গৃহিণী হোসনে আরা বেগম। সবুজবাগের রাজারবাগ এলাকার বাসিন্দা। মঙ্গলবার নাস্তা তৈরি করতে সকালেই ঘুম থেকে ওঠেন। সকাল ৭টার দিকে চুলাতে ম্যাচের কাঠি দিয়ে দেখেন গ্যাস নেই। তাই সকালের নাস্তা আর তৈরি করা হয়নি। শুধু হোসনে আরা বেগমই নন, রাজধানীতে অনেক এলাকায় এমন ভোগান্তিতে পড়েছেন বাসিন্দারা। দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাস থাকে না। থাকলেও চাপ কম থাকে। এতে রান্না-খাওয়ার রুটিন বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।
হোসনে আরা বেগম বলেন, অন্যদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে। আজ ৭টা বাজেই ওঠে দেখি গ্যাস নেই। প্রতিদিনই এই গ্যাসের সমস্যা। সকালে গেলে সারাদিনের মধ্যে আর গ্যাস থাকে না। রাত ১০টার পর গ্যাস আসে। সবুজবাগ থানাধীন দক্ষিণ রাজারবাগ এলাকার আরেক গৃহিণী সাজেদা বেগম জানিয়েছেন, এই এলাকার গ্যাস সংকট দীর্ঘদিনের। শীত এলে এই সংকট আরও বাড়ে। প্রতিদিন সকালে চলে যাওয়া গ্যাস আসতে আসতে রাত হয়। সংসারের রান্নাবান্না সব রাতে খুব ভোরে করতে হয়। তবে হঠাৎ হঠাৎ দুপুরে স্বল্প গ্যাস থাকে। সাজেদা বলেন, গ্যাসের এই সমস্যার জন্য সিলিন্ডার ব্যবহার করি। প্রতিদিন তো রাতে রান্না করা সম্ভব না। গ্যাসের বিলও দিতে হয়, সিলিন্ডারেও মাসে অনেক টাকা খরচ হয়।
এদিকে গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৬টা পর্যন্ত রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় গ্যাস সরবরাহ থাকবে না বলে জানায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১২ ঘণ্টা ডেমরা সিজিএস’র ডাউনস্ক্রিম গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত তিতাস গ্যাস অধিভুক্ত সমগ্র ডেমরা, মাতুয়াইল, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, রায়েরবাগ, ধোলাইরপাড়, সায়েদাবাদ, নন্দীপাড়া, খিলগাঁও, বাসাবো, মতিঝিল, রামপুরা, বাড্ডা, মালিবাগ, বনশ্রী, শাহাজাহানপুর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান, বনানী এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় বিদ্যমান সব শ্রেণির গ্রাহকের গ্যাসের স্বল্পচাপ/তীব্র স্বল্পচাপ বিরাজ করবে। এ ছাড়া কোথাও কোথাও গ্যাসের চাপ শূন্যে নেমে যেতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো এরমধ্যে অধিকাংশ এলাকাতেই নিয়মিত গ্যাস সংকট থাকে। শীতের দিন আসলে এই সংকট আরও প্রকট হয়। দিনের অধিকাংশ সময়ই গ্যাস থাকে না। কিছু এলাকায় দিনের বেলা গ্যাস থাকলেও তা দিয়ে নিভু নিভু আগুন জ্বলে। এই স্বল্প গ্যাসে রান্না করার উপায় থাকে না বলেও জানিয়েছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্র জানিয়েছে, দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এজন্য কিছু এলাকায় গ্যাস থাকে কিছু এলাকায় সংকট তৈরি হয়। এ ছাড়া অবৈধ সংযোগের কারণে ৫-৬ শতাংশ গ্যাস চুরি হচ্ছে। এতেও কিছুটা সংকট তৈরি হচ্ছে। পেট্রোবাংলা পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খান মানবজমিনকে বলেন, চাহিদা বাড়ার কারণে সংকট বাড়ছে। সংকট মোকাবিলার জন্য যদি আবাসিকে গ্যাস ব্যবহার না করা হয় তাহলে মোকাবিলা করা যায়। আবাসিকে বিশ্বের কোথাও গ্যাস ব্যবহার করা হয় না। আবাসিকের বিকল্প রয়েছে। সারা দেশে মানুষ আবাসিকের জন্য এলপিজি ব্যবহার করছে। এতে চুরি, লিকেজ, অপচয়ও কমে। শিল্পে গ্যাস ব্যবহার হয়। সেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত।
লালবাগের বাসিন্দা হাবিবুল্লাহ রনি। তার এলাকায় সকাল ৮টা বাজলেই গ্যাস চলে যায়। আসে রাত ১১টার পর। রনি বলেন, পুরো পুরান ঢাকাতেই গ্যাসের এমন অবস্থা। রাতে গ্যাস আসার পর রান্না করলে খেতে রাত ১টা বেজে যায়। এজন্য সিলিন্ডার কিনে নিয়েছি। মাসে ১৫০০ টাকার মতো সিলিন্ডার ব্যবহারে খরচ হয়। কোনো মাসে আরও বেশি হয়। টিকাটুলির বাসিন্দা খাদিজা রাইসা। দুই মাস ধরে গ্যাস সংকটে ভোগান্তিতে রয়েছেন তারা। রাইসা বলেন, সকাল ৯টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। এরপর আসলেও চাপ কম থাকে। বিকালের পর একটু ভালো হয়। পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসিন্দা মনোয়ার বলেন, আমাদের এদিকে গ্যাস থাকে না। শুধু আমাদের বাসায় নয়, শিয়া মসজিদের ঢালের দিকেও ভোর পাঁচটা থেকে গ্যাস থাকে না। গ্যাস আসে রাত ১১টার দিকে। দিনে যদি গ্যাস আসেও তাতে রান্না করা যায় না। ইলেকট্রিক কুকার বা অন্যান্য মাধ্যমে খাবার রান্না করতে হচ্ছে আমাদের। তেজকুনিপাড়ায় রুবাইয়া আক্তার বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গ্যাসের সংকট। নিভু নিভু গ্যাস থাকলেও রান্না করাটা খুবই মুশকিল। শুক্রবারে খুব ভোগান্তি।
রাজধানীর শাহাজাদপুর এলাকাতে ৬ মাস ধরে গ্যাসের সংকটে ভোগান্তি পোহানোর কথা জানিয়ে মরিয়ম বলেন, শাহাজাদপুর থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত পুরো এলাকায় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গ্যাস একদম অল্প থাকে। এই গ্যাসে আগুন ধরিয়ে পানি গরম করতে গেলেও তিন ঘণ্টা লাগে। দুপুরের খাবার, সকালের খাবার কোনোটাই তৈরি করা যায় না। আমাদের যা কাজ করতে হয় তা রাতে করতে হয়। এটা অনেক ভোগান্তির। বনানীর বিটিসিএল কলোনীর বাসিন্দা পাপলু রহমান বলেন, আমাদের এলাকায় গ্যাস মোটেও থাকে না। সম্প্রতি বনানীতেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এখন অবস্থা একেবারেই খারাপ। রাত ১০টার দিকে গ্যাস আসে সকাল ৪টা থেকে ৫টার দিকে চলে যায়। রাতেই রান্না করা হয়। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারাও গ্যাস সংকটে ভুগছেন। ওই এলাকার বাবর রোডে জহুরী মহল্লার বাসিন্দা ইয়াসিন আরাফাত তুষার বলেন, ফজরের পরে গ্যাস চলে যায়। রাত ১১টার পরে আসে। ১২ থেকে ১৩ দিন হলো এই সমস্যা বেশি হচ্ছে। বাধ্য হয়ে আমি নিজে বাইরে খেতে বাধ্য হচ্ছি। মিরপুর ১২ নম্বরের ‘ধ’ ব্লকে থাকেন শান্তা হক। তিনি বলেন, সকাল ৮টা থেকে দুপুর ৩-৪টা পর্যন্ত খুবই কম মাত্রায় গ্যাস থাকে। ৪টার পরে একটু নিভু নিভু করে আসে। দুপুরে একেবারেই থাকে না বললেই চলে। গ্যাসের লাইন ঠিকঠাক হলে সন্ধ্যার সময় রান্না করি। কদমতলী থানায় বাসিন্দা সৈয়দ মাহমুদুল কবির বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পুরো কদমতলী থানার কোথাও কোনো গ্যাস থাকে না। ১৫ থেকে ১৬ দিন যাবত এমনটা হচ্ছে। সকাল ৬টা বাজে গ্যাস একবারে চলে গিয়ে বিকাল ৩টার দিকে আসে। বিদ্যুৎচালিত ইন্ডাকশন চুলায় রান্না করতে হয়। মগবাজার এলাকার চেয়ারম্যান গলির বাসিন্দা লিমা সুলতান বলেন, কয়েকদিন থেকে বাসায় গ্যাসের সমস্যা করছে। একদম সকালের দিকে চলে গিয়ে দুপুরে ২টা থেকে ৩টার দিকে আসছে। প্রায় ৪ থেকে ৫ দিন যাবত এই সমস্যায় ভুগছি। গ্যাস এলে দুপুরে তখন রান্না করা হয়। মধ্যবাড্ডা এলাকার বাসিন্দা গাজী আসাদুজ্জামান বলেন, ভোর ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে বাসার গ্যাস চলে যায়। দুপুরের দিকে অল্প একটু আসে। সারাদিনে অল্পমাত্রায় গ্যাস পাওয়া যায়। যা দিয়ে রান্না করা সম্ভব হয় না। ১৫ দিন হলো এই সমস্যায় ভুগছি। রাতেও গ্যাসের চাপ কম থাকে। রমনা থানায় অবস্থিত পূর্ব নয়াটোলা এলাকার বাসিন্দা এজাজ রসুল সোহেল বলেন, ১৫ থেকে ২০ দিন যাবত আমাদের এলাকার বাসিন্দারা গ্যাস সংকটে ভুগছে। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত কোনো গ্যাস থাকে না। নিভু নিভু অবস্থায় আসে। আর কতোদিন এভাবে থাকতে হবে জানি না। মীরবাগ ও মধুবাগেও একই অবস্থা।
গ্যাস সংকটের কারণ জানিয়ে তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহনেওয়াজ পারভেজ মানবজমিনকে বলেন, বিগত ৬ মাস ধরে নিয়মিত গ্যাসের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। শীতকালে গ্যাসের চাপ কম থাকে। শিল্পাঞ্চলগুলো যখন সচল থাকে তখনো বাসাবাড়িতে গ্যাসের চাপ কম থাকে। এ ছাড়া আমাদের গ্যাসের লাইনগুলো পুরাতন। ছোট ছোট ছিদ্র আছে। এতেও চাপ কমে যায়। বর্তমানে গ্যাস সংকটের বাস্তব কোনো সমাধান দেখেন না বলেও জানান তিতাস এমডি। বলেন, আমাদের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাই না। যতটুকু পাই সেটার আবার বরাদ্দ থাকে বিদ্যুতে, সারে, শিল্পে ও আবাসিকে। আমাদের যেমন শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে হয় তেমন আবাসিকও ঠিক রাখতে হচ্ছে। এখন উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন কূপ খনন করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার ১০০টা কূপ খনন করার পরিকল্পনা করেছে। এগুলো হলে আমরা সরবরাহ বাড়াতে পারবো।