১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ৫:০০

সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড: পাঁচ বছরে মামলা তদন্তের ফল শূন্য; এখনো পাওয়া যায়নি চুরি যাওয়া ল্যাপটপ; ৪৬ বার আদালতে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুনের ঘটনার পাঁচ বছরে মামলার তদন্তের ফল এখন পর্যন্ত ‘শূন্য’। হত্যাকাণ্ডের মোটিভ, খুনিদের গ্রেফতার কিংবা চিহ্নিতÑ কিছুই করতে পারেনি মামলা তদন্তকারী সংস্থা র্যাব। ঘটনার সময় সাগর-রুনির ফ্যাট থেকে চুরি যাওয়া দুই ল্যাপটপ র্যাব এখনো উদ্ধার করতে পারেনি। এরই মধ্যে র্যাবে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছেন। ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদকে। এর আগে তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন এএসপি মোহাম্মদ জাফর উল্লাহ। মামলার তদন্তভার র্যাবে স্থানান্তর হওয়ার পর তদন্তসংশ্লিষ্ট অগ্রগতি সম্পর্কে ৪৬ বার আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। প্রতিবারই প্রতিবেদনে তদন্তের জন্য আরো সময় চাওয়া হয়েছে।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/এ/২, রশিদ লজ অ্যাপার্টমেন্টের পঞ্চমতলার ফ্যাটে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনির তবিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমান বাদি হয়ে শেরেবাংলানগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে উচ্চ আদালতের নির্দেশে র্যাব তদন্ত করছে।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করে আদালতে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, এই মামলায় ইতোমধ্যে ১৫৮ জন সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে, যা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ইলেকট্রিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার ২৭ জন সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মামলার ঘটনাস্থল থেকে চুরি যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারে বিটিআরসি ও ইন্টারনেট সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আদালতও ল্যাপটপ উদ্ধারে বিটিআরসিকে সহায়তার নির্দেশ দেন। আদালত তার আদেশে উল্লেখ করেন, মামলার ঘটনা স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর। এ ছাড়া দীর্ঘ দিন মামলা তদন্তাধীন থাকায় বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। সর্বশেষ ৮ জানুয়ারি র্যাব আদালতে তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে। আদালত আগামী ২১ মার্চ পরিবর্তিত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতির ফ্যাট থেকে চুরি যাওয়া ল্যাপটপ এখনো উদ্ধার করতে পারেনি র্যাব। সাগর-রুনির ফ্যাট থেকে খোয়া যাওয়া দু’টি ল্যাপটপ এখনো র্যাব সন্ধান করছে। তবে সাগর-রুনির পারিবারিক সূত্র জানায়, ঘটনার সময় ওই ফ্যাট থেকে দুইটি ল্যাপটপ খোয়া যায়। একটি ল্যাপটপে সাগর সারওয়ার দৈনিক ইত্তেফাকে কর্মরত অবস্থায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক ‘কর্নেলকে আমি মনে রেখেছি’ বইটি লিখেছিলেন। এই বইটি ২০১১ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। ওই ল্যাপটপে দ্বিতীয় কিস্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আরো একটি গ্রন্থের অর্ধেকের বেশি অংশের পাণ্ডুলিপি লেখা হয়েছিল।
তদন্তকারী সংস্থা র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, তদন্তের শুরু থেকে র্যাব ল্যাপটপ দু’টি খুঁজছে। এ ব্যাপারে আদালতের অনুমতি নিয়ে র্যাব বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়েছে। তাদের কাছে ল্যাপটপের ব্যাপারে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। বিটিআরসি সবগুলো মোবাইল ফোন কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে এ ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে সহযোগিতা করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো মোবাইল ফোন কোম্পানি তথ্য দিতে পারেনি।
এ দিকে, তদন্তে কোনো অগ্রগতি না দেখে বিচারের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন নিহতের স্বজনেরা। নিহত রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হলেও এখন পর্যন্ত র্যাবের পক্ষ থেকে কোনো আশার বাণী তাদের শোনানো হয়নি। তারা এই মামলার তদন্ত নিয়ে একেবারেই হতাশ। এখন শুধু সাগর-রুনির একমাত্র উত্তরসূরি মাহির সারওয়ার মেঘকে নিয়ে তাদের চিন্তা। তাকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
সাগর সরোয়ারের মা সালেহা মুনীর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে কার্যত কোনো তৎপরতা নেই র্যাবের। ঘটনার পর প্রথম দিকে কয়েক দিন যোগাযোগ করেছিল র্যাব। এরপর গত পাঁচ বছরে তাদের সাথে যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার সময় যে রকম আশাবাদী হয়েছিলাম, গত পাঁচ বছরে তার চেয়ে বেশি হতাশ হয়েছি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসপি মহিউদ্দিন আহমেদের তথ্য দিয়ে কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, এই মামলায় গ্রেফতার আটজনের মধ্যে চারজন জামিনে রয়েছেন। তারা হলেনÑ স্কলাসটিকা স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা তানভীর রহমান, সাগর-রুনির ফ্যাটের দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল, হুমায়ন ওরফে এনামুল হক ও ডা: নিতাই হত্যা মামলার আসামি মিন্টু। এই মামলায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী আছেন ডা: নিতাই হত্যা মামলার আসামি কামরুল হাসান অরুণ, পেশাদার ডাকাত রফিকুল ইসলাম ও বকুল মিয়া।
র্যাবে মামলাটি তদন্তকালে ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা অন্তত অর্ধশত আলামতের ডিএনএ (ডি-অক্সিরাইবো নিউকিক এসিড) নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরীক্ষাগারে পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্রের ডিএনএ পরীক্ষাগার থেকে পাওয়া রিপোর্টগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে বলা হয় যে, ঘাতক যারাই হোক দুইটি পৃথক ডিএনএ নমুনার সাথে ওইসব ঘাতককের ডিএনএ নমুনার মিল পাওয়া যাবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো ওই ডিএনএ নমুনার রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, এ দুইটি ডিএনএ নমুনা বহনকারীরাই ঘাতক (কিলার)।
কেমন আছে মেঘ : রাজধানীর ইন্দিরা রোডের ৬৬/১২ নম্বর বাড়িতে মামার সাথে বেড়ে উঠছে মেঘ। বাবা মাকে হারানোর পাঁচ বছর পর মেঘ এখন গুলশানের বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল (বিআইটি) স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে। গতকাল বিকেলে সাংবাদিক ফারজানা রুপার ইন্দিরা রোডের বাসায় মেঘ ঘুরতে যায়। সেখানে কয়েকটি শিশুর সাথে সে ওঠাবসা করে। পরে সন্ধ্যায় ফিরে আসে মেঘের মামার বাসায়। ওই বাসায় সাংবাদিকরা যান মেঘের খোঁজখবর নিতে। কেমন আছো জিজ্ঞেস করতেই জবাব মিলল, ‘ভালো’। মেঘ জানায়, এখন পড়ছে গুলশানের বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়াল (বিআইটি) স্কুলে। আগে পড়ত সেন্ট জোসেফ স্কুলে। বড় হয়ে কী হতে চায়Ñ জানতে চাইলে মেঘ বলে, ‘ক্রিকেটার’। ঘরে খেলা দেখার চেয়ে মাঠে খেলা দেখতেই তার বেশি ভালো লাগে। কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে মেঘকে? জানায়, ‘মামা আমাকে স্কুলে নিয়ে যায়, বেড়াতে নিয়ে যায়, আমার সাথে ক্রিকেট খেলে, আমাকে চকোলেট কিনে দেয়, হোমওয়ার্ক করতে সাহায্য করে। রাতে আমি মামার সাথে ঘুমাই।’ বলল, ‘আব্বু আর মা মণিকে অনেক মিস করি, ওদের অনেক ভালোবাসি।’ চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। তারপর অনেকটা সময় একদম চুপ।
সাংবাদিক সমাবেশ : সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার ও খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে আজ বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেস কাবের সামনে সাংবাদিক মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। যৌথভাবে এই মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
একই দাবিতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি চত্বরে বেলা ১১টায় প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মুরসালিন নোমানী বলেন, সাগর-রুনি হত্যার বিচার না হওয়ায় সাংবাদিক সমাজ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। ঘটনার তদন্ত ও খুনিদের গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ দাবি থেকে এক পা-ও সরে দাঁড়াব না।
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/194781