২১ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৩:৩৩

সড়কে মৃত্যুর বিচার নেই

নিরাপদ সড়ক দিবস কাল

দেশে প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনার প্রাবল্য ২০২০ সালের মধ্যে অর্ধেকে কমিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জনে খুব কমই অগ্রসর হওয়া গেছে। সড়ককে নিরাপদ রাখতে সরকারের অসংখ্য সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা থাকলেও তা আদৌ বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ পর্যন্ত মহাসড়ক দুটি চার লেনের হওয়া এবং অরিচা সড়কে কয়েকটি বিপজ্জনক মোড়সহ কিছু অংশে বিভাজক দেওয়ার পটভূমিতে অতি সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে বলে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়।
তবে সার্বিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার কোনো উন্নতি নেই। দুর্ঘটনার মামলা জমে আছে লাখের কাছাকাছি, কিন্তু বিচার হয় না বললেই চলে। গত ছয় বছরে ৩৭ হাজার ২৬৭টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র দুটির। চালকের সাজা ঘোষণার পর, ধর্মঘট ডেকে সারাদেশ অচল করে দেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। বছরের পর বছর ঝুলছে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন। কারণ মন্ত্রী-এমপিদের নেতৃত্বাধীন পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠানের একমত হওয়া দুস্কর। সে-অর্থে সড়ক নিরাপত্তা তাদের হাতে জিম্মি। এ প্রেক্ষাপটেই আগামীকাল রোববার পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস।

সরকারি হিসাবে, ২০০৮ সালে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় তিন হাজার ৭৬৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ৩৭৬ জনে। ২০১৬ সালের প্রথম সাত মাসে মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৪২২ জনের। মামলার ভিত্তিতে পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বেসরকারি হিসাবে প্রাণহানির
সংখ্যা এর প্রায় তিনগুণ। যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায়, ২০১৬ সালে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬ হাজার ৫৫ জন। তার আগের বছরে সংখ্যাটা ছিল ৮ হাজার ৬৪২। এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৩০ শতাংশ প্রাণহানি কমেছে।
দুর্ঘটনার কারণ :অতিরিক্ত গতি, বেপরোয়াভাবে গাড়ি চলানো, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল, মহাসড়কে অবৈধ যান চলাচল, সড়ক দখল, ট্রাফিক আইন অমান্য, অদক্ষ চালককে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকারের সংস্থাগুলো। মহাসড়কে যান চলাচলের সর্বোচ্চ গতি ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দিয়েছে। দূরপাল্লার বাসে গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র 'গভর্নর সিল' লাগানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু সড়কে তার বাস্তবায়ন নেই। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, বিগত ঈদুল ফিতরের সময় দুর্ঘটনার ৩২ ভাগই ঘটেছে অতিরিক্ত গতির কারণে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, এক-তৃতীয়াংশ দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতির কারণে।
যানবাহন নির্ধারিত গতিতে ট্রাফিক আইন মেনে চলছে কি-না তা দেখার দায়িত্ব সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও পুলিশের। যানবাহন নির্ধারিত গতিতে চলছে না কেন- এ প্রশ্নে বিআরটিএ চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান বলেছেন, মালিক-চালকরা সচেতন না হলে আইন ও নির্দেশনা দিয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তিনি জানান, সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে বিআরটিএ।
অতিরিক্ত গতির জন্য মালিকরা দায়ী করছেন চালকদের। মালিক সংগঠন সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েতউল্ল্যাহ বলেছেন, কোনো মালিক চান না বেপরোয়াভাবে চালিয়ে তার কোটি টাকার বাস ক্ষতিগ্রস্ত করতে। তার দাবি, যাত্রী ও চালকের তাড়ায় অতিরিক্ত গতিতে বাস চলে।

বিচারহীনতা :২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল সড়ক দুর্ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৭ হাজার ২৬৭টি। সরকারি হিসাবে এ সময় মৃত্যু হয়েছে ১৭ হাজার ৮৮ জনের। মামলা সহজে নড়ে না। সমাজে অনেক হৈচৈ হয়েছিল বলে প্রায় ছয় বছরের আইনি লড়াইয়ের পর গত ফেব্রুয়ারিতে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর মামলার রায় হয়। চালক জমির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন নিম্ন আদালত।
তবে ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর নাটোরের বড়াইগ্রামে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩৭ জনের মৃত্যু ঘটানোর দুর্ঘটনাটির মামলা স্তব্ধ হয়ে আছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, দায়ীরা ছাড় পাবে না। 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, 'এত আলোচিত ঘটনার যদি তিন বছরেও বিচার না হয়, তাহলে অন্যান্য ঘটনার ক্ষেত্রে কী অবস্থা তা তো বোঝাই যাচ্ছে।'
২০১১ সালের আলোচিত দুই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ছয় বছরের শিশু হামীম নিহত হওয়ার পরপরই আটক করা হয় অভিযুক্ত চালককে। ২০১১ সালের মে মাসে প্রাণ হারান বুয়েট ছাত্র ছাত্র খান জাহান আলী সম্রাট। আটক হন চালকও। আলোচিত এ দুই মামলার বিচার ছয় বছরেও হয়নি। অভিযুক্ত দুই চালকই জামিনে রয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৮৫ হাজার মামলা ঝুলে রয়েছে।
নিয়ন্ত্রণ অগ্রাহ্য : জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামছুল হকের গবেষণায় বলা হয়েছে, ট্রাকসহ পণ্যবাহী অন্যান্য যানবাহনে নকশা না মেনে লাগানো অ্যাঙ্গেল, বাম্পার ও হুকের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে অ্যাঙ্গেল, বাম্পার, হুক অপসারণের সময়সীমা বেঁধে দেয় বিআরটিএ। কিন্তু মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপের মুখে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংস্থাটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিআরটিএর অভিযানে বাম্পার খোলা হলেও অধিকাংশ ট্রাক, লরি, কাভার্ডভ্যানে এখনও অ্যাঙ্গেল ও হুক লাগানো রয়েছে। বিআরটিএর একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সমকালকে জানান, বাড়তি অংশ অপসারণ করেও লাভ হয়নি। অভিযানের পর আবারও যুক্ত করা হয়েছে।

এ অভিযোগের জবাবে ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী দাবি করেন, তারা বাম্পার ও হুক অপসারণ করেছেন। তবে তাদের মতে অ্যাঙ্গেল ক্ষতিকর নয়। এ কারণে তা অনেকেই অপসারণ করেননি।
আইন অনুযায়ী, ফিটনেস পেতে গাড়ি অবশ্যই ব্লু-বুকের নকশা অনুযায়ী হতে হবে। চালকের কেবিনের চেয়ে বেশি প্রশস্ত হতে পারবে না গাড়ির কোনো অংশ। কিন্তু অতিরিক্ত যাত্রী বহনে ট্রাকের মতো বাসসহ অন্যান্য যানবাহনেরও আকার পরিবর্তন করা হয়। এতে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু এসব যানবাহন বছরের পর বছর ফিটনেস সনদ পায়।
খোদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অবৈধভাবে ফিটনেস সনদ দিতে অতীতে গাড়ি পরিদর্শনের যন্ত্র নষ্ট করা হয়েছে।
বিআরটিএর উপপরিচালক (প্রকৌশল) মাসুদ আলম সমকালকে বলেছেন, এখন মিরপুরে ডিজিটাল পরিদর্শনের মাধ্যমে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। তাতে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। তিনি দাবি করেছেন, ফিটনেস সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়া এখন আগের তুলনায় অনেক স্বচ্ছ।
নৈরাজ্য :একজন পরিবহন মালিক নেতা সমকালকে জানান, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে অ্যাঙ্গেল লাগানো হয় অতিরিক্ত পণ্য বহনের জন্য। ৫ টন পণ্য বহনের ক্ষমতাসম্পম্ন ট্রাকে ১৮ টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করা হয়। ৩৩ টনের কাভার্ড ভ্যানে ৮০ টন পর্যন্ত পণ্য তোলা হয়! পণ্যের ভারে ট্রাক বা কাভার্ডভ্যানের দেয়াল যেন ফেটে না যায়, সে জন্যই নকশা-বহির্ভূত অ্যাঙ্গেল যুক্ত করা হয়। সংশ্নিষ্টরা জানান, অতিরিক্ত পণ্যবহন দুর্ঘটনা এবং সড়ক দ্রুত নষ্ট হওয়ার কারণ।
কিন্তু অতিরিক্ত পণ্য বহন বন্ধ করা যাচ্ছে না মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে। ২০১২ সালে এক্সেল লোড নীতিমালা প্রণয়নের পরও তা কার্যকর করা যায়নি। আগামী ১ নভেম্বর থেকে কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। গত বছর আগস্টে নীতিমালার অধীনে অতিরিক্ত পণ্যবহনে বর্ধিত হারে জরিমানা আদায় করা হয়। এর প্রতিবাদে পরিবহন শ্রমিকরা ২৪ সেপ্টেম্বর সীতাকুণ্ডে ওজন পরিমাপের মেশিন পুড়িয়ে দেন।
তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলে ধর্মঘট ডেকে চট্টগ্রাম বন্দর অচল করে দেন। টানা পাঁচ দিন আমদানি-রফতানি বন্ধ থাকে। এ আন্দোলনে সমর্থন দেয় নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙার নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন সমিতি। তাদের চাপে দুই সপ্তাহের মাথায় ছয় মাসের জন্য এক্সেল লোড নীতিমালা স্থগিত করা হয়।

দুর্ঘটনা কমাতে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নেই এমন যানবাহন মহাসড়কে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে গত ৩ অক্টোবর। সরেজমিনে ঘুরে সমকাল প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এখনও তিন চাকার যান মহাসড়কগুলোতে চলছে।
২০১৫ সালে হাইকোর্ট নির্দেশ দেন নছিমন, করিমন ও ভটভটির মতো অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করতে। এগুলো এখনও বন্ধ হয়নি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জামেল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, অন্তত ১৪ লাখ তিন চাকার যানবাহন রয়েছে। এগুলো মহাসড়কে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিন্তু বন্ধ করা যাচ্ছে না।

ভুয়া লাইসেন্স :বছরের পর বছর আলোচনা হলেও, ভুয়া লাইসেন্সে গাড়ি চালানো বন্ধ হচ্ছে না। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ ৮৪ হাজার ২১৩। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ১৯ লাখ ৫১ হাজার ২৮০ জন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গাড়ির তুলনায় চালকের ঘাটতি ১০ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৩।
দেশে বাস, ট্রাক, ট্যাঙ্কার এবং পণ্যবাহী প্রাইমমুভার ও ট্রেইলারের মতো ভারী যানবাহনের সংখ্যা এক লাখ ৯১ হাজার ৭৬। প্রতিটি ভারী যানে অন্তত দু'জন করে চালক প্রয়োজন। এ হিসাবে শুধু ভারী যানের জন্য চালকের প্রয়োজন প্রায় তিন লাখ ৯২ হাজার জন। কিন্তু ভারী যানবাহন চালানোর জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা দুই লাখ ৩৮ হাজার ৭২১ জন। বৈধ চালকের ঘাটতি প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার। অথচ গাড়িগুলো চলছে।

http://www.samakal.com/bangladesh/article/17101260