বন্যা পরিস্থিতি ও করণীয় বিষয়ক সিপিডির সংলাপে অতিথিরা
২০ অক্টোবর ২০১৭, শুক্রবার, ৩:৩১

বন্যায় ১৫ হাজার কোটি টাকার তিবাঁধ নির্মাণে হরিলুট হয়নি : পানিসম্পদমন্ত্রী

হাওরে আগাম বন্যা ও ৩২ জেলায় মওসুমি বন্যায় মোট ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকার আর্থিক তি হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়াগল (সিডিপি)। হাওরে আগাম বন্যা আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে সময়মতো বাঁধ নির্মাণ না করার কারণে সেখানে এ ধরনের ক্ষতি হয়েছে। অপর দিকে বাকি ৩২ জেলার অনেক বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়। এসব বিষয় উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, এ হিসেবে হাওর এলাকার বোরো ফসল এবং অন্যান্য বন্যাদুর্গত এলাকার বাড়িঘর, সড়ক, কালভার্ট ও বাঁধের তি ধরা হয়েছে। এর বাইরে আরো অনেক তি হয়েছে। পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে সেগুলো হিসাবে আনা সম্ভব হয়নি।
তবে এসবের জবাবে পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বাঁধ নির্মাণে কোনো হরিলুট হয়নি। তবে কিছু দুর্নীতি হয়েছে। আর হাওরে বাঁধ ভেঙে নয়, অসময়ে বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে এমনটি হয়েছে। আর হাওরে বাঁধ নির্মাণে শত শত কোটি টাকাও বরাদ্দ দেয়া হয় না। মাত্র ৪২০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।

গতকাল সিপিডি ‘বন্যা ২০১৭ : পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক এক সংলাপ অনুষ্ঠানে এ বছরের তির এ চিত্র তুলে ধরে। একইসাথে ত্রাণ, বন্যা-পরবর্তী করণীয় নিয়ে সুপারিশ এসেছে সিপিডির প থেকে। সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। কৃষি অর্থনীতিবিদ মো: আসাদুজ্জামান, পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মাহফুজুর রহমান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিচালক হানিফ মোহাম্মদ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক গহর নঈম, সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার কৃষক মিয়া হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষক জাফর সাদিক ও ইশতিয়াক বারী।

অনুষ্ঠানের বক্তারা, আগামীতে বন্যা প্রতিরোধে নদী ড্রেজিং করা এবং বাঁধ নির্মাণের পর তার যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও সংরণের পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি বন্যার তি পুষতে সংস্কারকাজে আগামীতে হরিলুট হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। যদিও পানিসম্পদমন্ত্রী বলেছেন, বড়জোর লুট হতে পারে কিন্তু হরিলুট হবে না। কারণ এসব সংস্কারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ মাত্র ৪২০ কোটি টাকা। এই অর্থ থেকে হরিলুট হওয়ার কিছু নেই। তবে বাঁধ ব্যবস্থাপনা ও সংরণে বরাদ্দ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বন্যায় য়তি
সিপিডি হাওরাঞ্চলে মার্চ-এপ্রিলে হওয়া বন্যার ফলে বোরো ফসলের কী তি হয়েছে শুধু তা হিসাব করেছে। সিপিডির হিসাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছয় জেলায় আগাম বন্যায় ১০ লাখ ৩১ হাজার ৪০৫ পরিবারের ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৬২৩ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে ১৫ দশমিক ৮ লাখ টন বোরোধানের উৎপাদন কম হয়েছে, যা বোরো ধানের মোট উৎপাদনের ৮ দশমিক ৩ শতাংশ এবং হাওরাঞ্চলের মোট উৎপাদনের ৫২ দশমিক ২ শতাংশ। এর আর্থিক মূল্য ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বলে মনে করছে সিপিডি, যা সামগ্রিক কৃষি উৎপাদনের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পাশাপাশি ৪৬০ হেক্টর জমির শাকসবজি নষ্ট হয়েছে। এ অঞ্চলে ফসলের পাশাপাশি জীবনহানি, ঘরবাড়ি ও পশুসম্পদের তি হয়েছে। তি হয়েছে সড়ক, বাঁধ ও কালভার্টের মতো অবকাঠামোর।

এ দিকে আগস্টের মওসুমি বন্যায় দেশের ৩২ জেলার ৮২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার রোপা আমনের ৯ ভাগ জমি বন্যায় তলিয়ে যায়। এতে আর্থিক তি হয়েছে দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা। তবে তলিয়ে যাওয়া জমির ৮০ ভাগ ফের রোপণ করা গেলে তি কমে ৭০০ কোটিতে নামবে। আর ৪০ ভাগ ফের রোপণ করা গেলে তি হবে ১৮০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগস্টের বন্যায় সড়ক, কালভার্ট ও বাঁধের যে তি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য চার হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বন্যাদুর্গত এলাকায় বাড়িঘরের যে তি হয়েছে তার আর্থিক পরিমাণ দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে আগস্টের বন্যায় চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জিডিপির দশমিক ৩৫ শতাংশ থেকে দশমিক ৪৪ শতাংশ তি হয়েছে। এ ছাড়া গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, মৎস্য, পায়খানা, টিউবওয়েলের কী তি হয়েছে তা হিসাব করেনি সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, হাওর ও বন্যাদুর্গত বেশির ভাগ মানুষকে এখন কিনে খেতে হচ্ছে, এতে তাদের অতিরিক্ত ব্যয়বাবদ কত তি হচ্ছে তাও এ গবেষণায় যোগ করা হয়নি।

এ দিকে ত্রাণতৎপরতা নিয়েও সিপিডির গবেষণায় বক্তব্য এসেছে। গবেষণায় বন্যার্তরা কী পরিমাণ ত্রাণ পেয়েছে তাও দেখা হয়েছে। সিপিডি বলছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকলেও মাঠ প্রশাসনের সমতার অভাবে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এমনকি দুর্গম এলাকায় ত্রাণ পৌঁছায়নি। আবার যেসব এলাকায় কম লোক আক্রান্ত হয়েছে সেখানেও ত্রাণ গেছে কম। তবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম সময়মতো শুরু হয়েছিল। গবেষণায় বলা হয়, হাওরাঞ্চলের জন্য ত্রাণ হিসেবে চার হাজার ৫৪৪ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ থাকলেও তিন হাজার ২৮৭ টন বিতরণ হয়েছে। নগদ টাকার বেলায় একই চিত্র। বরাদ্দ ছিল ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, সেখানে বিতরণ হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ টাকা। একই অবস্থা মওসুমি বন্যায় আক্রান্ত ৩২ জেলায়। এসব জেলায় ২৭ হাজার ২০৭ টন চাল বরাদ্দ থাকলেও বিতরণ হয়েছে ১৭ হাজার ৭২১ টন। আর ৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার মধ্যে বিতরণ হয়েছে ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এসব এলাকায় ৩১ হাজার ৯৮০ বান্ডেল টিন বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণ বিতরণে তিগ্রস্তদের তালিকা করার েেত্র পুরনো অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে অভিযোগ সিপিডির। সংস্থাটি বলছে, অনেক েেত্র প্রকৃত তিগ্রস্ত চিহ্নিত হয়নি, আবার একই ব্যক্তি একাধিকবার চিহ্নিত হয়েছে।

গবেষণাপত্র উপস্থাপনের পর পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, এবার হঠাৎ করেই হাওরে বন্যা হয়েছে। মাত্র ৫-৬ দিনের ব্যবধানে পানির স্তর সাড়ে চার মিটার বেড়ে গেছে। এ দিকে নদীর নাব্যতা কমে গেছে। তিনি বলেন, বাঁধ ভেঙে পানি হাওরে ঢোকেনি। বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করেছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। অন্যান্য সব জায়গায় যেমন এখানেও তেমন। তিনি বলেন, পানি নেমে গেলে হাওরে সরেজমিন গিয়ে সব বাঁধ সংস্কার করা হবে। তিনি বলেন, হাওরে ফসল বাঁচানোর জন্য কৃষকদের বিআর-২৯ ধানের পরিবর্তে বিআর-২৮ ধান চাষ করার জন্য উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাঁধ নিয়ে হরিলুট হয়নি।
অর্থনীতিবিদ মো: আসাদুজ্জামান বলেন, বাঁধ তৈরি বিষয়ে সরকার যত আগ্রহী, বাঁধ ব্যবস্থাপনা ও সংরণের বিষয়ে ততটা মনোযোগী নয়। ফলে বানরের বাঁশে ওঠার মতো দেশও এগিয়ে আবার পিছিয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, এবারের বন্যা-পরবর্তীতে সরকারি ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা ও অব্যবস্থাপনা জোরালো হয়ে উঠেছে। দেশ ডিজিটাল হলে দুর্যোগের বিষয়ে তা কতটা এগিয়েছে তা দেখা দরকার। তিনি বলেন, এসডিজি অর্জন করতে হলে দুর্যোগের কারণে দারিদ্র্য বাড়ে এমন পরিস্থিতি দূর করতে হবে।

আইনুন নিশাত বলেন, বাঁধগুলোর ওপর ব্যাপক অত্যাচার হয়। এখন সময় এসেছে বাঁধ নিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার। তিনি বন্যায় তিগ্রস্ত এলাকা সংস্কারে হরিলুট হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এসব কাজে সংসদ সদস্যদের দূরে রাখার প্রস্তাব করেন। তিনি সড়কের সাথে ড্রেনেজ ব্যবস্থা রাখারও প্রস্তাব করেন।
সুনামগঞ্জের কৃষক মিয়া হোসেন বলেন, এ বছর এত বেশি পানি হয়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। নদীগুলোর নাব্যতা হারানোর ফলে হাওর ডুবছে। আগে নদী ৪০ ফুট গভীর ছিল, এখন আছে ২০ ফুট। তিনি বলেন, সরকার যে ভিজিএফ দিচ্ছে তাতে উপকার হচ্ছে। কিন্তু হাওরবাসী কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মানুষ আগামীতে ফসল কিভাবে করবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। তিনি বলেন, সরকার ৫ কেজি বীজ ধান, এক হাজার টাকা ও ৩০ কেজি সার দেয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে বীজের পরিমাণ বাড়ালে কৃষক উপকৃত হবে। কারণ ৫ কেজি বীজে কৃষকের কিছু হবে না।
অন্য বক্তারা বলেন, বন্যা মোকাবেলায় সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনসহ সবকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, গবেষক ও এনজিও কর্মীরা সংলাপে উপস্থিত ছিলেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/261453