২১ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৩:১৪

অধিকাংশ দলের প্রস্তাব বাস্তবায়নে অগ্নি পরীক্ষায় নির্বাচন কমিশন

 আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপ শেষ হয়েছে। মোট ৪০টি দল এ সংলাপে অংশ নিয়েছে। বেশির ভাগ দলের পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাতে নির্বাচন কমিশন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। নিরপেক্ষতা বজায় রেখে অধিকাংশ দলের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা এখন ইসির জন্য অগ্নি পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংসদ ভেঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যে না পড়লেও অধিকাংশ দলই ইসিতে এ দাবি জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোন বক্তব্য দেয়নি।
ইসি সূত্রে জানা যায়, রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপের প্রস্তাবগুলো লিপিবদ্ধ আকারে প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। যেসব ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্য হবে সেসব বিষয় আমলে নেয়া হবে। এ ছাড়াও এসব প্রস্তাব পর্যালোচনা করে ইসি কয়েক দফায় বৈঠক করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তবে যেসব বিষয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান বিপরীতমুখী এসব বিষয়ে ইসিকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। ইতোমধ্যে মৌলিক কিছু বিষয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে, সংসদ ভেঙ্গে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি বিএনপি জানালেও এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ কোন বক্তব্য দেয়নি। আর বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি জানানো হয়েছে বিপরীতে আওয়ামী লীগ ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে প্রস্তাব দিয়েছে। অপর দিকে নির্বাচনে সেনা বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে বিচারিক ক্ষমতা দেয়াসহ সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে বিরোীধতা করে বলেছে, কোন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা যায় তার ফৌজদারী কার্যবিধি ও সেনা বিধিমালায় উল্লেখ করা আছে। সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষ থেকে সংসদীয় আসনের সীমানা ২০০৮ সালের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২০১৪ সালের সংসদীয় আসনের সীমানা বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ও সেনা নিয়োগ বিষয়ে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের অবস্থানই দুই মেরুতে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দলগুলো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন চায়। নির্বাচনে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে সেনা নিয়োগেরও বিপক্ষে এ জোটের শরিকরা। অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটসহ গত নির্বাচনে অংশ না নেওয়া দলগুলো নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং বিশেষ ক্ষমতাসহ সেনা নিয়োগের পক্ষে।
সংলাপে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা এবং সেনা নিয়োগ বিষয়ে প্রায় সব দলই নিজস্ব অভিমত দিয়েছে। সে তুলনায় সীমানা পুনঃনির্ধারণ, ‘না’ ভোটের বিধান চালু, ইভিএম ব্যবহার এবং নির্বাচনী আচরণবিধি সম্পর্কে সব দলের অভিমত পাওয়া যায়নি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং নির্বাচন সংক্রান্ত অন্যান্য আইন বাংলায় রূপান্তরের বিষয়ে অনেক দলেরই সমর্থন মিলেছে। দুটি দল নির্বাচনে প্রার্থীর ব্যক্তিগত আট তথ্যসহ হলফনামা দাখিলের বিধান বাতিল চেয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তাদেরই রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেওয়া এবং সংসদে নারী আসনের সংখ্যা বাড়িয়ে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছে বেশ কয়েকটি দল।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সংলাপে অংশ নেওয়া ৪০টি দলের মধ্যে বিএনপিসহ ২৩টিই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং ম্যাজিস্টেরিয়াল ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব রেখেছে। বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সেনা মোতায়েনের পক্ষে। বিদ্যমান আইনের বাইরে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে আওয়ামী লীগসহ ৯টি দল। এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো মতামত নেই বা বিষয়টি ইসির ওপর ছেড়ে দিয়েছে আটটি দল।
সংসদ ভেঙে সহায়ক বা দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় ২০টি দল। এর বিপক্ষে বিদ্যমান সংবিধান অনুসারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই নির্বাচন চায় ৯টি দল। এ বিষয়ে ভিন্ন ধরনের প্রস্তাব রয়েছে বা স্পষ্ট কোনো অভিমত নেই ১১টি দলের।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালু করার পক্ষে মত দিয়েছে আওয়ামী লীগসহ সাতটি দল। এর বিপক্ষে মত ১১টি দলের। বাকি ২২ দলের এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো মত পাওয়া যায়নি। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের সব দলও ইভিএম প্রশ্নে একমত নয়। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে বেশির ভাগ দলই কোনো অভিমত রাখেনি। বিদ্যমান সীমানা বহাল রাখতে বলেছে আওয়ামী লীগসহ সাতটি দল। ভোটারসংখ্যার ভিত্তিতে পরিবর্তন বা ২০০৮ সালের আগের সীমানা পুনর্বহাল চেয়েছে বিএনপিসহ ছয়টি দল।

ইসিতে নিবন্ধিত ৪০টি দলের মধ্যে সাতটি ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক। এগুলো হলো আওয়ামী লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল -জাসদ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, তরীকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি) ও গণতন্ত্রী পার্টি। এর বাইরে জোটের সদস্য অন্য পাঁচটি দলের নিবন্ধন নেই। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে নিবন্ধিত দল রয়েছে ৯টি। এগুলো হলো বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। এ জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোট, এনপিপিসহ আরো কয়েকটি দল ইসিতে নিবন্ধিত হলেও তাদের মূল অংশ জোট পরিত্যাগ করেছে এবং তাদেরই ইসির সংলাপে ডাকা হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে নিবন্ধনের বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় এ জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামী সংলাপে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়নি।
কোন দলের কি প্রস্তাব:

সংলাপের প্রথম দিনে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটে (মুক্তিজোট) নির্বাচনে সেনা নিয়োগ প্রশ্নে বলে, এটা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয়। কমিশন প্রয়োজন মনে করলে সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশ মুসলিম লীগ এবং খেলাফত মজলিসও একই ধরনের প্রস্তাব দেয়। দল দুটির প্রস্তাব, তফসিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। তফসিল ঘোষণার পর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন করতে হবে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি দাবি জানায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচনে তাদের ভূমিকা দৃশ্যমান করতে হবে। নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার পর থেকে ভোট সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালীন তদারকি সরকারের ভূমিকা পালন করবে। ‘না’ ভোটের বিধান চালু করতে হবে এবং সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা জেলা সংখ্যার ভিত্তিতে ৬৪তে উন্নীত করে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) প্রস্তাব রাখে, নির্বাচনকালীন সরকারের শপথ গ্রহণের পর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। নির্বাচনের ৩০ দিন আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিতে হবে। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট সব ভোটকেন্দ্রে সেনা মোতায়েনের দাবি জানায় এবং রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার বিধান বাতিলের সুপারিশ করে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নির্বাচনের এক দিন আগে কেন্দ্রে কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানায় এবং সংসদ ভেঙে দিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করার প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নিরপেক্ষ অস্থায়ী সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচনের সাত দিন আগে থেকে পরের ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখা এবং নির্বাচনী কার্যক্রম শুরুর দিন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাখার প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি আগামী নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক, নিরপেক্ষ, নির্দলীয় কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন ‘বন্ধুপ্রতিম’ সরকার দাবি করে। এ ছাড়া নির্বাচনের কমপক্ষে আট দিন আগে সেনাবাহিনী মোতায়েন চায় দলটি। ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ তফসিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দিয়ে সেনা মোতায়েনসহ তিন ধাপে নির্বাচন করার প্রস্তাব রাখে। ‘না’ ভোটের বিধান ও ইভিএম চালু করা এবং ইসির নিজস্ব লোকবল থেকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করারও দাবি জানায় দলটি।

বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি সংসদ নির্বাচনের তিন মাস আগে থেকে নির্বাচনের পর এক মাস পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে বিচারিক (ম্যাজিস্ট্রেসি) ক্ষমতা দিয়ে মোতায়েন রাখার দাবি জানায়। ঐক্যবদ্ধ নাগরিক আন্দোলন বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। তবে বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনী নামিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করা যেতে পারে। ভোটার সংখ্যা এবং প্রশাসনিক এলাকা বিবেচনায় রেখে সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ করার পক্ষে মত দেয় দলটি। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব রাখে। পাশাপাশি দল দুটি নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েন করা, না ভোটের বিধান চালু এবং ইভিএম ব্যবহার না করা, ভোটারের সংখ্যা অনুযায়ী নির্বাচনী এলাকা পুনঃনির্ধারণ এবং সংসদের আসনসংখ্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা নিতে বলে। গণফোরাম জানায়, নির্বাচনের সময় যে সরকার ও প্রশাসন থাকবে তাদের নিরপেক্ষ থাকতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী পুনর্বহাল এবং সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা করার দাবি জানায় দলটি। গণফ্রন্ট সংবিধান সংশোধন করে সংসদে এ যাবৎ প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেয়। এ ছাড়া ভোট গ্রহণে সেনা মোতায়েন, ইভিএম চালু, ধর্মবিরোধী দলের নিবন্ধন বাতিল, সংসদীয় আসন আরো ১৫০ বাড়ানোসহ বিভিন্ন প্রস্তাব রাখে। ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সুপারিশ করে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার ও সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে মত দেয় দলটি। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করার ব্যাপারে ইসির উদ্যোগ নেওয়াসহ সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি জানায়। এ ছাড়া দলগুলোর সব কমিটিতে ৩৩ শতংাশ নারী রাখার বিধান বাতিল চায় দলটি। বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন নির্বাচনের তিন মাস আগে সংসদ বিলুপ্ত করে এবং ভোটের এক সপ্তাহ আগে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানায়। বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন সংবিধানের আওতায় জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তাব রাখে এবং এ নির্বাচনে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েন করার প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অব্যাহিত দেওয়ার বা সংসদ ভেঙে দেওয়ার জন্য আইন করার দাবি জানায়। এ ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা এবং জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনের ১০০ জন নারী সংসদ সদস্য রাখার বিধান করার প্রস্তাব রাখে দলটি। দলটি সেনা মোতায়েনের কোনো প্রস্তাব রাখেনি। জাকের পার্টি জানায়, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে স্থায়ী সমাধান দরকার। ভোটে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে এ দলের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল না। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) বর্তমান সংবিধান অনুসারে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন চায়। সেনাবাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত না করা, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিদ্যমান সীমানায়ই করার পক্ষে দলটি। এ ছাড়া ইভিএম ব্যবহার, মনোনয়নপ্রক্রিয়া সহজ করার জন্য হলফনামার বিধান বাতিলেরও দাবি জানায় দলটি।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব রাখে। একই সঙ্গে বিচারকি ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের দাবি জানায় দলটি। জাতীয় পার্টি (জাপা) দশম জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করে তার অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব দেয়। পাশাপাশি নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও তফসিল ঘোষণার পর সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাবও দেয় দলটি। এ ছাড়া ভোটার অনুপাতে সীমানা নির্ধারণের দাবি জানায়। বিকল্পধারা বাংলাদেশ বর্তমান সংসদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নবম সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের পক্ষে মত জানায়। তবে বিষয়টি সরকারের এখতিয়ার বলে এ বিষয়ে ইসির কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব রাখেনি। ইসির কাছে দলটির আরো প্রস্তাব, এই মুহূর্ত থেকে আর কোনো সীমানা পুনঃনির্ধারণ প্রয়োজন নেই। নির্বাচনে ‘না’ ভোট চালু এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব রাখে দলটি। ইসলামী ঐক্যজোটের প্রস্তাব, তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন-পরবর্তী সরকার গঠন পর্যন্ত বিদ্যমান সরকার শুধু রুটিন ওয়ার্ক করবে। নির্বাচনের সময় প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা মূল্যায়ন করে প্রয়োজনে স্পর্শকাতর এলাকায় সেনাবাহিনী নিয়োগ করা যেতে পারে। ঢালাওভাবে সেনাবাহিনী নিয়োগ করার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি প্রস্তাব রাখে, সংবিধানের আলোকে বর্তমান সরকারের অধীনেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, তবে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর সরকার দৈনন্দিন কার্যাবলি ছাড়া নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগ প্রসঙ্গে দলটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে নয়। নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ারও বিপক্ষে তারা। দলটি আগামী নির্বাচনের আগে সীমানা পুনর্র্নিধারণ না করার পরামর্শ দেয়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) প্রস্তাব, সংবিধান অনুসারে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। আর নির্বাচনে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে বিশেষ প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি ইসির এখতিয়ার। সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা এবং সংসদে নারী আসন ৩৩ শতাংশে উন্নীত করারও প্রস্তাব রাখে দলটি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বলেছে, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়ক বা কোনো সরকারের অধীনে নয়, নির্বাচন কমিশনের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচনে সেনা মোতায়েন বিষয়ে ইসি সিদ্ধান্ত নেবে। সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা এক শতে উন্নীত করে এসব আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। গণতন্ত্রী পার্টি প্রস্তাব রাখে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ ‘সহায়ক সরকার’-এর অধীনে ভোটের প্রস্তাব রাখে। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্তি ও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন, ২০০৮ সালের আগের সংসদীয় আসন সীমানা ফিরিয়ে আনা, ইভিএম চালু না করাসহ ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সংসদ ভেঙে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। এ ছাড়া ভোটারসংখ্যার ভিত্তিতে সংসদীয় আসন বিন্যাস, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করা, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী একনাগাড়ে দুইবারের বেশি দায়িত্বে থাকবেন না এমন বিধান এবং নির্বাচনের ১৫ দিন আগে ইসির অধীনে কর্তৃত্বসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করার প্রস্তাব রাখে। সাম্যবাদী দলের (এম-এল) প্রস্তাব, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই সময়ে সংসদ বিলুপ্তির প্রয়োজন নেই। আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা যেতে পারে। নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি বিশেষ প্রয়োজনে সেনবাহিনী মোতায়েন করা যেতে পারে। তবে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব রাখে। একই সঙ্গে সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে মত দেয়। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) সেনা মোতায়েন ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ পাঁচ দফা সুপারিশ রাখে। আওয়ামী লীগ সংবিধান অনুসারে বর্তমান সীমানায় ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব রাখে। নির্বাচনে সেনা নিয়োগ প্রশ্নেও আওয়ামী লীগ বর্তমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে আগ্রহী নয়। তাদের বক্তব্য, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করা যাবে তা ১৮৯৮ সালে প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ থেকে ১৩১ ধারায় এবং সেনা বিধিমালায় ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ শিরোনামে সুস্পষ্টভাবে তার উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনায় কেবল প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মচারীদের প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসার নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছে ক্ষমতাসীন দল। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে ভোটের পক্ষে মত দিয়েছে জাতীয় পার্টি (জেপি)। সেই সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য প্রয়োজনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে দলটি। সীমানা পুনর্বিন্যাস ও ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে দলটি।

সংলাপের শেষ দিনে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) সংসদ ভেঙে দিয়ে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে সেনা মোতায়েন ও সীমানা পুননির্ধারণ না করার এবং বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার সুপারিশসহ শর্তসাপেক্ষে ইভিএম চালুর পক্ষে প্রস্তাব রেখেছে। দলটির পক্ষে বলা হয়, ‘নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের এখতিয়ার নেই ইসির। আমরা এ বিষয়ে সরকারের কাছে বলব।

http://www.dailysangram.com/post/304285