২১ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ৯:১৫

বিদেশী ঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে দেশ

বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বিদেশী ঋণের ফাঁদে কঠিন শর্তে আটকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ ঋণ জাল থেকে বেরুতে না পারলে একদিকে জাতীয় ব্যয় বাড়বে অন্য দিকে জনগণের ওপর ঋণের বোঝাও বাড়বে। বিভিন্ন সময় নেয়া ‘নমনীয়’ ঋণকে ‘বাণিজ্যিক’ ঋণে রূপান্তর করার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে দাতারা। এত বিশাল পরিমাণ অর্থ বাণিজ্যিক ঋণে রূপান্তর করা হলে তার বোঝা বহন ও শোধ করা খুব বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। এতে উন্নয়ন অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেড়েছে বেসরকারি খাতের ঋণের পরিমানও। এতে আমাদের আর্থিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দাতা সংস্থাগুলোর দেয়া সহজ শর্তের ঋণের সাথে নানা শর্ত জুড়ে দেয়া হচ্ছে। জনগণের ঘাড়ে ঋণের বোঝা বাড়ছে।
সূত্র মতে,অভ্যন্তরিণ খাত থেকে ঋণ নিতে হলে নানা হয়রানির শিকার হতে হয় ব্যবসায়ীদের। বড় ঋণ পেতে দিতে হয় মোটা অংকের ঘুষ। উচ্চ সুদের পরও রয়েছে নানা ধরনের হিডেন (অপ্রকাশিত) চার্জ। এসব হয়রানির কারণেই বিদেশ থেকে ঋণ নিতে আগ্রহী স্থানীয় উদ্যোক্তারা। আর এ কারনেই বিদেশী ঋণের পরিমান বাড়ছে। একইভাবে সরকার বড় প্রকল্পের কাজ করতে এবং বাজেটের ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকার বলছে, বিদেশী অনেক ঋণের প্রস্তাব এখনও পাইপ লাইনে রয়েছে। আমরা চাইলেই তা নিতে পারি। কিন্তু এসব ঋণ নিতে নানা শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। চীন তার অন্যতম উদাহরণ। সারা দেশে প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় প্রায় ১২ প্রকল্প রয়েছে চলমান। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার বিদেশ থেকে নানা শর্তে ঋণ নিয়ে থাকে।
বেল্ট এন্ড রোড’ প্রকল্পের আগে ও পরে বাংলাদেশসহ অর্থনৈতিক দিক থেকে তুলনামূলক দুর্বল দেশগুলোকে চীনের আর্থিক সহায়তা করার বিষয়টি একই সঙ্গে চীন ও সাহায্যপ্রাপ্ত দেশগুলোর জন্য উপকারী। কিন্তু সাহায্য নিতে গিয়ে দেশগুলো ঋণের আরও গভীর ফাঁদে আটকে যাচ্ছে কিনা, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
বাংলাদেশ চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (ওবোর) প্রকল্পের বড় এক স্বত্ত্বভোগী। ভৌগলিক অবস্থান আর জ্বালানী আমদানি বিষয়ক সম্পর্কের জন্য চীনের এ প্রকল্পের অংশীদার বাংলাদেশ।
গত বছরের অক্টোবর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ১৩শ’ ৬০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি সই করে। এছাড়া আরও দু’হাজার কোটি ডলারের ঋণচুক্তি সই হয়।
দু’দেশের সরকার প্রধানের উপস্থিতিতে এই ঋণচুক্তিকে প্রথমে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সফট লোন বা নমনীয় ঋণ বলে উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, চুক্তি হওয়ার পর থেকেই এই ‘নমনীয়’ ঋণকে চীন সেটাকে ‘বাণিজ্যিক’ ঋণে রূপান্তর করার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সরকার থেকে সরকারের কাছেই এই ঋণগুলো যাবে, এমন কোনো প্রতিশ্রুতি চুক্তিতে দেয়া ছিল না।
এত বিশাল পরিমাণ অর্থ বাণিজ্যিক ঋণে রূপান্তর করা হলে তার বোঝা বহন ও শোধ করা খুব বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। তাই তখন থেকেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এর কড়া প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। এখনো বিষয়টির মীমাংসা হয়নি।
বাংলাদেশ ছাড়াও চীনের ঋণের ‘চোরাবালি’তে আটকে আছে অন্য অনেক দেশ। যার মধ্যে শ্রীলঙ্কার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসা দেশটির বর্তমান সরকার তার পূর্বসূরীর মতোই চেয়েছে চীনের আর্থিক সহায়তার ওপর নিজেদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সফল হয়নি।
চীনে গত মে মাসে অনুষ্ঠিত দু’দিন ব্যাপী ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবোর) প্রকল্পের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা বর্তমানে ৬ হাজার ৪শ’ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের তলায় আছে। ঋণ শোধের বোঝাটা সরকারি খাতের ওপর বিশাল চাপ ফেলছে। সরকারের ৯০ শতাংশ রাজস্বই এই ঋণ শোধের পেছনে চলে যাচ্ছে। মোট ঋণের মধ্যে আর্থিক সহায়তা হিসেবে চীনের কাছে দেশটির ঋণ ৮শ’ কোটি ডলার বলে জানিয়েছে দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিঙ্গাপুর।
চীনের ঋণের তালিকায় মালয়েশিয়ার অবস্থানও ভালো নয়। দেশটির বিরোধী দলগুলো অনেক আগে থেকেই চীনের অর্থসাহায্যের ওপর সরকারের অতিনির্ভরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছে। বিশ্বব্যাংক ও মালয়েশিয়ার পরিসংখ্যান বিভাগের দেয়া তথ্য অনুসারে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত চীনা প্রতিষ্ঠান মালয়েশিয়ার নানা অবকাঠামো প্রকল্পে ৩ হাজার ৫৬ কোটি ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে।
চীনের এই আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টিকে বিশ্লেষকদের অনেকেই সমালোচনা করে বলছেন, এর মধ্য দিয়ে সাময়িক সুবিধার আশ্বাস দিয়ে তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর নিজের আর্থিক প্রভাব বাড়িয়ে ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করছে অর্থদাতা দেশটি। এতে সাহায্য পাওয়া দেশগুলো চীনের ঋণের বোঝার তলে চাপা পড়ে তার ওপর গলা চড়াতে পারবে না।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞের আবার ধারণা, শুধু শুধু ক্ষমতা বাড়ানো চীনের উদ্দেশ্য নয়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের সূত্র ধরে দেশটির তুলনায় আঞ্চলিক শক্তি বৃদ্ধি চীনের বড় একটি লক্ষ্য।
উন্নয়নের নামে প্রতিনিয়তই বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ করছে বাংলাদেশ। এতে করে চীন জাপানসহ বিভিন্ন দাতা দেশ থেকে নানা শর্তে ঋণ গ্রহন করছে বাংলাদেশ। কঠিন শর্তের কারনে অনেক সময় ঋণ নেয়া থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশে^র অনেক দেশ। কিন্তু এসব দাতা দেশগুলো প্রথম সফট বা নমনীয় ঋণ বলে চুক্তি করে তার সাথে নানা শর্ত জুড়ে দেয়। এতে করে বিপাকে পড়ে উন্নয়নশীল এসব দেশ।
আর এ অবস্থা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। চীন নমনীয় ঋণ বলে বাংলাদেশের সাথে চুক্তি করলেও এখন বলছে উল্টো কথা। এ নিয়ে বাংলাদেশ দেন দরবার করলেও কোনো সুরহা হয়নি। একই ভাবে সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেড়েছে বেসরকারি খাতের ঋণের পরিমানও। এতে করে আর্থিক খাতে ঝুকি বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন এ থেকে বাংলাদেশকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এদিকে বেসরকারি খাতেও বিদেশী ঋণের পরিমান দিন দিন বাড়ছে। এ ঋণের লাগাম টানার সময় এসেছে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে,দেশের ব্যাংক ঋণের সুদহার বেশি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে বেসরকারি খাতকে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে দেশে সুদহার কমেছে। এ ছাড়া বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেড়ে এমন পর্যায়ে গেছে, যা ভবিষ্যতে বৈদেশিক লেনদেনে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ফলে এখনই এ ধরনের ঋণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সার্বিক নজরদারি বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের অনুমোদন দেয়ার সময়ে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর সুদের হার ছিল ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ। এখন তা ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। বর্তমানে বিদেশী ঋণের সঙ্গে দেশি ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহারের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাই সীমাহীন ঋণের অনুমোদন দেওয়া উচিত হবে না। বিষয়টি নিয়ে ভাববার প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) সভাপতি ড. তৌফিক আহমেদ চৌধূরী বলেন, স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের ভালো দিকের পাশাপাশি বেশ কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। এসব ঋণ ফিরিয়ে দেওয়ার সময় স্থানীয় মুদ্রা অবমূল্যায়নের ফলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে এ ধরনের সমস্যা যাতে না হয় সেদিকটি বিবেচনা করতে হবে।
জানা গেছে,বিদেশ থেকে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ আনার প্রবণতা বাংলাদেশে গত পাঁচ বছরে ২৬ গুণ বেড়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে এ ধরনের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১৬ কোটি মার্কিন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৪৯ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালে এমন ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২৩ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রায় আনা এ ধরনের ঋণ ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বৈদেশিক লেনদেনে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার আগেই এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি বাড়াতে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা দরকার।
২০১২ সালে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ আনার অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরই এ খাতে ঋণের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২০১৩ সালে এ খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৭০০ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৩১ শতাংশ। স্বল্পমেয়াদি এসব ঋণের ওপর নজরদারি না থাকায় এসব অর্থের অপব্যবহারও হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে ব্যাংক খাত।

 

http://www.dailysangram.com/post/296883-