১৩ জুন ২০১৮, বুধবার, ২:২৯

স্বদেশ ভাবনা

শুল্ক পুনরারোপে চালের দাম আরও বাড়বে

গত ৮ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চাল আমদানিতে প্রত্যাহারকৃত ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনরারোপের প্রস্তাব করেছেন। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কৃষি খাতের প্রধান উপকরণগুলো, বিশেষ করে সার, বীজ, কীটনাশক আমদানিতে শূন্য শুল্কহার অব্যাহত রাখা হয়েছে। চলতি মৌসুমে বোরোর ভালো ফলন হয়েছে।
কৃষকের উৎপাদিত ধান-চালের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে চাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করে সর্বোচ্চ আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ পুনরারোপ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে বোরোর ভালো ফলন হওয়ায় এবং চাল আমদানিতে শূন্য শুল্কহারের সুবিধা নিয়ে আমদানিকারকরা ঘাটতির চেয়ে বেশি পরিমাণে চাল আমদানি করায় কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় চালের আমদানি শুল্ক পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা বোরো ধান কাটা মৌসুমের শুরুতেই অনুভূত হয়েছিল।
তবে চাল আমদানিতে এত উচ্চহারে শুল্ক আরোপে দেশে চালের দাম আরও বাড়বে বলে মনে করেন অভিজ্ঞজনরা। তারা মনে করেন, চাল আমদানিতে শুল্কহার ১০ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত ছিল। বস্তুত তাদের এ ধারণা এরই মধ্যে বাস্তবরূপ নিতে শুরু করেছে। পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়, অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের বাজেটে চাল আমদানিতে প্রত্যাহারকৃত ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনরারোপের প্রস্তাব করার দু’দিনের মধ্যেই বাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
আমদানিকৃত চালে কেজিপ্রতি ৫ টাকা এবং দেশীয় চালে ২ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে এক কেজি মোটা চাল ৪০-৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর শ্রেণীভেদে সরু চালের দাম ৫৬-৬৫ টাকা। মৌসুম শেষে দাম আরও বাড়বে। চাল আমদানিতে আরোপিত উচ্চ শুল্কহার (২৮ শতাংশ) কেন চালের দাম আরও বাড়াবে এবং তা জনজীবনে, বিশেষ করে হতদরিদ্র, দরিদ্র ও নিুবিত্তের জীবনে আরও দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে, এ বিষয়ে আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) অকাল বন্যায় সিলেটের হাওর অঞ্চলে বোরোর উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সরকারি হিসাবে বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার (১ কোটি ৯১ আখ ৫৩ হাজার টন) চেয়ে ১০ লাখ টন কম হয়, যদিও বেসরকারি হিসাবে উৎপাদন হ্রাসের পরিমাণ ছিল কমপক্ষে ১৫ লাখ টন।
বোরো উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যাওয়ায় এবং চাল আমদানিতে শুল্কহার ২৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে চাল আমদানির পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় সর্বনিু পর্যায়ে নেমে আসে। ওই অর্থবছরে শুধু বেসরকারি খাতে ১ লাখ ৩৩ হাজার টন চাল আমদানি করা হয়। ফলে চলতি অর্থবছরের শুরুতে দেশের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৫০-৫২ টাকায় পৌঁছায়।
চালের ঘাটতি মেটাতে এবং দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকার বেসরকারি খাতে চাল আমদানিকে উৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। চাল আমদানির ওপর পুরো শুল্ক (২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি) রহিত করা হয়। চাল আমদানিতে ২৮ শতাংশ শুল্কহার পুনরারোপ কেন চালের দাম আরও বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বাড়াবে, তার কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হল।

এক. সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির হার নিুমুখী। সরকারি তথ্য মোতাবেক ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে সার্বিক কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপর প্রবৃদ্ধির হার কমে ২০০৩-০৪ অর্থবছরে তা ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশে দাঁড়ায় (সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৫)। এরপর প্রবৃদ্ধির হার একটু একটু করে বেড়ে ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা ৬ দশমিক ১৫ শতাংশে দাঁড়ায়। পরবর্তী বছরগুলোয় কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির এ হার ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৪ দশমিক ৪৬, ৩ দশমিক ০১, ২ দশমিক ৪৬, ৪ দশমিক ৩৭ ও ৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কৃষিতে প্রকৃত উৎপাদন বাড়ে ২ দশমিক ৬ শতাংশ (সূত্র : অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ২০১৬-১৭)। কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার নিুমুখী হওয়ার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শস্য উপখাত। এ উপখাতে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ব্যাপকভাবে কমে যায়।
২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬ সময়কালে দেশে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক শূন্য ৩ থেকে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশের মধ্যে থাকে, যা আমাদের বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের (১ দশমিক ৩৭ শতাংশ) চেয়ে কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক। চলতি অর্থবছরে চাল উৎপাদনে প্রথম অবস্থানে থাকা বোরোর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হলেও তা দেশকে চালে স্বনির্ভর করার জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। তাছাড়া দেশে চাল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আমনের উৎপাদন অনেকটা প্রকৃতি ওপর নির্ভরশীল। প্রলয়ংকরী বন্যা বা প্রচণ্ড খরা আমনের উৎপাদনকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

২০০৭-০৮ অর্থবছরে আমরা দেখেছি একাধিক প্রলয়ংকরী বন্যা ও সাইক্লোন সিডর কীভাবে আমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করেছিল। আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৩০ লাখ ৪৫ হাজার টনের বিপরীতে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল কমবেশি ৯৬ লাখ টনে। চলতি অর্থবছরে উপর্যুপরি বন্যার কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের আমন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
সিপিডির গবেষণায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বোরো এবং চলতি অর্থবছরে আমনের ক্ষতির আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৫ হাজার ৩০০ কোটি এবং ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা (সূত্র : যুগান্তর, ২৭ জানুয়ারি)। আগামী অর্থবছরে প্রলয়ংকরী বন্যা বা প্রচণ্ড খরায় যে আমনের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? এ অবস্থায় বিদেশ থেকে চাল আমদানি অব্যাহত থাকার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই চাল আমদানিতে ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনরারোপ করায় আমদানিকৃত চালের দাম আরও বেড়ে যাবে, যা দেশীয় চালের দামও বাড়াতে ভূমিকা রাখবে। এতে সাধারণ মানুষের জীবন আরও কষ্টকর হয়ে উঠবে।

দুই. একটি পরিবারে মাসিক যে ব্যয় হয়, তার প্রায় অর্ধেক চলে যায় খাদ্য সংগ্রহে। বিবিএসের হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০১৬ মোতাবেক জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৪৭ দশমিক ৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। গ্রামাঞ্চলে খাদ্যে ব্যয় হয় ৫০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে খাদ্যে ব্যয়ের পরিমাণ ৪২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, গ্রামে বসবাসকারীরা কমবেশি ৭০ ভাগ মানুষ খাদ্যে বেশি ব্যয় করেন। আর সাধারণ মানুষ খাদ্যে যে ব্যয় করেন, তার কমবেশি ৮০ শতাংশ চালে।

বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য-মূল্যস্ফীতি বাড়লে ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ হতদরিদ্র পরিবারই চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। দরিদ্র পরিবারের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। তাই মোটা চালের দাম উচ্চহারে বৃদ্ধি পেলে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে।
ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থার হিসাব মতে, শুধু চালের মূল্য উচ্চহারে বৃদ্ধির কারণে রিপোর্ট প্রকাশের পূর্ববর্তী কয়েক মাসে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ গরিব হয়। তারা আগে দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল, এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। শুধু দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা নন, চালের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হন মধ্যবিত্ত ও নিু-মধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিু-মধ্যবিত্তদের মাছ, মাংস, ডিম, দুধ অর্থাৎ আমিষজাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের পুষ্টির অভাব ঘটে। এতে অবনতি হয় তাদের স্বাস্থ্যের। তাছাড়া এসব পরিবারকে কমিয়ে দিতে হয় শিক্ষা খাতে ব্যয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা। সংকুচিত করতে হয় তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

তিন. উচ্চহারের আমদানি শুল্ক পুনরারোপে আমদানিকৃত চালের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে দেশে উৎপাদিত চালের দাম। এতে ধানচাষীরা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ধানচাষীরা উপকৃত হবেন না। কারণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা চাল বিক্রি করেন না, তারা বিক্রি করেন ধান। আমাদের দেশে ধানচাষীদের বেশিরভাগই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক। তারা ধারদেনা করে ফসল ফলান। তাদের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। ফলে ধান কাটার মৌসুমের শুরুতেই তারা ধান বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যান।
চলতি বোরো ধান কাটার মৌসুম শুরুর দিকে অর্থাৎ মে’র প্রথমদিকে তারা ধান বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে গেলে সরকারি ধান-চাল কেনা কর্মসূচি তখন পর্যন্ত শুরু না হওয়ায় তাদের ৪০০-৫০০ টাকায় এক মণ ধান বিক্রি করতে হয়, যা গত মৌসুমের ধানের দামের তুলনায় অনেক কম। এতে লাভবান হয় চালকল মালিক ও মজুদদাররা। তারা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে কম দামে ধান কেনে। তারা এ ধান চালে রূপান্তর করে মৌসুম শেষে বেশি দামে বিক্রি করবেন।

বোরো ধান কাটার মৌসুমের শুরুতে উচ্চহারের চাল আমদানি শুল্ক পুনরারোপ করা হলে এসব ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী উপকৃত হতেন। উল্লেখ্য, এসব ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীর অধিকাংশই মৌসুম শেষে চালের ক্রেতায় পরিণত হবেন এবং অন্য ক্রেতাদের মতো চালের উচ্চমূল্যের কারণে হবেন ক্ষতিগ্রস্ত।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য মোতাবেক চলতি অর্থবছরের ৫ জুন পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতে আমদানিকৃত চালের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯ টন (সরকারি খাতে ১১ লাখ ৫ হাজার ৫ টন এবং বেসরকারি খাতে ২৮ লাখ ৬১ হাজার ৫৪ টন)। এতে চাল আমদানিতে বেসরকারি খাতের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।

বেসরকারি খাতে আমদানিকৃত চালের বড় অংশ এখন পর্যন্ত খুচরা বাজারে আসেনি। চাল আমদানিতে ২৮ শতাংশ শুল্ক পুনরারোপিত হওয়ায় আমদানিকারক ও বড় বড় ব্যবসায়ী যেন বিনা শুল্কে আমদানি করা চালের দাম বাড়াতে না পারেন, সেদিকে সরকারকে কড়া নজর রাখতে হবে।
কড়া নজর রাখতে হবে আউশ ও আমন আবাদের ওপর। এ দুটি ফসল, বিশেষ করে চাল উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আমন ফসল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে চাল আমদানির শুল্কহার পুনর্বিবেচনা করতে হবে, যাতে এক কেজি মোটা চালের দাম আবারও ৫০ টাকা বা তার বেশি হয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বাড়াতে না পারে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/window/59442