ভারত থেকে আমদানি করা চাল নিয়ে দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দরে খালাসের অপেক্ষায় শত শত ট্রাক। বুধবারের ছবি -যুগান্তর
১৭ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৫

শুল্ক কমলেও চালের দাম কমছে না

আমদানি হচ্ছে ১৫ লাখ টন চাল * বিভিন্ন স্থলবন্দরে সুবিধা নেয়ার অপেক্ষায় ৮-১০ দিন ধরে চালভর্তি সহস্রাধিক ট্রাকের জট * এক মাসের ব্যবধানে দু’দফায় শুল্ক কমল ২৬ শতাংশ

অতি বৃষ্টি ও বড় বন্যার পূর্বাভাস পেয়ে সরকার বেসরকারি খাতে চাল আমদানিতে শুল্কহার আরও কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এ নিয়ে এক মাসের ব্যবধানে চালে আমদানি শুল্ক ২৬ শতাংশ কমানো হল। তবে শুল্কহার কমলেও বাজারে চালের দাম সেভাবে কমে না। ফলে শুল্ক কমার সুফলও পায় না ভোক্তারা।


এদিকে শুল্কহার কমবে- এমন খবরে প্রায় ৮-১০ দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দরে সহস্রাধিক ট্রাক খালাসের অপেক্ষায় দিন গুনছে। বেনাপোলে চালভর্তি ৩০০ ট্রাক, হিলিতে ৪৫৪ ও সোনা মসজিদে ২০০ ট্রাক অপেক্ষায় থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া আরও সহস্রাধিক চালবাহী ট্রাক গত ১০ দিন ধরে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় ওপারে (ভারত-হিলি সীমান্তে) দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে বুধবার শুল্কহার ২ শতাংশে নামিয়ে আনার খবরে এসব চাল আমদানিকারকের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে।

বেসরকারি খাতে চাল আমদানির ওপর গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত ২৮ শতাংশ শুল্ক ধার্য ছিল। কিন্তু হাওরে এ বছরে বন্যার কারণে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে চলতি মৌসুমে ১৬ লাখ টন বোরো ফসল কম উৎপাদিত হয়েছে। এমন ঘাটতি পরিস্থিতিতে চলতি বছরের জুলাই মাসে সরকার চালের ওপর ১৮ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করে। সরকারের এ পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল বেসরকারি খাতে আমদানির মাধ্যমে চালের ঘাটতি দূর করা এবং বাজারে চালের কেজিপ্রতি দাম কমিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা।

চাল আমদানিতে ১০ ভাগ শুল্ক নির্ধারণের পর প্রতি কেজি চালে ৩ থেকে সাড়ে ৩ টাকা শুল্ক দিতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। সর্বশেষ শুল্ক ৮ শতাংশ তুলে নেয়ায় আমদানি শুল্কহার নামে মাত্র ২ শতাংশ বহাল থাকছে। এর ফলে সরাসরি উপকার পাওয়ার কথা (কম দামে চাল কেনা) ভোক্তাদের। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সংশয় কাটছে না এর সুফল সাধারণ মানুষ কতটা পাবে তা নিয়ে। কারণ ১৮ শতাংশ শুল্কহার কমলেও ভোক্তা পর্যায়ে চালের দাম তেমন একটা কমেনি। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুুল মুহিত বলেছেন, বন্যার কারণে দেশে চালের দাম বেড়ে গেছে।

বর্তমানে (১০ আগস্ট) সরকারি খাদ্য গুদামে মোট খাদ্যশস্যের মজুদ আছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬ টন। এর মধ্যে চাল আছে ২ লাখ ৮৬ হাজার ৫০ টন। বাকিটা গম। গত বছর একই সময়ে মজুদ খাদ্য ছিল ৯ লাখ ৭ হাজার ১২ টন। যার মধ্যে চালের মজুদ ছিল ৬ লাখ ১০ হাজার ৫৬ টন। ইতিমধ্যে ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানির যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার বেশির ভাগই চলে এসেছে। কম্বোডিয়া থেকে আড়াই লাখ টন চাল আসবে। চলতি অর্থবছরে মোট ১৫ লাখ টন চাল আসবে।

বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, অতি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে দেশে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। সরকার তাই আগাম পদক্ষেপ হিসেবে দেশে খাদ্য মজুদ স্বাভাবিক রাখতে বিদেশ থেকে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১৫ লাখ টন চাল ও ৫ লাখ টন গম। এছাড়া চাল আমদানি প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতকেও উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এর জন্য চাল আমদানির ওপর শুল্কহার নামমাত্র ২ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখন ৮ ও আগের ১৮ মিলে মোট ২৬ শতাংশ শুল্ক তুলে নেয়া হচ্ছে। সর্বশেষ ৮ শতাংশ শুল্ক হ্রাসের প্রজ্ঞাপন আজই (বুধবার) জারি হবে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আমদানি করা চালের শুল্ক কমানোর কোনো আদেশ (এসআরও-স্পেশাল রেভিনিউ অর্ডার) জারি হয়নি বলে স্থানীয় কাস্টমস দফতরগুলো জানিয়েছে।

জানা গেছে, ১৮ শতাংশ শুল্ক কমানোর পর দেশে প্রতি কেজি চালে ৯ টাকা দাম কমার কথা। অথচ বাজারে কেজিপ্রতি দাম কমেছে সর্বোচ্চ মাত্র ১ থেকে ২ টাকা পর্যন্ত। যদিও ওই সময় খাদ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন শুল্ক কমানোর কারণে দাম কমবে ৬ থেকে ৭ টাকা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে শুল্কহার ব্যাপকভাবে কমানো হলেও দেশের কোনো বাজার বা দোকানে এ পূর্বাভাস মূল্যে কখনই চাল বিক্রি হয়নি।

এখন তো শুল্ক (২ শতাংশ ছাড়া) প্রায় তুলেই নেয়া হয়েছে। এতে কি বাজারে চালের দাম কমবে- এমন প্রশ্নের জবাবে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, শুল্ক কমানোর ফলে চালের দাম আরও কমবে। এখনও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই আছে চালের দাম। তবে দেশে এমন কোনো পরিস্থিতি নেই যে চালের দাম একসঙ্গে ১০/১৫ টাকা কমবে।

সূত্র জানায়, ভারত শুল্ক বাড়ানোর পরপরই চাল আমদানিকারকরা আবারও সরকারের কাছে চালের ওপর বহাল থাকা ১০ শতাংশ শুল্কও তুলে নেয়ার দাবি করে। এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে লিখিত আবেদনও দেয়া হয়। এ ইস্যুতে পরে খাদ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরেরর মধ্যে যৌথ আলোচনা হওয়ার সময়ই খবর চাউর হয়- আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ কমানো হচ্ছে। এ খবর আমদানিকারকদের কাছে পৌঁছামাত্র বেনাপোল, সোনা মসজিদ ও হিলিসহ দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি করা চাল খালাসের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে বাজারেও চালের দাম আরও বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী যুগান্তরকে বলেন, লোকসান দিয়ে কেউ ব্যবসা করবে না। দেশে চালের ওপর শুল্ক কমেছে ১৮ শতাশ। কিন্তু এর বিপরীতে চাল রফতানিকারক দেশ ভারত ৪০ শতাংশে শুল্ক উন্নীত করেছে। এতে করে আমদানি দামই বেশি পড়ছে। এ অবস্থায় লোকসান দিয়ে তো কেউ ব্যবসা করবে না। বেশি শুল্ক দিয়ে আমদানি করে খালাসের সময় যদি শোনে শুল্কহার কমবে, স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসায়ীরা অন্তত এর থেকে কিছু ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ নেবেন। হয়তো এ কারণেই বিভিন্ন স্থলবন্দরে চালের ট্রাকজট তৈরি হয়েছে।

হিলির সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আল-মদিনা ট্রেডার্স-এর স্বত্বাধিকারী ডিএম আলমগীর রহমান যুগান্তরকে জানান, চাল আমদানিতে সরকার শুল্ক হার আরও কমাতে পারে। এ খবর শোনার পরই মূলত আমদানিকারকরা ভারত থেকে নিয়ে আসা প্রায় সাড়ে চারশ’ ট্রাক চাল খালাস করছেন না হিলি বন্দরেই।

হিলি : শুল্ক হার কমবে এ আশায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর হিলিতে ভারত থেকে আমদানি করা চাল নিয়ে আসা ৪৫৪টি ট্রাক আনলোডের অপেক্ষায় রয়েছে। তাছাড়াও হিলি স্থলবন্দরের ওপারে ২৫ কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে আমদানি করা চালবাহী শত শত ট্রাক গত ১০ দিন ধরে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে।

সোনা মসজিদ : সোনা মসজিদ স্থলবন্দরে পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেড ইয়ার্ডের ভেতরে আটকে রয়েছে প্রায় ২শ’ চাল ভর্তি ভারতীয় ট্রাক। বুধবার পর্যন্ত চালভর্তি এসব ট্রাক পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেড ইয়ার্ডে আটকে রয়েছে বলে পানামার ম্যানেজার (অপারেশন) মাইনুল ইসলাম জানিয়েছেন। মূলত ভারত থেকে আমদানি করা চালের শুল্ক কমে যাবে এ আশায় আমদানিকারকরা চাল ছাড় করছে না। সোনা মসজিদ বন্দরে দায়িত্বরত কাস্টমসের সহকারী কমিশনার সোলাইমান আহমেদ জানান, চালের শুল্ক কমানো সংক্রান্ত আদেশ জারি হলে আদেশে উল্লিখিত তারিখ অনুযায়ী নতুন শুল্কহার কার্যকর হবে। এর আগে বন্দরে প্রবেশ করা কোনো চালভর্তি ট্রাক নতুন শুল্কহারে ছাড় করা হবে না।

বেনাপোল : শুল্ক প্রত্যাহারের আশায় বেনাপোল বন্দরে গত আট দিন ধরে আটকে আছে ৩শ’ চালবাহী ট্রাক। তারা আমদানি করা চাল খালাস করছেন না। বন্দরে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের পণ্যজট। লোড-আনলোডসহ ব্যাহত হচ্ছে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/08/17/148604/