেউ কেউ খোলা ট্রাকে করেই ছুটছেন গন্তব্যে। রাজধানীতে চলাচলকারী অনেক বাস এখন দূরপাল্লার যাত্রী বহন করছে। এই গাড়িগুলোতেও ঝুঁকি নিয়ে ছুটছেন মানুষ।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায়: ঈদে ঘরমুখো মানুষ পদে পদে অতিরিক্ত ভাড়া গুণছেন। গুলিস্তান থেকে মাওয়ার ভাড়া ৬০ থেকে ৮০ টাকা। কিন্তু ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ১২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হলেও দেখার কেউ নেই। এভাবে ঢাকা থেকে আরিচা ও পাটুরিয়ার ভাড়া ১০০ টাকার কম হলেও ঈদ উপলক্ষে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকার ওপরে। তাও আবার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে না দিয়ে কয়েক কিলোমিটার আগে থেকেই যাত্রীদের নামিয়ে দেয়া হচ্ছে গাড়ি থেকে। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি আরো বাড়ছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটের লঞ্চেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় চলছে।
লঞ্চে উপচে পড়া ভিড়: গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে দেখা গেছে লঞ্চগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। কোনো নিয়মনীতি না মেনে লঞ্চগুলোতে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। এ দিকে লঞ্চগুলোতে বাড়তি ভাড়া আদায়ের পর অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিট বাণিজ্য করে লঞ্চের শ্রমিকেরা বাড়তি অর্থ আদায় করে নিচ্ছে। সূত্র জানায়, ঈদ মওসুম এলেই অসাধু শ্রমিকেরা এই কাজ করে থাকে। লঞ্চ মালিক ও প্রশাসনের লোকজন এসব জেনেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
লঞ্চ ছেড়ে গেছে সকালেই: সাগর নামে এক যাত্রী জানিয়েছেন, গতকাল দ্বীপরাজ লঞ্চে তার কেবিন নেয়া ছিল। তিন হাজার টাকায় তিনি এই অগ্রিম টিকিট সংগ্রহ করেন। লঞ্চ সাধারণত রাত ৮টায় ছাড়ার কথা। ওই যাত্রী বেলা ১১টায় টার্মিনালে যান। বিকেল সাড়ে ৬টায় তিনি জানতে পারেন ওই লঞ্চ সকালেই ছেড়ে গেছে বরিশালের উদ্দেশে। দিনভর ওই যাত্রী পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন। এ ব্যাপারে ওই লঞ্চ কর্তৃপক্ষের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত তিন গুণ ভাড়া দিয়ে ওই যাত্রী অপর এক লঞ্চে চড়েছেন। এভাবে অসংখ্য লঞ্চযাত্রী ভোগান্তির শিকার হয়েছেন গতকাল।

ফেরিঘাটে তীব্র জট: গতকাল সকাল থেকেই মাওয়া ফেরিঘাটে তীব্র জট লক্ষ করা যায়। প্রতিটি ফেরিঘাটেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিবহন আটকে থাকছে। আর এই সুযোগে ফেরিঘাটের কিছু অসাধু কর্মচারী ও পুলিশ সদস্য সিরিয়াল ভেঙে বাড়তি উপার্জনে নেমেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
চলছে লক্কড়ঝক্কর যানবাহন: ঈদ মওসুমে বাড়তি উপার্জনের জন্য এক শ্রেণীর অসাধু পরিবহন মালিক লক্কড়ঝক্কর যানবাহন রাস্তায় নামিয়েছে। এমনকি, নামীদামি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঈদ মওসুম এলেই অসাধু মালিকেরা এই সুযোগটি নিয়ে থাকেন। সূত্র জানায়, মালিকদের এই অতি মুনাফার লোভে সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে পারেন। ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুধু বাসই নয়, নৌযানের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটছে। ফিটনেসবিহীন বেশ কিছু নৌযান এই ঈদ মওসুমে যাত্রী পরিবহনে নেমেছে বলে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, যাদের বিষয়টি তদারকির কথা তাদের ম্যানেজ করেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।

নিরাপত্তাব্যবস্থা বিঘিœত: এ দিকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় যাত্রীদের ঘরে ফিরতে হচ্ছে। রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এবং কমলাপুর রেলস্টেশন ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে যতটা নিরাপত্তা প্রদানের কথা ছিল তার সিকিভাগও নেই। আর এই সুযোগে দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন হলেও মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে অনেকেই জানিয়েছেন। একাধিক যাত্রী বলেছেন, তারা টিকিট কেটেও লঞ্চে ও গাড়িতে চড়তে পারেননি। কিন্তু এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করে কোনোই প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

http://www.dailysangram.com/post/334146