১৯ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ১২:৩১

কম দামে কোরবানির চামড়া গরিব ঠকানোর আয়োজন

কাঁচা চামড়ার দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে

গরিব-মিসকিনের হক কোরবানির পশুর চামড়া পানির দরে কেনার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন ট্যানারি মালিকেরা। প্রক্রিয়াজাত চামড়ার দাম অব্যাহতভাবে বাড়লেও কাঁচা চামড়ার দাম টানা তৃতীয়বারের মতো কমানোর চিন্তাভাবনা করছেন তারা। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের নির্লিপ্ততার সুযোগে কোরবানিকৃত পশুর চামড়ার মূল্য প্রাপক গরিব-মিসকিনদের অর্থ আত্মসাতের মহোৎসব চলছে। যদিও ট্যানারি মালিকদের দাবি, গত বছরের চামড়া বিক্রি করতে না পারায় এবারো চামড়া কেনার মতো অবস্থা তাদের নেই।

২০১৩ সালের কথা। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি বর্গফুট প্রক্রিয়াজাত চামড়ার দাম ছিল দেড় ডলার। অর্থাৎ ১২০ টাকা। তখন দেশের বাজারে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার দাম ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকা। কাঁচা চামড়া ক্রয়মূল্য এবং প্রক্রিয়াজাত চামড়ার রফতানিমূল্যের মধ্যে পার্থক্য ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা। চামড়ার কারবারি, প্রক্রিয়াজাতকারী ট্যানারি মালিক এবং রফতানিকারকেরা তখনো লাভ করতেন। আর বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘এ’ গ্রেডের প্রতি বর্গফুট ফিনিশড ও ক্রাস্ট চামড়া বিক্রি হচ্ছে ২ ডলার ১০ সেন্টের ওপরে অর্থাৎ ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায়। অথচ মাঠপর্যায় থেকে প্রতি বর্গফুট চামড়া কেনা হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে প্রতি বর্গফুট চামড়া ফিনিশড বা ক্রাস্ট পর্যায়ে আনতে খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। অথচ এসব চামড়া বিদেশে রফতানি হচ্ছে উৎপাদন খরচের প্রায় দ্বিগুণ দামে। তার পরও আসন্ন কোরবানির ঈদে আরো কম দামে চামড়া কেনার জন্য সমিতির মাধ্যমে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন ব্যবসায়ীরা।

অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, সাভারের শিল্পনগরীতে বরাদ্দপ্রাপ্ত ১৫৪টির মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ট্যানারি চালু হয়েছে। যার বেশির ভাগই শুধু কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রথম ধাপের (ওয়েট ব্লু) কাজ করছে। কিন্তু চালু হওয়া বেশির ভাগ ট্যানারিতে পরবর্তী ধাপ অর্থাৎ ক্রাশড লেদার ও ফিনিশড লেদার তৈরির সুবিধা নেই। এ অবস্থায় আমরা চামড়া কিনব কিভাবে? কারণ চামড়া কিনে ফেলে রাখলে তো চলবে না। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা সংগ্রহ করতে হয়। আমাদের বেশির ভাগ কারখানাই বন্ধ, চামড়া কিনে কী করব? তিনি বলেন, শুধু কারখানা বন্ধই নয়, আমাদের অর্থসঙ্কটও রয়েছে। সাভারে কারখানার ভবন নির্মাণ, নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি এবং মেশিন স্থানান্তরে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। ফলে বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই অর্থসঙ্কটে রয়েছেন। এখন আমাদের আয়ের পথ বন্ধ। কিন্তু শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন, ব্যাংকঋণের সুদ ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাই এক দিকে অর্থসঙ্কট অন্য দিকে স্থানান্তরপ্রক্রিয়ার কারণে এবার কোরবানিতে চামড়া সংগ্রহ কঠিন হবে।

প্রতি বছর কোরবানির ঈদে সারা বছরের প্রায় অর্ধেক চামড়া সংগ্রহ করা হয় জানিয়ে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান নয়া দিগন্তকে বলেন, চাহিদা কম থাকায় গত বছর আমরা ৪০ থেকে ৪৫ টাকা বর্গফুট দরে পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছিলাম। এবার চাহিদা আরো কম। এখন পর্যন্ত পুরনো চামড়াই বিক্রি হয়নি। কাজেই সমিতির মাধ্যমে এবার চামড়ার দর গত বছরের চেয়ে প্রতি বর্গফুটে ৫ থেকে ১০ টাকা কমানো হতে পারে। এ লক্ষ্যে চামড়া খাত সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক সংগঠনগুলো নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। কোরবানির এক সপ্তাহ আগে আনুষ্ঠানিকভাবে দাম ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।

চামড়া শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের তিনটি সংগঠন নিজের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রতি বছরই কোরবানির ঈদের আগে চামড়া কেনার জন্য একটি দর ঘোষণা করে। ঘোষিত দর অনুযায়ী ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম নির্ধারিত ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। ২০১৪ সালে এ দাম ১৫ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। ২০১৫ সালে দর নির্ধারণ না করে গরিব-মিসকিনদের বঞ্চিত করে নামমাত্র মূল্যে চামড়া কিনেছেন ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্যমন্ত্রীর অনুরোধে গত বছর শেষ মুহূর্তে দাম নির্ধারণ করলেও তা ছিল অস্বাভাবিক কম। সেবার রাজধানী ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দর নির্ধারণ করা হয়েছিল মাত্র ৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে এ দাম ছিল ৪০ টাকা। যদিও এ দামও পাননি চামড়ার প্রকৃত মালিক গরিব মানুষ। চামড়ার দর নিয়ে চরম অসন্তোষ দেখা দেয় গত ফেব্রুয়ারি মাসে। তিন হাজার টাকার চামড়ার দর ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় নেমে আসায় টানা ছয় দিন ঢাকায় ধর্মঘটও পালন করে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি।

তবে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত কারখানার মালিকেরা ওই দামে চামড়া কিনতে পারেন না জানিয়ে একাধিক কারখানার মালিক জানান, পাড়া-মহল্লার মওসুমি ব্যবসায়ীরা কোনো কিছু না বুঝেই ঘোষিত মূল্যে চামড়া কিনেন। কিন্তু এরপর কয়েক হাত ঘুরতে গিয়ে দাম অনেক বেড়ে যায়। অথচ কোরবানিদাতারা উপযুক্ত দাম পান না। ক্ষতিগ্রস্ত হন গরিব-মানুষ। অন্য দিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বিদায় হয়, খরচ বেড়ে যায় কারখানার মালিকদের। ঝামেলা এড়াতে মওসুমি ব্যবসায়ীদের এড়িয়ে প্রকৃত ব্যবসায়ীর কাছে চামড়া বিক্রি করার পরামর্শ দেন তারা।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে নয়া দিগন্তকে বলেন, দাম নির্ধারণ করে দেয়ার পরও চামড়ার বাজার মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে যায়। দাম নির্ধারণ করা না হলে পরিস্থিতি বেপরোয়া রূপ ধারণ করতে পারে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি মহল্লাভিত্তিক ক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন তিনি। অন্যথায় গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি চামড়া পাচার হয়ে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/245296