১৭ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:২৯

মোগল আমলের চাইতেও পিছিয়ে গেলে প্রগতি কোথায়?

‘৩২ বছরে ৩৯ খাল নিশ্চিহ্ন’- শিরোনামে একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। ২৩ জুলাই তারিখে মুদ্রিত প্রতিবেদনটির শুরুতেই প্রশ্ন রাখা হয়েছে, ধোলাইখালের কথা কি কারও মনে আছে? এমন প্রশ্ন আসলে বর্তমান সময়ে রাজধানী ঢাকাবাসীর জন্য শ্রেষ্ঠ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের সাথে জড়িয়ে গেছে নগরবাসীর জীবনযাপনের প্রশ্ন। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, শুধু ধোলাইখাল নয়, রাজধানীর মানচিত্র থেকে গত ৩২ বছরে ৩৯টি খাল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অবশিষ্ট ১৫টির মধ্যে মাত্র চারটির অংশ লেক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও অন্যগুলো ভরাট ও দখলে সংকুচিত হয়ে নর্দমার আকৃতি পেয়েছে। ঢাকা ওয়াসার হিসাবেই নগরীতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৫৪টি খালের অস্তিত্ব ছিল। বেশিরভাগ খালের সংযোগ ছিল রাজধানী লাগোয়া চারটি নদীর সঙ্গে। যেমন সূত্রাপুর, লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুর বসিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার আব্দুল্লাহপুর হয়ে তুরাগ নদী, খিলক্ষেত ডুমনি হয়ে বালু নদী এবং মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিল খালগুলোর। বাস্তব এমন চিত্র এখন যেন শুধুই স্মৃতি। আব্দুল্লাহপুর খালটি হরিরামপুর, রানাভোলা, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা, দলিপাড়া হয়ে বাউনিয়ায় তুরাগ নদীতে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু রাস্তা ও রাজউকের প্লটের কারণে খালটি এরই মধ্যে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ছোট ছোট নালায় পরিণত হয়েছে। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর অংশে লেকের উত্তরপ্রান্ত দখল করা হয়েছে ময়লা ফেলে। সেখানে প্লটও তৈরি করা হয়েছে। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের দক্ষিণ পাশ দিয়ে বহমান খালটি এখন পুরোপুরি নর্দমা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের মা-া খাল সবুজবাগ থেকে শুরু হয়ে মাদারটেক, দক্ষিণগাঁওয়ের পাশ দিয়ে বালু নদীতে মিশেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এটি ওই এলাকার পয়ঃনিষ্কাশনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর দখল ও দূষণে অনেক আগেই সঙ্কুচিত হওয়া খালটি এখন ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। তবে খাল কী করে ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তিতে পরিণত হলো তা এক বড় প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। এই প্রশ্নের কোনো জবাব নেই ঢাকা ওয়াসার কাছেও।
খাল কী করে দখলে চলে যায়, তার কিছুটা বিবরণ পাওয়া যায় প্রতিবেদনটিতে। খাল দখল করার কৌশলগুলো প্রায় অভিন্ন। শুরুতে স্রোতবাহী খালের পানিতে খুঁটি পুঁতে মাচান বানিয়ে শত শত বস্তিঘর তৈরি করা হয়। এরপর ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করা হয় খাল। ছোট ছোট বাঁধ দেয়ার নজিরও রয়েছে। একপর্যায়ে প্রভাবশালী মহল এগিয়ে যায়। গড়ে তোলা হয় পাকা স্থাপনা। এভাবে খাল-নালা দখল ও নিশ্চিহ্ন করার ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাজধানী জুড়ে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ক্ষমতাসীনদের প্রচ্ছন্ন মদদে চোখের সামনে বিলীন হয়ে যাচ্ছে খাল-নালা। এর বিরূপ প্রভাবে প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ভোগেন রাজধানীবাসী। অবাক ব্যাপার হলো, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেও খাল-বিল-জলাশয় দখল করা হয়েছে। বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের জয়নগর প্রকল্পের জন্য বিলীন হচ্ছে বাউনিয়া খালের অস্তিত্ব। সরেজমিন দেখা যায়, খালটির ওপর বাঁশ ও টিন দিয়ে অর্ধশতাধিক ঘর তোলা হয়েছে। এসব ঘর বানাতে খালের ওপর বাঁশ পুঁতে বাঁধের মত করে পানিপ্রবাহ আটকে দেয়া হয়েছে। খালের মধ্যে প্লাস্টিক বোতল, টিন, পলিথিনসহ বিভিন্ন বর্জ্য জমে আছে। কাফরুল, কচুক্ষেত, ভাষানটেক, ইব্রাহীমপুর ও মিরপুর এলাকার নালার পানি এই খাল দিয়ে নামে। খালে পানি প্রবাহিত হতে না পারায় সব ময়লা এসে বাগানবাড়ি বস্তির সামনের অংশে জমছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. জামাল মোস্তফা বলেন, খালটির পানিপ্রবাহ ঠিক থাকলে মিরপুর এলাকার জলাবদ্ধতার সমস্যা অনেকটাই কমতে পারে। মেয়র আনিসুল হক এবং ওয়াসার পরিচালক ও প্রকৌশলীরা এসে খালটির অবস্থা দেখে গেছেন, কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না।
বর্ষায় জলাবদ্ধতার কারণে তো ঢাকা অচল হয়ে পড়ে। নগরবাসীর দুর্ভোগের অন্ত থাকে না। তখন অনেক আশ্বাসবাণী শোনা যায়। কিন্তু ৩২ বছরে ৩৯টি খাল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আশ্বাসবাণী কার্যকর হবে কেমন করে? খাল কিভাবে দখল হয়, নিশ্চিহ্ন হয় তাতো অজানা বিষয় নয়। এসব কাজ কারা করে তাও জানা বিষয়। তারপরও কাজের কাজটি হচ্ছে না। ভূমিদস্যু, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতাবানরা মিলেমিশেই তো ওই অপকর্ম করে যাচ্ছে। তারা ক্ষমতাবান, সে কথা আমরা জানি; কিন্তু রাষ্ট্র কি তাদের চাইতেও ক্ষমতাবান নয়? খাল-বিল, নালা-নর্দমা বন্ধ হয়ে গেলে নগরী কী করে মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে? সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছাড়া কোনো নগরী কি স্বাস্থ্যসম্মত ও আধুনিক নগরীর স্বীকৃতি পেতে পারে? এদিক থেকে তো বর্তমান ঢাকা মোগল আমলের ঢাকা থেকে অনেক পিছিয়ে গেছে। বিষয়টি কি আমাদের জন্য লজ্জাকর নয়?
রাজধানীর খাল-বিল, নালা-নর্দমা যেভাবে ভরাট হয়েছে, সেখানে কোনো কা-জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়নি। বরং লক্ষ্য করা গেছে লোভ-লালসা, ক্ষমতার দাপট ও সংকীর্ণ স্বার্থ। এমন আগ্রাসন থেকে আমাদের নদী এবং নদীতীরও রক্ষাও পাচ্ছে না।
অথচ আমরা জানি, সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে ঘিরে। প্রাত্যহিক জীবনেও নদীর গুরুত্ব অনেক। সেই নদীই ক্রমে জীর্ণশীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বলতে হয়, মানব-বান্ধব নদী আজ মানবের অযাচার-অনাচারে মরণ দশায় উপনীত হয়েছে। এমন বাস্তবতায় পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হয়েছে ‘ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের দখলে চার নদীর তীর’। ৬ আগস্ট তারিখে মুদ্রিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ঢাকার চারপাশে যে চারটি নদী রয়েছে তার তীরগুলোর বিভিন্ন জায়গা আজ অবৈধ দখলদারদের কবলে। মোট তীরভূমির পরিমাণ হলো ২২০ কিলোমিটার। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নদীর তীরভূমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা ব্যবসা পরিচালনার জন্য স্থায়ী বা পাকা কাঠামো নির্মাণ করেছেন বলে বিআইডব্লিউটিএ’র প্রকৌশল বিভাগের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রকল্পের পটভূমিতে বলেছে রাজধানী ঢাকা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী দিয়ে বেষ্টিত। অভ্যন্তরীণ নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য এসব নদীর তীরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে তিনটি অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর রয়েছে। কিন্তু নদীর তীরভূমির বিভিন্ন জায়গা অবৈধ দখলদারদের কবলে রয়েছে। তারা অননুমোদিত ও অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন সময় বিশেষ করে ২০০৭ সাল থেকে দফায় দফায় তীরভূমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু তা আবার অবৈধ দখলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে সরকারি সম্পত্তি দখলের একটা প্রবণতা রয়েছে। সংস্থাটি বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে দখলকৃত তীরভূমি উদ্ধার করলেও তা সংরক্ষণ করতে পারেনি। তা চলে গেছে আবার দখলদারদের কবলে। জানা গেছে, সংস্থাটির কোন নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী নেই। এমনকি বিশাল তীরভূমি পাহারা দিয়ে রাখার মতো পর্যাপ্ত জনবলও নেই। ফলে বিআইডব্লিউটিএ বার বার উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করেও তা সংরক্ষণে হিমশিম খাচ্ছে। এতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে প্রকল্পের আওতায় ওয়াকওয়ে বা হাঁটার পথ নির্মাণের ব্যয় নিয়ে খোদ পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তিনটি স্তরে ওয়াকওয়ে নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ব্যবধান অনেক বেশি। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্পের কাজ করবে বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পের মাটি কাটাসহ সব কাজ ঠিকাদার কর্তৃক সম্পাদন করা হবে। অথচ ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়টি এক্সকেভেটর ক্রয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি কোনভাবেই যৌক্তিক নয়। এটিকে বাদ দিতে কমিশন পরামর্শ দিয়েছে বলে জানা গেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আমাদের নদী ও নদীর তীরভূমিগুলো এখন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিসহ ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্যে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও দূষিত হচ্ছে। এছাড়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নদীর পানিপ্রবাহও। বিষয়গুলো শুধু প্রকৃতি ও জনজীবনের জন্যই হুমকির কারণ নয়, জাতীয় অর্থনীতি ও উন্নয়নের জন্যও অশনি সংকেত। এসব নিয়ন্ত্রণে এবং দুর্নীতি রোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেমন সক্ষমতা অর্জন প্রয়োজন, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকেও প্রয়োজন গভীর পর্যবেক্ষণ ও ন্যায়নিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ। সময়ের দাবি পূরণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কতটা সফল হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

http://www.dailysangram.com/post/296423-