১৮ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ৮:২৮

হারা মরলে ওরার কী আসে যায়...

ত্রাণের জন্য অপেক্ষা * জীবনে এমন বন্যা কখনও দেখিনি

‘হামার দুঃখ কেউ বুঝে না, হারার পাড়াত মেম্বার-চেয়ারম্যান এখনও খোঁজ করিবা আসে নাই। কেউ কোনো উপকার করেনি। হারা মরলে ওরার কী আসে-যায়’- এ কথাগুলো বলেছেন দিনাজপুর সদর ১নং ইউনিয়ন চেলগাজী গ্রামের সেত বালা (১১০)। এ গ্রামের বন্যাদুর্গত প্রায় দেড়শ’ পরিবার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছে। বর্তমানে এলাকায় পানি কিছুটা কমলেও বাড়ির উঠান ও ঘরে পানি রয়ে গেছে। শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এসব পরিবারের সদস্যরা শুধু একদিন খিচুড়ি পেয়েছেন। এছাড়া তারা আর কোনো ত্রাণ পাননি।

দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন ঘুরে বানভাসিদের দুঃখ-দুর্দশা দেখা গেছে। তাদের এ দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। ত্রাণ ও সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন অধিকাংশ বানভাসি। খাবার না পেয়ে বিশেষ করে নারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, বানভাসি অসহায়দের ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। কেউ ত্রাণ না পেলে খোঁজ করে ত্রাণ দেয়া হবে বলেও তিনি জানান।

দিনাজপুর সদর বড় বন্দর এলাকায় প্রায় ৭০০ পরিবার এখনও পানিবন্দি রয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন তারা। জানা গেছে, আশ্রয় কেন্দ্রে তারা শুধু রাত যাপন করেন। ভোর হলেই পানিতে তলিয়ে থাকা ঘরবাড়িতে গিয়ে তারা হাজির হন। পানিবন্দি বাসন্তী সাহা (৫৮) জানান, ‘এ জীবনে এমন বন্যা তিনি কখনও দেখেননি। খেয়ে না-খেয়ে তারা দিন কাটাচ্ছেন বলে জানান।’ চারপাশের পানি কিছুটা কমলেও তাদের এলাকার পানি কমছে না। বন্যার পানি এখানকার কোনো কোনো ঘরের ছাউনি পর্যন্ত পৌঁছে। সন্ধ্যা রানী জানান, তাদের যে কী কষ্ট হচ্ছে তা কেউ খোঁজ রাখেন না। তিল তিল করে গড়া সংসারের আসবাবপত্রসহ চাল-ডাল, কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে গেছে। সবকিছুই পানির নিচে। বন্যার পানির সঙ্গে মলমূত্র ভেসে একাকার হয়ে গেছে। ১৯৮৮ সালে এত ভয়াবহ বন্যা হয়নি। তিনি বলেন, কেউ আর্থিক সহযোগিতা কিংবা ত্রাণসামগ্রী তাদের দেয়নি।

এলাকার সাগর চন্দ্র দাস ও মো. মাসুদ জানান, ত্রাণ না পেয়ে এখানকার মানুষজন খুবই কষ্টে জীবনযাপন করছেন। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা বেশি কষ্ট পাচ্ছে। বৃহস্পতিবার বানভাসিদের মধ্যে বেশ কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের পুরনো কাপড় দিতে দেখা যায়।

সদর দিনাজপুরের রাখালপাড়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন বানভাসিরা। বয়স্ক জমিলা খাতুন জানান, বিলের মধ্যে তাদের গ্রাম। বন্যার পানি এখনও তাদের উঠান ও ঘরে রয়েছে। স্থানীয় মেম্বার হাবিবুর রহমান হবি একদিনও তাদের গ্রামে যায়নি। তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেনি। জানা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পর্যাপ্ত ত্রাণ যাচ্ছে না, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মিলছে না খাদ্যসামগ্রী ও বিশুদ্ধ পানি। স্বল্পতা রয়েছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, টিউবওয়েল ও শৌচাগারের।

দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট টানা বর্ষণে তলিয়ে গেছে। এ কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। বন্দরের বেশকিছু গুদামে পানি ঢুকেছে। ফলে আমদানি করা পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। টানা বৃষ্টিতে রাস্তার কার্পেটিং উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এতে পণ্যবাহী ট্রাক উল্টে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এতে শুধু আমদানি-রফতানি কার্যক্রমই ব্যাহত হচ্ছে না, পথচারীরাও পড়ছেন দুর্ভোগে। আইন কলেজ মোড়, স্টাফ কোয়ার্টার, মেডিকেল কলেজ মোড়, আমবাড়ি, বনকালি, আমতলী, বানিয়াপাড়া, মৌহুতপাড়া, আশকরপুর, রামচন্দ্রপুর, চিলিপাড়াসহ অর্ধশত পয়েন্টে এখনও পানি জমে আছে।

দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সরকার পর্যাপ্ত ত্রাণ দিচ্ছে। যারা ত্রাণ পাননি তাদের ত্রাণ দেয়া হবে। যাদের ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে তাদের সাহায্য করা হবে। তিনি বলেন, আমরা দলীয়ভাবে বানভাসিদের পাশে দাঁড়িয়েছি। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় যথাযথভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারছি না।

দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম বলেন, বড় বন্দর এলাকায় পানি সরছে না। এখানকার বানভাসিদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ত্রাণ দেয়া হচ্ছে। আরও ত্রাণ আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে ত্রাণ দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এখানে এ পর্যন্ত ২৩ জন মারা গেছে বলেও তিনি জানান।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/08/18/148903