২১ জানুয়ারি ২০১৭, শনিবার, ৩:১০

সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

রাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকার

সম্প্রতিককালে রাষ্ট্র বিষয়ক ধারণায় পরিবর্তনের ফলে অনেক মৌলিক ধারণাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। ফলে রাষ্ট্রের (State) পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ (Political system) শব্দটি। রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিয়ে ডেভিড ইষ্টন (David Easton) বলেছেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো লক্ষ্য স্থির করার, নিজেকে রূপান্তরিত করার এবং পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করার সৃজনমূলক এক ব্যবস্থা (‘A goal setting, self-transforming and creatively adaptive system’.)। রাজনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো ‘সমাজে উপযোগের প্রভুত্বব্যঞ্জক বরাদ্দ’ (The authoritative allocation of values).

অবশ্য গ্যাব্রিয়েল অ্যালমন্ড (G A Almond) রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিয়েছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। তার মতে, ‘রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো এমন একটি পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা যা প্রত্যেকটি স্বাধীন সমাজে বিদ্যমান আর যেখানে বৈধ উপায়ে কমবেশি বল প্রয়োগ করে বা বল প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ ও অন্যান্য সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে সংহতি সাধন ও অভিযোগের কাজ সম্পন্ন করা হয়’। মূলত রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো, ‘The political system is the legitimate, order maitainig or transforming system in the society.’ অর্থাৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো একটি বৈধ, শৃঙ্খলারক্ষাকারী ও রূপান্তর সাধনকারী ব্যবস্থা।

আমাদের দেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসব আপ্তবাক্যের তেমন কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না বরং প্রায় ক্ষেত্রেই এর ব্যত্যয় বেশ দৃশ্যমান। মূলত রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতালিপ্সা। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার ব্যুৎপত্তি হয়েছিল তা এখন আমাদের দেশে প্রায় অনুপস্থিত। ফলে আমাদের প্রচলিত রাজনীতি গণমানুষের কল্যাণে আসছে না। কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত না থাকায় নাগরিকরা রাষ্ট্রের সেবা থেকে অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হচ্ছেন। আর এ অবস্থাটা ক্রম অবনতিশীলই বলতে হবে।

মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হলেও রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে বা ক্ষেত্র বিশেষে উদাসীন থাকছে। আর এ উদাসীনতায় সৃষ্টি করছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনকল্যাণের পরিবর্তে অনৈতিক ক্ষমতা চর্চার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। দেশটাকে বানানো হয়েছে দুগ্ধবতী গাভী। মনের মাধুরী মিশিয়ে দোহন করার একটা অশুভ প্রতিযোগিতাও রয়েছে আমাদের মধ্যে। আর এই আত্মপ্রীতিই আমাদেরকে রীতিমত ডুবিয়েছে। তাই আইনের শাসন জোরালো ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না। জনজীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের হলেও জনগণ সে সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতিকে যেভাবে প্রস্তুত করা দরকার ছিল সেখানেও ব্যর্থতার ছাপটা সুস্পষ্ট। ফলে আমাদের ব্যর্থতার গ্লানির পাল্টাটা ক্রমশ ভারীই হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ব্যর্থতার ‘ষোলকলা’ পূর্ণ হয়েছে-এমনটা বলাও নেহাৎ গর্হিত হবে বলে মনে হয় না।

সুশাসনের অনুপস্থিতিই আমাদের এই জাতীয় বিপর্যয়ের জন্য প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয়। রাষ্ট্রের সকল সেক্টরেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দেশে প্রতিনিয়ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছেন অনেকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই আষাঢ়ে গল্পটা আমাদেরকে হজম করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু এ যুদ্ধটা কেউই প্রত্যক্ষ করতে পারছেন না। ঘটনার পর নিহতদের কুখ্যাত, ভয়ঙ্কর অপরাধী কিংবা ডাকাত দলের সর্দার তকমা দেয় আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। যা নিয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করছেন, কথিত এনকাউন্টারের নামে সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কারণ, তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গণতানিন্ত্রক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে পারছে না। ফলে অনৈতিক পন্থার আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। মূলত গণতন্ত্রহীন সমাজে পেশীশক্তির মহড়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী যে গণতন্ত্রহীনতার বিষবাষ্পের প্রতিফলন-এতে তো কোন সন্দেহ করা চলে না।

সে ধারাবাহিকতায় কথিত ক্রসফায়ারর নামে নির্মম ও নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চলছে। আর এর ভিকটিম হচ্ছে ভিন্নমতাদর্শীরা। এমনটিই মনে করেন সচেতন মহল। অপহরণ ও গুমের ঘটনা ঘটছে সমান্তরালে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকতে রাষ্ট্র বিচারবহির্ভূত হত্যা করছে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এসব হত্যাকা- হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ আছে সব কিছুই ঘটছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। অথচ আমাদের দেশের সংবিধানে গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবস্বত্ত্বার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত করা হয়েছে। আর জনগণের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘The Republic shall be a democracy in which fundamental human rights and freedoms and respect for the dignity and worth of the human person shall be guaranteed’. অর্থাৎ প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে।

একথা সর্বজনবিদিত যে, গণমানুষের কল্যাণেই রাষ্ট্রের ধারণার সৃষ্টি হয়। যা মানুষের জন্য কল্যাণকর তা-ই রাষ্ট্রের মূলনীতি হওয়া উচিত। মূলত মানুষের জন্য রাষ্ট্র ও রাজনীতি, রাষ্ট্র আর রাজনীতির জন্য মানুষ নয়। কিন্তু আমাদের দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, রাষ্ট্র ও ক্ষমতার স্বার্থে নাগরিক স্বার্থকে বলি দেয়া হচ্ছে। অভিযোগ আছে যে, শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতাকে নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে নাগরিকদের হেনস্তা করা হচ্ছে। এতে রাষ্ট্র, সংবিধান, প্রচলিত আইন ও নীতি-নৈতিকতা হচ্ছে পুরোপুরি উপেক্ষিত। এভাবে কোন সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজ চলতে পারে না।

সংবিধান বা শাসনতন্ত্র অনুসরণ করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাসহ নাগরিকের সকল অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার সে দায়িত্ব পালনে কতখানি সক্ষম বা আন্তরিক তা নিয়ে নানাবিধ প্রশ্নে সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রের সকল পর্যায়েই সাংবিধানিক শাসনের বিষয়টি ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। সারাদেশেই হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৭৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গ্রেফতারের আগে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ১১১ জন এবং পরে ৩২ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গ্রেফতারের আগে শারীরিক নির্যাতনের পাঁচজন ও পরে শারীরিক নির্যাতনে তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন। গ্রেফতারের আগে গুলীতে ১২জন ও পরে গুলীতে মারা গেছেন তিনজন। গ্রেফতারের পর অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন চারজন। গ্রেফতারের পর তিনজন রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন বলে আসক’র কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে।

২০১৫ ও ২০১৬ সালে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তিনশ’ ৪৬ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। সংস্থাগুলোর তথ্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালের ১১ মাসে (জানুয়ারি-নবেম্বর) একশ’ ৫৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ‘ক্রসফায়ারে’ ১৩৭, গুলীতে ১০, নির্যাতনে আট এবং পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে।
অপরদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তুলে নেয়ার অভিযোগও কম নয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত ২৮৪ জন গুম হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বরাতে। এইসব ভাগ্যাহতদের এখন পর্যন্ত কোন হদিস মেলেনি। ফলে প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয়নি স্বজনদের। আর কখনো শেষ হবে এমনটা মনে করার আপাত কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত ২৮৪ জন গুম হয়েছেন। এদের মধ্যে ২০১৩ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ৮৮ জন, ২০১৫ সালে ৫৫ গুম হয়েছে। ২০১৬ সালের ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৮৮ জন। এই ৮৮ জনের মধ্যে ৮ জনের লাশ পরবর্তীতে উদ্ধার হয়েছে। ফেরত এসেছে তিনজন ও গ্রেফতার হয়েছে ২০ জন। অপর ৫৭ জনের কোনো হদিস মেলেনি।

অধিকারের প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৩ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ৩৯ জন, ২০১৫ সালে ৩৮ জন ও চলতি বছরের ১১ মাসে ৪৮ জন গুম হয়েছে। চলতি বছর গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে জানুয়ারিতে সাত, ফেব্রুয়ারিতে এক, মার্চে নয়, এপ্রিলে ১০, মে মাসে ১৩, জুনে ১৪, জুলাইতে চার, আগস্টে সাত, সেপ্টেম্বরে চার, অক্টোবরে সাত ও নবেম্বরে আটজন গুম হয়েছে। এসব গুমের ঘটনায় ভিকটিমের স্বজনরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেও সরকার এ অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে তাদের দায় শেষ করছে।

অভিজ্ঞজনরা মনে করছেন, গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়গুলো সব দেশের সরকারই অস্বীকার করে। যারা গুম হন তাদের বিষয়ে বলে থাকে হারিয়ে গেছে, নিখোঁজ হয়েছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিখোঁজ বা গুম ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিমের আত্মীয়স্বজন প্রমাণ দিয়ে বলছেন, তাদের স্বজনকে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এটা বরাবরই অস্বীকার করেই দায় শেষ করছে। কিন্তু তাদের সন্ধানের জন্য কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ফলে রহস্যটা রহস্যাবৃত্তই থেকে যাচ্ছে।

মূলত, গুম বা অপহরণ যাই হোক এটি একটি গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। আর কেউ স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হলে তাদেরকে খুঁজে বের করার দায়িত্বও পুলিশের। গুম বা নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। গুমের কোনো অভিযোগ আসা মাত্রই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়ে নিরপেক্ষভাবে তার তদন্ত হওয়া দরকার। ভিকটিমের পরিবারকে তার স্বজনের অবস্থানের বিষয়ে জানাতে হবে। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের নিলির্প্ততা জনমনের সন্দেহ-সংশয়কে আরও জোরালো করেছে।

এখানেই শেষ নয়! একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, বছরজুড়ে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে চার হাজার ৫২৬ জন নারী ও কন্যাশিশু। এদের অনেককে হত্যাও করেছে দুর্বৃত্তরা। এদিকে মানবাধিকার সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে আরও একটি দৈনিকের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বছরের নবেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দেশের বিভিন্নস্থানে ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের সংখ্যা ৭০-এ পৌঁছেছে। এই ৭০ জনের মধ্যে অন্তত ৩৪ জনকে গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যারা বলেছেন তারা অভিযোগের আঙুল উঠিয়েছেন সরকারের দিকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে সরকারই ৩৪ জনকে গুম করিয়েছে। যা দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো, কারো ব্যাপারেই পুলিশ বা কোনো আইন-শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করা হয়নি। জনগণকে স্তম্ভিত করে বরং অভিন্ন ভাষায় জানানো হয়েছে, গুম হওয়াদের বিষয়ে সরকার কিছুই জানে না! ওদিকে ঘটনাপ্রবাহে গুমের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে নতুন একটি শব্দ- ‘নিখোঁজ’। সাদা পোশাকধারীরা কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর জানানো হচ্ছে, ওই ব্যক্তি নাকি ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছেন! অথচ স্বজনসহ পরিচিত ও তথ্যাভিজ্ঞরা জানাচ্ছেন, তাকে সরকারের কোনো বাহিনী উঠিয়ে নিয়েছে। বিষয়টি অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না।

কথিত এসব নিখোঁজ ব্যক্তির অনেককে দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কে বা কারা কেন তাদের হত্যা করেছে সে প্রশ্নের জবাব দেয়া হয়নি সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি নিখোঁজ এবং গুম হয়ে যাওয়া ২০ জনের পরিবার সদস্যরা জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের দুঃখ ও কষ্টের কথা শুনিয়েছেন। স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আকুল আবেদন জানিয়েছেন। অন্যদিকে গুম ও নিখোঁজ করার কর্মকাণ্ড এখনো বন্ধ হয়নি বরং মাত্র দিন কয়েক আগে পাবনা থেকে ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছে আটজন কলেজ ছাত্র। যা জনমনে মারাত্মক আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে।

মূলত গুম ও নিখোঁজের কোনো একটি ঘটনাকেই হাল্কাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, বিশ্বের সভ্য এবং গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রেই এ ধরনের নজীর পাওয়া যায় না। অন্যদিকে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে গুম-খুনের পাশাপাশি নিখোঁজ করে ফেলার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এখনো তার শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আশঙ্কার কারণ হলো, দায় স্বীকার করার এবং গুম হয়ে যাওয়াদের ফিরিয়ে দেয়ার পরিবর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশে গুম বলে কোনো শব্দ নেই। যারা গুম হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে, তারা নাকি বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন! অতীতে যারা গুম হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছিল তাদের অনেকে নাকি আবার ফিরেও এসেছেন! যা রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে।

আসলে সত্য আড়াল বা অস্বীকার করার পরিবর্তে সরকারের উচিত দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়া এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বাহিনীকে সংযত করা। মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব হলো জনগণের জানমালের নিরাপত্তাসহ জনজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তা না করে মহল বিশেষকে আনুকূল্য দেয়ার জন্যই জনজীবনকে অনেকটাই দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের কোন জবাবদিহিতা আছে বলে মনে হয় না। তাদের কাছ থেকে জবাবদিহিতা আদায় করার দায়িত্বও সরকারের। জনগণ এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না।

মূলত রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন’ করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর তা করতে হবে সম্পূর্ণ আইনানুগ ও সাংবিধানিক পন্থায়। কিন্তু এভাবে হত্যা, গুম ও অপহরণ করে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সমাধান করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। বিচারবহির্ভূত হত্যার নামে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লাইসেন্স দিয়ে এমন হত্যাকান্ড থামানোও যায় না। দেশে বিচারব্যবস্থার ফাঁক-ফোকর দিয়ে সন্ত্রাসী বের হয়ে যাবে এই ভিত্তিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাগুলো করে আসছে রাষ্ট্র। তাহলে বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী না করে কেন মানুষকে এভাবে হত্যা করা ফ্যাসিবাদ ও নৈরাজ্যবাদেরই নামান্তর।

আসলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে সর্বোপরি ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা নির্বিঘ্ন করতেই এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে বলে মনে করছেন আত্মসচেতন মানুষ। এই ধরনের হত্যাকাণ্ড কোনো দলের বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা সার্বিক হত্যাকাণ্ড। এটা রাষ্ট্রের চরিত্র, কোনো গোষ্ঠীর বিষয় নয়। কোনো রাষ্ট্রে গণতন্ত্রেও ঘাটতি থাকলে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে বলেই মনে করে অভিজ্ঞমহল। এটা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা বা দীর্ঘায়িত করার একটা কৌশল মাত্র। এই নির্যাতন মূলত একক নয়, প্রাতিষ্ঠানিক। শুধু নির্বাচন থাকলেই যে দেশে গণতন্ত্র বহাল থাকে বিষয়টা এমন নয়। রাষ্ট্র উদারনৈতিক জনকল্যাণমূলক হলেই তাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যেতে পারে। আক্ষরিক অর্থে দেশে সেই পরিস্থিতি নেই। আর গণতন্ত্রের এই ধরন চর্চা না করার কারণে কিংবা কার্যকর করতে না পেরে রাষ্ট্র বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ঘটিয়ে যাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এটা ভয়ংকর এবং হিংসাত্মক। আর এর নেতিবাচক প্রভাব হবে দীর্ঘ মেয়াদি। যা কারো জন্যই কল্যাণকর হবে বলে মনে হয় না।
মূলত চলমান হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা বন্ধ করতে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগটাও বেশ জোরালো। এসব বিষয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগও কম নয়। অথচ সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকের নিরাপত্তাসহ সকল অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। সরকার একদিকে যেমন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করতে পারছে না। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই জীবন-ধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে’।

অনুচ্ছেদ ৭ এ বলা হয়েছে, ‘আইনের কাছে সকলেরই সমান এবং কোনরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকে সকলেরই আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের লঙ্ঘনজনিত বৈষম্য বা এরূপ বৈষম্যের উস্কানির বিরুদ্ধে সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার সকলেরই আছে’।

মূলত যেকোন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সাময়িক সুবিধা অর্জন করা গেলেও তা কোন সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে আনে না বরং প্রতিহিংসা প্রতিহিংসারই জন্ম দেয়। তাই যেকোন সমস্যা সমাধানে সরকারকে বুদ্ধিদীপ্ত ও দূরদর্শী হওয়ার কোন বিকল্প নেই। জনগণ সরকারের কাছে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে।

উৎসঃ দৈনিক সংগ্রাম