২০ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ৯:৪৪

জনপ্রতি বরাদ্দ ১ কেজি চাল ২ টাকা ৫৬ পয়সা

দুর্ভোগ আর কষ্টের দিন তাদের। বানের পানিতে আশ্রয়হারা। ভেসে গেছে মূল্যবান অনেক কিছুই। এখন কেউ আশ্রয় নিয়েছে উঁচু রাস্তায়। কেউবা আশ্রয় কেন্দ্রে। কেউবা খোলা আকাশের নিচে। অনিশ্চিত এ সময় পাড়ি দিচ্ছে খেয়ে না খেয়ে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে। অনেকেই রাতে ঘুমিয়েছে ঘরে। এ ঘুমের মধ্যেই ঘর তলিয়ে গেছে পানিতে। কোন রকমে প্রাণ নিয়ে তারা আশ্রয় নিয়ে নিয়েছে অন্যত্র। কেউবা ঘরের চালায়। পরে অন্যরা এসে তাদের উদ্ধার করে। কিন্তু পেটতো আর না খেয়ে পারে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে তারা। এরই মধ্যে কেউ ত্রাণ নিয়ে গেলে শুরু হয় কাড়াকাড়ি। ত্রাণের বরাদ্দও অপ্রতুল। দিনাজপুরের চিত্রে দেখা যায়, সেখানে জনপ্রতি ১ কেজি চাল আর ২ টাকা ৫৬ পয়সা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর থেকে জানান, বাড়িতে গিয়ে ঘরের কোণে এদিক-সেদিক হাতিয়ে আর হন্য হয়ে খুঁজেও লাভ হলো না বৃদ্ধা আছিয়ার। কোনো হদিস পেল না তার পোটলার। প্রায় ৬৯ বছর বয়সের আছিয়া বন্যায় তার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে এখন দিশেহারা। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে গতকাল সকালে বাড়ি ফিরেছেন আছিয়া। ফিরেই হদিস করছিলেন তার পোটলার। কিন্তু বিধিবাম সেই পোটলাও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কালনাগিনি বন্যায়!

দিনাজপুর শহরের পশ্চিম উপকণ্ঠ বালুয়াডাঙ্গা নতুন পাড়ায় বাড়ি আছিয়ার। বাজারে সবজি বিক্রি করে জমিয়েছিলেন কিছু টাকা। সেই টাকা জমা করে রেখেছিলেন প্রথমে কাপড় তারপর পলিথিন দিয়ে মোড়ানো এক পোটলায়। সেই পোটলা রেখেছিলেন তার ঘরের কোণে চৌকির নিচে এক পাতিলে। এখন তা লাপাত্তা! তার দুই মেয়ে রয়েছে। তাদের বিয়েও হয়েছে। স্বামী পরিত্যক্তা এক মেয়ে আর তার দু’সন্তানকে নিয়েই আছিয়ার বসবাস। পোটলা হারিয়ে বৃদ্ধা আছিয়ার এখন শুধু আর্তি ‘আমার কি হইবো বাবা, আমি ক্যামনে ব্যবসা করুম, কি খামু! সব নিয়া গেলো কালনাগিনি বানে ভাসাইয়া!’
শুধু আছিয়া নয়, বন্যার পানি নেমে গেলেও দিনাজপুরে বন্যায় বানভাসি প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগে আছেন। এখনো ৫০ হাজার দুর্গত মানুষ ৩০০ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তাদের এখন বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের চরম সংকট দেখা দিয়েছে। প্রকট আকার ধারণ করেছে পেটের পীড়াসহ নানা রোগ-বালাই। এ কারণে জেলায় এখনো সরকারিভাবে ১২৫টি এবং জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম এমপির ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরো ১২০টি ফ্রি চিকিৎসা ক্যাম্প চলছে।
দিনাজপুরে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ৬ লাখ ২২ হাজার ৮৮৪ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৯ হাজার ২৯৯টি। বন্যার কারণে দিনাজপুরে গত ৬ দিনে মারা গেছেন ৩১ জন। এ তথ্য দিয়েছেন, জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মখলেছুর রহমান।

এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, জেলায় এক লাখ ২৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে কয়েক’শ একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
বন্যায় জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়ক, মহাসড়ক বিধ্বস্ত হওয়ায় দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কসহ বেশকিছু সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে দিনাজপুরের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে দিনাজপুরের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী আবু জাফর মো. রাকিব হাসান জানান, বন্যায় পানির স্রোতে দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও রেলপথের দু’টি স্থানে এবং দিনাজপুর-পাবর্তীপুর রেলপথের দু’টি স্থানে রেল স্লিপারের নিচের পাথর ও মাটি সড়ে গেছে, বেঁকে গেছে রেল লাইন। রেলপথ সংস্কারের কাজ শুরু করা হলেও কবে নাগাদ রেল চলাচল স্বাভাবিক হবে এ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি।

এদিকে করতোয়া নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ১নং বুলাকিপুর এবং ৩নং সিংড়া ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা নতুন করে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
বন্যা দুর্গতদের জনপ্রতি সরকারিভাবে মাত্র ১ কেজি করে চাল ও ২ টাকা ৫৬ পয়সা করে বিতরণের কথা বলা হলেও বুধবার পর্যন্ত বন্যার এক সপ্তাহ পরও জেলার অধিকাংশ বন্যাদুর্গত মানুষের কাছে তা পৌঁছেনি। ত্রাণ না পেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন যাপন করছেন বানভাসি গৃহহীন মানুষ।
তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে। গতকাল দুপুরে বিরল উপজেলার আজিমপুর ইউনিয়নের রাজারামপুরে গিয়ে বন্যার্ত মানুষের আহাজারি দেখা যায়। মালঝার গ্রামের প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধা ধলিবালা রায় জানান, বন্যার এক সপ্তাহে সরকারি এক ছটাক সাহায্যও পাননি তিনি।
পেশায় বাইসাইকেল মেকানিক এ বৃদ্ধার এখন কোনো আয় নেই। ঘরে কোনো খাবারও নেই। ইউনিয়ন পরিষদের অস্থায়ী ত্রাণ কেন্দ্রের সামনে অনুনয়-বিনয় করেন একটা রিলিফের স্লিপের জন্য, ‘বাবা সকাল থাকি না খাইয়া আছ বাহে, মোর এ্যাহনা ইলিপের বেবস্থা করি দ্যান না ক্যাঁনে।’

দিনাজপুরের বন্যাকবলিত বেশিরভাগ এলাকার চিত্র এমনই।
পাশাপাশি গৃহপালিত পশু গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে অনেকেই বিপাকে পড়েছেন। নিজেদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতেই ত্রাহি অবস্থা, সেখানে এগুলো নিয়ে কি করবেন। অনেকে তাই ‘পানির দরে’ বিক্রি করে দিচ্ছেন গবাদি পশু। এর মধ্যে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। কোনো কোনো স্থানে নেই ওষুধের ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও সরকারি-বেসরকারি ত্রাণের দেখা মিললেও বেশিরভাগ দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছেনি বলেই অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এ ছাড়া রাতে বানভাসি মানুষের মাঝে দেখা দেয় সাপের ভয়।

পানি সরে গেলেও বসতবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় অনেকেই বাঁশের মাচা পেতে পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। এদের অধিকাংশই রয়েছে খোলা আকাশের নিচে। কোনো ভালো গাড়ি রাস্তার পাশে দাঁড় করালেই ত্রাণের আশায় ছুটে যাচ্ছেন গাড়ির কাছে।
সিদ্দিক আলম দয়াল, উত্তরাঞ্চল থেকে জানান, লাখিয়ারপাড়ার চর গ্রামের আরেক বাসিন্দা জয়নাল শেখ। তিনি অন্যেল জমিতে কাজ করে সংসার চালান। কয়েক বছর থেকে তার মতো ৩ শতাধিক কামলা জমি বর্গা নিয়ে সবজি ও হাসমুরগি পালন করেন। সবজি চাষে তাদের ভালোই ফলন হয়। বিশেষ করে মিষ্টি কুমড়ার চাষ করে অনেকেই সংসারে সুখের দেখা পেয়েছেন। কিন্তু এবার বন্যায় সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে পানিতে। এখন তারা চোখে শর্ষে ফুল দেখছেন, তাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
শেখ জয়নাল বলেন, ‘ঘরবাড়ি জমিজমা সব পানির তলে আর হামরা আছি রাস্তার মদে। গরু ছাগল বউ ছাওয়া নিয়া শুতি পারি না। বসি থাকি। হামরা নাহয় পুরুষ মানুষ। বন্যা কি আর খরা কি বুঝি না। বাড়ি বউ বেটির ইজ্জত রক্ষার জন্য কোটে কি করি। ইজ্জত বুঝি আর থাকেনা বাহে। লখিয়ার পাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে এক সময় আছিলাম।’ তিস্তা নদীর ভাঙনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সব চলে যায় নদীতে। এখন সেই আশ্রয় কেন্দ্রের কোন চিহ্ন নেই। ৮৮ সালেও এই লখিয়ারপাড়ার চরের ঘরবাড়ি ছিল পানি থেকে অনেক উপরে। তারপর অনেক বন্যা গেল লখিয়ার পাড়ায় মানুষের কষ্ট ছাড়া কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। তারপরও বন্যা চলে যাওয়ার পর ছিল আশীর্বাদ। কিন্তু এবার বানের পানি তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। এবার হাবিবুর রহমান বালুচরে আগাম লাউ, কুমড়া, শষা, বেগুন লাল শাক সব নানান সবজি করেছিলেন। এজন্য এলাকার লিয়াকত চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ধার করেছেন ৮ হাজার টাকা। কিন্তু পাহাড়ি ঢল ও বন্যার পানি তার শুধু ঘরবাড়ি নয় সবই মিশিয়ে দিয়েছে। কোনমতো সন্তানদের নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। ঘরে রাখা চাল ডালসহ খাবার জিনিসও আনতে পারেনি। চোখে মুখে হতাশার ছাড়া থাকলেও লখিয়ারপাড়ার চরের গনি মিয়া, হাদি মিয়া, তারা মিয়ারা বলেন, বন্যা তো চলে যাবে। কিন্তু আমরা কোথায় যাবো। তাদের প্রিয় বালুভুমির উপর দিয়ে এখন স্রোত। অন্তত ২০ ফিট পানি। তারা মিয়া বলেন, হামরা কামলা খাটা মানুষ। হামার উপর আল্লার গজব পড়ছে এবার। এবার বুঝি আর বালু চর খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন হবে।

ইউপি চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী জানান, ‘লখিয়ারপাড়ার চর কতদিন পর যে মানুষ বসবাসের উপযোগী হবে তা বলা যাচ্ছে না। আশ্রয়হীন এই গরিব পরিবারগুলো আবারও আশ্রয়হীন হলো। লখিয়ারপাড়া চরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। কিন্তু তিস্তা নদী এবার ভাসিয়ে দিয়েছে তাদের ঘরবাড়ি, আবাদি জমি, সবজিক্ষেত সহ অন্যান্য ফসল।

সাওরাত হোসেন সোহেল, চিলমারী (কুড়িগ্রাম) থেকে জানান, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের পানি কমতে শুরু করলেও রয়েছে বানভাসিদের দুর্ভোগ। বন্যার ফলে গত কয়েকদিন থেকে লড়াই করছে প্রায় ২ শতাধিক গ্রামের পানিবন্দি প্রায় দেড় লাখ অসহায় মানুষ। বেশিরভাগ মানুষের মাঝে হাহাকার। টানা পানিবন্দি থাকায় বিপাকে পড়েছে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদিপশু। দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, জ্বালানি ও গো-খাদ্যের চরম সংকট। বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে সরকারি ভাবে মাত্র ৩৭০শত পেকেট শুকনো খাবার ও ১৬৯ টন চাল ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে বিতরণ করা হলেও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। অপর দিকে ত্রাণ অপ্রতুল হওয়ায় সবার ভাগ্যে জুটছে না ত্রাণের চাল। ত্রাণের জন্য চারদিকে হাহাকার চলছে। জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছে ত্রাণের আশায়। এমনকি প্রশাসন এবং বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করতে গেলেও শতশত মানুষকে ফিরতে হচ্ছে খালি হাতে। আমন ক্ষেত, বীজতলা, সাকসবজির ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষক হতাশ। এদিকে পানি নেমে না যাওয়ায় উপজেলার ৭৫টি প্রাথমিক, ১৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১১টি মাদরাসা ও ৪টি কলেজের পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করেছেন কর্তৃপক্ষ। প্রায় ১৮টি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে পানিবন্দি মানুষজন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=79613