১ জানুয়ারি ২০১৭, রবিবার, ২:৩৬

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

লুটে নাও যা কিছু পাও: চলতে ফিরতে দেখা

বাংলাদেশে যেন মহাসমারোহে চলছে লুণ্ঠনের মহোৎসব। আমাদের গ্রামাঞ্চলে এখনো শীতের শেষে ‘বাইছে’র উৎসব হয়। বিলের পানি এ সময় কমে যায়। বাজারে ঢোল দেয়া হয়, ‘অমুক বিলে বাইছ হবে। দলে দলে যোগদান করুন।’ এটি মাছ ধরার উৎসব। সকাল থেকে যার মাছ ধরার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রায়-শুকনা বিলে এসে হাজির হন। প্রধানত পলো, খরাজাল, নিদেনপক্ষে গামছা নিয়ে মাছ ধরতে সমবেত হয়ে থাকে গ্রামবাসী। যার কোনো কিছুই নেই, সে মাছ ধরে হাত দিয়ে হাতিয়ে। তাতেও মাছ অনেক পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এখন তেমনি ‘দুর্নীতির বাইছ’ চলছে। যার যেখানে যেটুকু সাধ্য আছে, সেটুকু নিয়েই সে অবাধ দুর্নীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ‘ইসি বাংলাদেশ মে সব চোর চোর’ আউর ‘লাট সাহেব কা শালা চোর’।
এই লুণ্ঠনের উৎসব অবাধ। দেশে কার্যত গণতন্ত্র নেই। জবাবদিহিতা নেই। সংসদে বিরোধী দল বলে কিছু নেই। এসব বিশাল দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন করার কেউ নেই। যে যার মতো লুটে নিচ্ছে, যেখানে যা কিছু পাচ্ছে। এসব প্রতিরোধ করার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান আছেÑ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তারা নিজেরাই বলেছেন, ‘এই প্রতিষ্ঠান নখদন্তহীন এক বাঘ।’ এ পর্যন্ত যা দৃষ্টান্ত আছে, তা হলো, দুদক বাস্তবে মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের দুর্নীতি ধোয়ার মেশিন। এই দুদক যন্ত্রের ভেতর দিয়ে বিশাল বিশাল দুর্নীতিবাজ ঢুকিয়ে দিলে একেবারে সাফফান সাফফা ধোপদুরস্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে। আজব মেশিন এই দুদক।
এক সময় আমরা দুই চার পাঁচ দশ লাখ টাকার দুর্নীতির কথা শুনতাম। এখন দুর্নীতি হয় শত-সহস্র কোটি টাকায়। এক ব্যক্তিই দুর্নীতি করেন হাজার হাজার কোটি টাকা। তাদের পৃষ্ঠপোষক সরকারের বড় চাঁইরা। ফলে তারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুর্নীতিবাজ প্রভাবিত সরকার তাদের লোকদের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির ঋণ মওকুফ করে দেন। চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিকে ‘কোনো টাকাই নয়’ বলে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হয়। বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ চোরদের রক্ষার জন্য কতই না কোশেশ। ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের নামে মওকুফ করে দেয়া হয় হাজার হাজার কোটি টাকা। এমন লুটের দেশ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া ভার। বড় প্রকল্পগুলোতে বছর না ঘুরতেই বরাদ্দ বাড়ানো হয় শত শত কোটি টাকা। কেন? তার জবাব জনগণের কাছে দেয়ার কোনো দায় নেই সরকারের। কারণ এ সরকার জনপ্রতিনিধিত্বশীল নয়। জনগণের ভোটে তারা নির্বাচিতও নন। ফলে দুর্নীতির ক্ষেত্রে এক তুঘলকি কারবার চলছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, সোনালী ব্যাংকের চার হাজার কোটি টাকার হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি আর বেক্সিমকো গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ। বেক্সিমকো গ্রুপের কিছু টাকা আদায়ের জন্য একটি ব্যাংক আদালতের আদেশ নিয়ে বেক্সিমকোর ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কের বাড়িটি নিলামে তুলেছিল। দরপত্রও পড়েছিল। কিন্তু তা খোলার আগেই সে নিলাম আদালতের আদেশেই স্থগিত হয়ে যায়। তাদের টিকিটিও কেউ স্পর্শ করতে পারে না।
এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন কোনো-না-কোনো সংবাদপত্রে রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সরকার তার থোড়াই পরোয়া করে। গত ২৫ ডিসেম্বর এক সহযোগী দৈনিক এ ধরনের দুর্নীতির একটি খবর প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ১৫৫টি রেজিস্টার বই প্রকাশ করতে জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো ৪২ কোটি টাকা খরচ করেছে। অর্থাৎ বইপ্রতি খরচ হয়েছে ২৭ লাখ ৯ হাজার ৬৬৭ টাকা ৪২ পয়সা করে! এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। এই রেজিস্টার বই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত তথ্যসংবলিত। তাতে আছে, ওইসব প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা, জনবল, উৎপাদিত পণ্য, মালিকানা, সম্পদের পরিমাণ, বার্ষিক আয় ইত্যাদি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এসব তথ্য সংগ্রহের জন্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর অর্থনৈতিক শুমারি বিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানপ্রতি খরচ ধরেছেন চার লাখ ১৮ হাজার টাকা। অথচ কাজটি অতি সামান্যই ছিল। একটি নির্ধারিত ফরম সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দিলেই তারা সেটি পূরণ করে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু তার জন্য কেন চার লাখ ১৮ হাজার টাকা খরচ হবে?
২০০৫ সালে ও ২০০৯ সালেও এ রকম নিবন্ধন বই ছাপানো হয়েছিল। ২০০৫ সালে বিএনপির আমলে তথ্য সংগ্রহের কাজে প্রতিষ্ঠানপ্রতি ব্যয় হয়েছিল মাত্র ২৩ টাকা ৬৫ পয়সা। আবার ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠানপ্রতি ব্যয় হয় ৫২ টাকা ৫০ পয়সা। ২০১৬ সালে এসে সেই ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানপ্রতি চার লাখ ১৮ হাজার টাকা! যুক্তরাজ্যের সাহায্য সংস্থা ডিএফআইডি আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে এ রেজিস্টার তৈরি করে দিতে চেয়েছিল। ডিএফআইডির বাজেটে প্রতি প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩১৩ টাকা ৮৫ পয়সা। এক লাখ ৫৫ হাজার প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টার বই বানাতে ডিএফআইডি ব্যয় ধরেছিল চার কোটি ৮৮ লাখ টাকা। কিন্তু সে অনুদান না নিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরো সরকারের ৪২ কোটি টাকা খরচ করে এই বিজনেস রেজিস্টার তৈরি করছে। ডিএফআইডি টাকা নিলে চুরি করবে কিভাবে? পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে পত্রিকাটি এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছেন, ‘একটি বিজনেস রেজিস্টার করতে এত অর্থ কেন ব্যয় হচ্ছে, তা তাকে জানানো হয়নি। অস্বাভাবিক এই ব্যয় কিভাবে অনুমোদন পেল, তা খতিয়ে দেখা হবে। এ ধরনের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিসংখ্যান ব্যুরোতে হচ্ছে, যা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।’ সরকারি অর্থে কোনো অনিয়ম হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান। তবে মন্ত্রণালয়ের একটি মহল এই খরচকে যৌক্তিক বলে দাবি করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু করেছে। ব্যুরোর মহাপরিচালক মোহাম্মদ ওয়াজেদ এই পাইলট প্রকল্পের ব্যয় অত্যধিক ধরা হয়েছে বলে উল্লেখ করে একে ‘অপচয়’ বললেও অজ্ঞাত কারণে এখন এই প্রকল্পের পক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ কাজ তিনি নিজের উদ্যোগেই করেছেন, নাকি ঊর্ধ্বতন কারো নির্দেশে করেছেন, তা স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশে নির্মাণকাজে অর্থ লুটের কিংবদন্তির নাম মগবাজার ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ যেন অনাদিকালে শুরু হয়েছিল, চলবে অনন্তকাল পর্যন্ত। প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে নাগরিক ভোগান্তি চরমে পৌঁছে গেছে অনেক আগেই। এ সরকারের আমলে নানা ভোগান্তি যেন নাগরিকদের নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। আবার সময় যত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে দফায় দফায় বাড়ছে এর ব্যয়ও। এক হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অতিসম্প্রতি এই ফ্লাইওভারের নির্মাণব্যয় আরো ২৭১ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ কর্মকর্তার বক্তব্য হচ্ছে, ‘সময় বেশি লাগলে ব্যয় তো বাড়বেই।’ কিন্তু আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, প্রকল্প যখন গ্রহণ করা হয়, তখন কেন এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার বিষয়টি নির্ধারণ করা যাবে না? কেন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় এনে তাদের জরিমানার ব্যবস্থা করা যায় না? কেন তাদের কালক্ষেপণের মাধ্যমে নির্মাণব্যয় বাড়িয়ে তোলার সুযোগ দেয়া হবে? আর সরকারের মনোভাবে মনে হয়, তারা যেন ব্যয় বাড়িয়ে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার জন্যই বসে আছেন। একই ঘটনা ঘটেছে পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রেও। সময় বাড়ছে। ব্যয় বাড়ছে।
এ দিকে আরেকটি তাজ্জব করা খবর হচ্ছে, বাংলাদেশে শ্রম আর নির্মাণসামগ্রীর ব্যয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে অনেক সস্তা হলেও এখানে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। এখানে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে সময় লাগে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে এক কিলোমিটার চার লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে ব্যয় হয় ১২৩ কোটি টাকা থেকে ২৫০ কোটি টাকা। কিন্তু ভারতে এই ব্যয় ১০০ কোটি টাকা আর পাকিস্তানে মাত্র ৭০ কোটি টাকা। মালয়েশিয়ায় এই ব্যয় ৬০ কোটি টাকা আর চীনে ব্যয় ৯০ কোটি টাকা। কেন এমন পরিস্থিতি, তা কেউ খতিয়ে দেখেনি। এর জবাবদিহিতারও কোনো ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশে প্রায় সব ফ্লাইওভার প্রকল্পের সাথে জড়িত বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর শামসুল হক বলেছেন, তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না যে, কেন বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণের ব্যয় সবচেয়ে বেশি।
তবে সুনির্দিষ্ট কোনো গবেষণা না থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রধান কারণ দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতিই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নিয়ামক আর প্রভাবশালীদের আরো বিত্তবান হয়ে ওঠার উৎস।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
 rezwansiddiqui@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/183432