২১ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৩:৪৫

নিম্নমানের কাগজে ছাপা হচ্ছে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই

এবারো বিনামূল্যের পাঠ্যবই নিম্নমানের কাগজে ছাপার অভিযোগ উঠেছে। কয়েকটি পেপার মিলস ও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে এনসিটিবি। অভিযোগ উঠেছে, এনসিটিবির কর্মচারী ইউনিয়নের কিছু নেতা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়াও কয়েকটি বড় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজ কিনে গোডাউনজাত করেছে। নভেম্বরের শেষ দিকে এসব কাগজ দিয়ে বই ছাপানো শুরু করবে।

এ জন্য ইতিমধ্যে ইন্সপেকশন টিমকে ম্যানেজ করার চেষ্টা চলছে বলে সূত্র জানিয়েছে। জানা গেছে, বাজারে নিম্নমানের কাগজ সরবরাহ করার শীর্ষে আছে আল নূর পেপার মিলস। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিগত বছরে নিম্নমানের কাগজ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে এনসিটিবিতে। এ ছাড়াও গাজীপুর পেপার মিলস, মক্কা পেপার মিলস, পূর্বাচল পেপার মিলস, হাক্কানী পেপার মিলস, মোস্তফা এবং ইকো
পেপার মিলস নিম্নমানের কাগজ বাজারে সরবরাহ করছে। এসব পেপার মিলস বইয়ের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের কাছে বাজার দরের চেয়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা কম মূল্যে কাগজ সরবরাহ করার অফার দিচ্ছে। এতে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের এ অফার লুফে নিচ্ছে। পরে এই কাগজ দিয়ে বইও ছাপানো হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাগজ খুবই নিম্নমানের। অনেকেই এই কাগজকে নিউজপ্রিন্ট বলে ডাকেন। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত নষ্ট কাগজ রিসাইক্লিং করে ফের কাগজ উৎপাদন করে। অভিযোগ রয়েছে, দরপত্রের শর্তানুযায়ী, ৮০ গ্রাম কাগজে বই ছাপার কথা থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানের কাগজের মান সর্বোচ্চ ৫৫ থেকে ৬০ গ্রাম। এনসিটিবির কর্মচারী ইউনিয়নের কতিপয় নেতা মাধ্যমিক স্তরের ইন্সপেকশন টিমকে ম্যানেজ করে এসব কাগজে বই ছাপায়। এরসঙ্গে যুক্ত ক্যাপিটাল, মডেল, এসআর ও এআরটিসহ কয়েকটি প্রেস। এসব প্রেসের সঙ্গে কয়েকজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও তাদের আত্মীয়রা জড়িত। প্রভাবশালী হওয়ার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে বলে এনসিটিবি।
সার্বিক অভিযোগের ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা মানবজমিনকে বলেন, ইন্সপেকশন টিম নিয়োগ দেয়া হয়েছে নিম্নমানের কাগজ ও ছাপা ধরার জন্য। এখানে কারা প্রভাবশালী সেটার দেখার দায়িত্ব তাদের না। এরপর যদি ইন্সপেকশন টিম এ ধরনের গর্হিত কাজে লিপ্ত হয় অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বিষয়টি তিনি নিজস্ব বলয়ে তদন্ত করে দেখার আশ্বাস দেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি মানিকগঞ্জের এসআর প্রিন্টার্সের নিম্নমানের ৬০ টন কাগজ আটকে দিয়েছে কন্টিনেন্টাল বিডি ইন্সপেকশন টিম। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এসব নিম্নমানের কাগজ প্রেস থেকে সরিয়ে নেয়ার আল্টিমেটাম দেন। আল্টিমেটাম অনুযায়ী ওই প্রেস সেই কাগজ সরিয়ে নেয়। একই অভিযোগ রয়েছে দুলাল সরকারের মালিকানাধীন বলাকা প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে। নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপার সময় তিনবার ওই প্রতিষ্ঠানের কাগজ আটকে দেয় কন্টিনেন্টাল বিডি। তবে তাদের কাগজ সরানোর কোনো চিঠি দেয়া হয়নি। এ ছাড়াও আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজ গোডাউনজাত করছে। নভেম্বরের শেষে দিকে বই ছাপার চাপ বাড়তে থাকবে তখন এসব কাগজ দিয়ে ছাপা শুরু করবে তারা। অভিযোগ রয়েছে বিগত কয়েক বছর ধরে প্রথমসারির কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বছরের শেষ দিকে নিম্নমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপায়। এমন অভিযোগে বেশ কয়েকবার এসব প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা ও কালো তালিকাভূক্ত করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কন্টিনেন্টাল বিডি প্রকল্পের পরিচালক শেখ বেলাল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, নিম্নমানের কাগজের ব্যাপারে আমাদের অবস্থান শক্ত। প্রথমদিকেই কাগজ ক্লিয়ারেন্সে কঠোরতায় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে শর্ত মোতাবেক কাগজ দিয়ে বই ছাপাচ্ছে। তিনি বলেন, আমি নিজেই রাত ১১টা পর্যন্ত মনিটরিং করছি। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুইজন তিনজন লোক সার্বক্ষণিক বসিয়ে রেখেছি। প্রাথমিক পর্যায়ের বই নিম্নমানের কাগজ দিয়ে ছাপানোর কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তিনি। নির্দিষ্ট পেপার মিল থেকে কাগজ কেনার শর্তে কাগজের ক্লিয়ারেন্স দেয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এই অভিযোগ অস্বীকার করে বেলাল হোসেন বলেন, শক্ত অবস্থানের কারণে অনেকেই আমাদের পেছনে লেগেছে। শেষ পর্যন্ত এ অবস্থানেই থাকবেন বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিম্নমানের কাগজে বই ছাপানো হলে ছাপার মান অনেক খারাপ হয়। কোনো কোনো ছবি থেকে কালি উঠছে। ছবির ব্যক্তিদের চেহারা অনেক ক্ষেত্রে বোঝা যায় না। বিশেষ করে শিশুদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এসব নাম সর্বস্ব পেপার মিলস এসব স্পে ব্যবহার না করায় কাগজে ময়লা, দুর্গন্ধসহ নানা ধরনের জীবাণু থেকে যায়। নিম্নমানের কাগজে ছাপানো বই থেকে শিশুরা চর্মরোগসহ নানা রোগে আত্রুান্ত হতে পারে। কারণ তারা বই উল্টানোর সময় মুখে হাত দেয়।
অভিযোগ উঠেছে নূর পেপার ও বোর্ড মিলস যে কাগজ সরবরাহ করেছে তার অধিকাংশই নিম্নমানের। এ নিয়ে কয়েকটি পেপার মিলস এনসিটিবির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। মাধ্যমিকের পাঠ্যবই ছাপার বিভিন্ন লটের কাজ পাওয়া প্রিন্টার্সরা চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত এ অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া মৌখিকভাবে সব ক’টি প্রতিষ্ঠান মনিটরিং টিমের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=88441