১৭ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৩

রাজধানীর জলাবদ্ধতা

বক্স কালভার্টগুলো গলার কাঁটা

বক্স কালভার্ট থেকে তরল আবর্জনা তোলা হচ্ছে, ভেতরে রয়ে গেছে শক্ত আবর্জনা। সম্প্রতি রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে তোলা ছবি l প্রথম আলো
নিয়মিত পরিষ্কার না করায় রাজধানীর সেগুনবাগিচা ও ধোলাইখাল বক্স কালভার্ট প্রায় অকেজো হয়ে আছে। বৃষ্টি হলেই বক্স কালভার্ট-সংলগ্ন এলাকার পানি সরছে না। পাঁচটি বড় বক্স কালভার্টের মধ্যে অন্য তিনটি পুরোপুরি অকেজো না হলেও এগুলোর ভেতরে আবর্জনা জমাট বেঁধে আছে।
সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্টটি ঢাকা ওয়াসার। ধোলাইখালের ওপর নির্মিত তিন কিলোমিটার দীর্ঘ দয়াগঞ্জ কালভার্টটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অধীনে। বাকি তিনটি কালভার্ট ওয়াসার।
ওয়াসা নির্মিত গ্রিন রোড-পান্থকুঞ্জ কালভার্টের ভেতরটা তুলনামূলক পরিষ্কার হলেও ভারী বৃষ্টিতে ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। নিকেতন-হাতিরঝিল ও ইব্রাহিমপুর কালভার্ট দিয়ে পানির প্রবাহ মোটামুটি ঠিক থাকলেও ভেতরে আবর্জনা জমে আছে। গত শুক্রবার ও শনিবার বিভিন্ন কালভার্ট এলাকায় ঘুরে এগুলোর সম্পর্কে জানা যায়। এ ছাড়া রাজধানী শহরে আরও পাঁচটি ছোট বক্স কালভার্ট রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীর বক্স কালভার্টগুলো এখন গলার কাঁটা। এগুলো জলাবদ্ধতা দূর করার পরিবর্তে জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণে পরিণত হয়েছে।’
গত ৩১ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্স কালভার্ট উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। এর ওপর এলিভেটেড এক্সপ্রেস রোড চালু করা যায় কি না, তা যাচাই করতে বলেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের পর বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ মুহূর্তে কালভার্ট ভাঙা কঠিন কাজ। কারণ, এর ওপর রাস্তা রয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে।
ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যদি সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট ভেঙে কার্যকর কিছু করার দায়িত্ব ন্যস্ত করেন, তাহলে আমরাই এটা করতে পারি। ধোলাইখালের বক্স কালভার্টের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য হতে পারে।’ স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বক্স কালভার্ট বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে ইতিমধ্যে একটি কমিটি করে দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মো. মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বক্স
কালভার্ট বানিয়ে ভুল করা হয়েছে, এখন মাশুল দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। দুই বছর আগেই বলেছি, বক্স কালভার্ট ভেঙে উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। তবে ভাঙার আগে বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত, উন্মুক্ত করা হলে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে কি না।’
নগরীর বক্স কালভার্টগুলোর মধ্যে সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্টটি সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৎস্য ভবন এলাকা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত কালভার্টটি ওয়াসা নির্মাণ করেছিল। এরপর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কিছু অংশ নতুনভাবে যোগ করে এবং তার ওপর সড়ক নির্মাণ করে। সব মিলিয়ে আগে-পরে খরচ হয় ১৭০ কোটি টাকা।
বর্তমানে বৃষ্টি হলেই রাজারবাগ, মালিবাগ, পুরানা পল্টন, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, মতিঝিল, কমলাপুর ও আশপাশের এলাকায় অস্বাভাবিক জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এসব এলাকার সাতজন বাসিন্দা ও পাঁচজন দোকানির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেছেন, এখন বৃষ্টি হলেই তাঁদের মধ্যে জলাবদ্ধতার আতঙ্ক দেখা দেয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এক প্রতিবেদনে ডিএসসিসি বলেছে, এসব এলাকার পানি বক্স কালভার্ট হয়ে কমলাপুর জনপদে স্লুইসগেট পর্যন্ত যাওয়ার কথা। কিন্তু ভেতরের আবর্জনার কারণে পানি যেতে অনেক সময় লাগে।
ঢাকা ওয়াসার বর্তমান এমডি নিজেও স্বীকার করেছেন, এটি নির্মাণ করা ছিল আত্মঘাতী। ১৯৯৭ সালে ওই বক্স কালভার্ট নির্মাণের সময় ওয়াসার এমডি ছিলেন প্রকৌশলী আজহারুল হক। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ওই সময় সেগুনবাগিচা খালটি জবরদখল হয়ে গিয়েছিল। দখলমুক্ত করার জন্যই বক্স কালভার্টটি নির্মাণ করতে হয়েছিল।
ওয়াসা ও রেলওয়ের বিরোধ
কমলাপুর টিটিপাড়ায় সেগুনবাগিচা কালভার্টের পানি বের হওয়ার মুখে রেলওয়ের একটি কালভার্ট পড়েছে। সেই কালভার্টের কারণে বক্স কালভার্টের পানির প্রবাহ ৫০ শতাংশ কমে গেছে এমন অভিযোগ করেছে ঢাকা ওয়াসা। জলাবদ্ধতা কমানোর জন্য সেই কালভার্ট নতুনভাবে করতে ওয়াসার এমডি বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালককে গত এপ্রিলে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়, রেলওয়ের কালভার্ট আর বক্স কালভার্টের প্রস্থ প্রায় সমান। কিন্তু বক্স কালভার্টের উচ্চতা থেকে ওই রেলওয়ের কালভার্টটি ২ দশমিক ৭ মিটার উঁচু। এ জন্য বক্স কালভার্টটির কার্যক্ষমতা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। বক্স কালভার্টের মধ্যে পলি জমে গেছে। চিঠিতে বলা হয়, বক্স কালভার্টটি সমান উচ্চতায় না আনলে সংলগ্ন এলাকার জলাবদ্ধতা কমানো সম্ভব হবে না। এমনকি কমলাপুর স্টেশনও হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন বলেন, রেলওয়ে ১০০ কোটি টাকা মূল্যের জায়গা দেওয়ার কারণেই ওয়াসা জনপদে পাম্পিং স্টেশন করতে পেরেছে। ওয়াসার বক্স কালভার্টের কারণে ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা বেড়ে মানুষকে দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। তাঁর মতে, ওয়াসাকেই এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগ জানায়, ১২ ফুট গভীর বক্স কালভার্টের শক্ত আবর্জনা পরিষ্কার করতে বেগ পেতে হচ্ছে। ভেতরের শক্ত বর্জ্য তুলে আনার জন্য ওয়াসা গত বছর ৪ কোটি টাকার এক্সকাভেটর ও গ্রেভার যন্ত্র কিনেছে। বক্স কালভার্টের ভেতর থেকে এক বছরে ১৪ হাজার মেট্রিক টন আবর্জনা ওঠানো হয়েছে। এক বছরে খরচ হয়েছে প্রায় ১ কোটি টাকা। গত শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে সেগুনবাগিচা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বড় ম্যানহোল থেকে এক্সকাভেটর আবর্জনা তুলছে। ময়লা রাখা হচ্ছে রাস্তার ওপর।
দয়াগঞ্জ কালভার্টের ভেতর শক্ত বর্জ্য
২০০৫ সালে ধোলাইখাল ভরাট করে সায়েদাবাদ থেকে দয়াগঞ্জ পর্যন্ত বক্স কালভার্টের ওপর তৈরি হয় রাস্তা। দুটি তৈরিতে খরচ হয় মোট ৮৮ কোটি টাকা। ওই কালভার্ট চালুর পর এলাকায় জলাবদ্ধতা বেড়ে যায়। গত শনিবার দয়াগঞ্জের বাসিন্দা তরুণ ঘোষসহ কয়েকজন দোকানি অভিযোগ করেন, ধোলাইখাল ভরাট করার আগে পানি এভাবে জমে থাকত না।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ১০ ফুট গভীরতার ওই কালভার্টের ভেতরে অর্ধেকের বেশি অংশে শক্ত বর্জ্য। নির্মাণের পর থেকে কালভার্ট পরিষ্কারে বছরে গড়ে কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী ফরাজী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, ডিএসসিসি পরিষ্কার করার পরও বক্স কালভার্টের ভেতরে শক্ত বর্জ্য রয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে এলাকার জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের জন্য ধোলাইখাল পাম্পস্টেশন রয়েছে, যেটি ওয়াসা চালায়।
গ্রিন রোডের কালভার্টে আবর্জনা কম হলেও জলাবদ্ধতা
রাসেল স্কয়ার থেকে গ্রিন রোড চৌরাস্তা, সেখান থেকে পান্থকুঞ্জ পার্ক হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের পেছন পর্যন্ত গ্রিন রোড-পান্থপথ বক্স কালভার্ট। ১৯৯৩ সালে নির্মিত দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ওই কালভার্টের ভেতরেও আবর্জনা রয়েছে। কালভার্টের তলানিতে কঠিন ও পয়োবর্জ্য শক্ত হয়ে আছে বলে বুয়েটের একাধিক অধ্যাপক জানিয়েছেন। আলাদা কোনো লাইন না থাকায় কালভার্ট পথে বিভিন্ন বাসাবাড়ির কঠিন ও পয়োবর্জ্য হাতিরঝিলে ঢুকে পড়ে। ভারী বৃষ্টি হলে রাসেল স্কয়ার, পান্থপথ, গ্রিন রোড এলাকায় পানি জমে।
এ বিষয়ে ওয়াসার পরামর্শক এ কে এম শহীদউদ্দিন বলেন, এলাকায় পানি যাওয়ার নর্দমার সঙ্গে যুক্ত ২৫টি ক্যাচপিকের (যেটি পানি ধারণ করে গভীর নর্দমায় পৌঁছে দেয়) মধ্যে ২২টি বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন নির্মাণকাজের কারণে। এগুলো মেরামত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
মহাখালী-নিকেতন বক্স কালভার্ট
মহাখালী-নিকেতন বক্স কালভার্টের শুরু মহাখালী মেট্রোপলিটান হাসপাতালের পেছনে রসুলবাগ এলাকা থেকে। সেখান থেকে বাস টার্মিনাল হয়ে নিকেতন পর্যন্ত প্রায় ৮০০ মিটার দীর্ঘ এই বক্স কালভার্ট। ১৯৯৩ সালে নির্মিত এই কালভার্টের কারণে আগে বেশ জলাবদ্ধতা হতো। এখনো ভারী বৃষ্টি হলে মহাখালীর রসুলবাগ, লিচুবাগানসহ আশপাশের এলাকায় পানি জমে যায়।
ঢাকা ওয়াসার দাবি, হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়নের পর বক্স কালভার্টটি পরিষ্কার করা হয় এবং তার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তবে পান্থপথের মতো শুকনা মৌসুমে এই বক্স কালভার্টও হাতিরঝিল থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে শুধু শুকনা মৌসুমে নয়, গত সোমবার রসুলবাগ গিয়ে বক্স কালভার্টের মুখে ময়লাযুক্ত কালো পানি দেখা যায়।
ইব্রাহিমপুর বক্স কালভার্ট
৭০০ মিটার দীর্ঘ ইব্রাহিমপুর বক্স কালভার্ট ১৯৯২ সালে নির্মিত হয়। ইব্রাহিমপুর খালের পাশ থেকে মিরপুর ১৪ নম্বর পর্যন্ত এর অবস্থান। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এই বক্স কালভার্টের ওপর দিয়েই ১৪ নম্বর পর্যন্ত প্রধান সড়ক নির্মাণ করা হয়।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1292361/