২১ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৩:২৫

ইসির সংলাপ

মূল চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন

সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসির ভূমিকা এখন দেখার বিষয় : ড. তোফায়েল আহমেদ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাথে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শেষ হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এর আগে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মতবিনিময় হয়। ইসির এ আয়োজন ‘ইতিবাচক’ হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছেÑ তিন মাস ধরে চলা এ সংলাপের মধ্য দিয়ে উঠে আসা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব কিংবা দাবি কি আদৌ বাস্তবায়ন হবে। প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব দেয়ায় এই সংশয় আরো বেড়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করাই এখন ইসির মূল চ্যালেঞ্জ। এসব প্রস্তাব যদি এড়িয়ে যাওয়া হয়, তাহলে সংলাপ প্রহসনে পরিণত হতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ সম্পন্ন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধামতো সুপারিশ করেছে। নির্বাচন কমিশন এখন আইন সংশোধন করবে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইলেও সরকার পক্ষ বলেছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইসি কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারবেÑ এটি এখন দেখার বিষয়। ইসিকে এখন থেকে ভাবতে হবে সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে। সবার জন্য সমান সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হলে তা কিভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সুবিধামতো প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের মানদণ্ড হলো নির্বাচনে জয়ী হওয়া। আর নির্বাচন কমিশনের মানদণ্ড হলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। সে আলোকেই ইসিকে প্রস্তাবগুলো নিয়ে বিবেচনা করতে হবে। অনেক প্রস্তাব বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। তবে যেগুলো ইসি বাস্তবায়ন করতে পারবে, সেগুলো তাদের করা উচিত। যেগুলো সরকারের বিষয়, সেগুলো নিয়ে সরকারকে অনুরোধ করতে হবে। সরকার না শুনলে সে অবস্থায় ইসি যদি মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাহলে সেটা তাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে।
নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের সাথে বৃহস্পতিবার সংলাপ শেষ করেছে ইসি। এতে ৫৭৮ দফা প্রস্তাব দিয়েছে দলগুলো। এসব দফার অধীনে আরো শতাধিক উপদফা রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান পরিষ্কার হয়েছে। সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ, নির্বাচনকালীন সরকার, সংসদ বহাল বা ভেঙে দেয়া এবং সেনা মোতায়েন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ দলগুলো বিপরীতমুখী প্রস্তাব দিয়েছে। সেনা মোতায়েনের পক্ষে প্রস্তাব করেছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে কোনো কোনো দল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে অথবা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা নামানোর কথা বলেছে। অন্য দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন না করার প্রস্তাব করেছে আওয়ামী লীগসহ ছয়টি দল। নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির স্বার্থে সংসদ ভেঙে ভোট গ্রহণের দাবি করেছে ১৮টি দল। সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছে ৯টি দল।
ইভিএমে ভাটগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি দল। অন্য দিকে বিএনপিসহ মিত্রদলগুলো ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিপক্ষে অবস্থান জানিয়েছে। সংসদ নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক সরকার থাকার প্রস্তাব করেছে জাতীয় পার্টিসহ ১২টি রাজনৈতিক দল। ওই সরকারে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপির প্রতিনিধিত্ব রাখার পক্ষে মত দিয়েছে কয়েকটি দল। অন্য দিকে বিএনপিসহ ১১টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছে।

সংলাপে নির্বাচন আইন আরপিও সংশোধন, নির্বাচনের সময়ে স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলো ইসির অধীনে রাখার প্রস্তাব করেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল।

অন্য দিকে সংলাপে সবার আস্থা অর্জনে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশনের ভাবমর্যাদা পুনরুদ্ধারের পরামর্শ দেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বিতর্কিত ইভিএম থেকে সরে এসে সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের পরামর্শ দেন। ভোটে কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার ঠেকাতে ইসির ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করে একাদশ সংসদ নির্বাচন ভয়মুক্ত ও সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তারা।

নাগরিক সমাজের সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, নির্বাচনে ভয়মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে সেনা মোতায়েন করতে হবে। নির্বাচনের আগে বর্তমান সংসদ ভেঙে দিতে হবে। সহায়ক সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হওয়া দরকার। ইসির সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
গত ১৬ ও ১৭ আগস্ট গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে সংলাপ করে ইসি। প্রথম দিনের সংলাপে ইসির ক্ষমতা প্রয়োগের পরামর্শ দেন সিনিয়র সাংবাদিকেরা। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রয়োজনে সেনা মোতায়েন করার পরামর্শ দেন অনেকে। দ্বিতীয় দিনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক সংলাপ করতে নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দেন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। নির্বাচনকালীন সরকারের ধরন যাই হোক না কেন সব চাপের ঊর্ধ্বে থেকে ইসিকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তারা।

গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সাথে ওই দিন সংলাপ শেষে ‘সরকার যে নির্বাচন পদ্ধতি ঠিক করে দেবে সেভাবে ভোট কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে’Ñ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এমন বক্তব্যে বিতর্কের ঝড় ওঠে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞেরা সিইসির এমন বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণের দায়িত্ব ইসির। যেভাবে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব সে ব্যবস্থাই করতে হবে ইসিকে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তার এ বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়।
রাজনৈতিকদলগুলোর সাথে সংলাপ শেষে ওই প্রশ্নই আবার ঘুরেফিরে আসে। ইসি কি সত্যিকার অর্থেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে?

গত জুলাইয়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত কর্মপরিকল্পনায় সাতটি করণীয় বিষয় শনাক্ত করা হয়। এগুলো হলোÑ আইনি কাঠামোগুলো পর্যালোচনা ও সংস্কার, কর্মপরিকল্পনার ওপর পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনর্নির্ধারণ, জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুতকরণ এবং বিতরণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ।
ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির বর্তমান কমিশন নিয়ে আস্থাহীনতা রয়েছে। সিইসির আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতা এবং তার নানা বক্তব্যকে দলটি ভালোভাবে নেয়নি। ইসির সংলাপে অংশ নিয়ে দলটি, ইসির ভূমিকাকে পর্যবেক্ষণে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/261801