২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অধ্যাদেশে বড় পরিবর্তন

মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারবে এমন বিধানসহ ২০টি সংশোধনী এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৪ এর খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।

বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধীন অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন প্রণয়ন করা হয়। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধি এর সঙ্গে সামঞ্জস্যতা আনয়ন, আন্তর্জাতিক আইনের প্রচলিত বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং এই আইনের বিচারকাজ নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন কর্তৃক উত্থাপিত বিভিন্ন সুপারিশের আলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ এর অধিক সংশোধন সমীচীন ও আবশ্যক।
এ প্রেক্ষাপটে আইন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহের সংজ্ঞা যুগোপযোগীকরণ, অপরাধের দায় নির্ধারণ, অডিও এবং ভিডিওর মাধ্যমে বিচারকাজ ধারণ ও সম্প্রচার, বিদেশি কাউন্সিলের বিধান, বিচারকালে অভিযুক্তের অধিকার, অন্তবর্তীকালীন আপিল, সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা সংক্রান্ত বিধান, তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক তল্লাশি ও জব্দ করার বিধান, পর্যবেক্ষক, সাক্ষীর সুরক্ষা, ভিকটিমের অংশগ্রহণ ও সুরক্ষার বিধান সংযোজন করে এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়।

তিনি বলেন, খসড়া নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগ, দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, মানবাধিকার কর্মী, মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ এবং অংশীজনের সঙ্গে বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাদের মতামত ও পরামর্শ পর্যালোচনাপূর্বক আইন ও বিচার বিভাগ কর্তৃক প্রণীত খসড়ায় সংযোজন ও পরিমার্জন করা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যেহেতু সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় রয়েছে এবং গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের আওতাধীন অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন যুগোপযোগীকরণের বিষয়ে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে সেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৪ শীর্ষক অধ্যাদেশের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদের নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়। আজ উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে খসড়াটি লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়েছে।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় ফরেন সার্ভিস একাডেমীতে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে আসেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সঙ্গে ছিলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূইয়া, মাহফুজ আলম এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

আইন উপদেষ্টা জানান, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ এটার সংশোধন করা হয়েছে। এই সংশোধন করার প্রয়োজন আমরা অনুভব করেছি। কারণ বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এই আইনে যখন বিচার করা হয়; তখন এই আইনের বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে অনেক সমালোচনা করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, দেশীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররা অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি তুলে ধরেছিলেন। আমরা যেহেতু চেয়েছি খুব ফেয়ার ট্রায়াল করতে; যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে চলতে, এজন্য আমরা সেই তাগিদ থেকে অ্যামেন্ডমেন্ট(সংশোধন) করার উদ্যোগ নেই। এবং উদ্যোগ গ্রহণ করার পর্যায়ে আমরা যতটা ব্যাপক সম্ভব মানুষের মতামত নিয়েছি। আপনারা অনেকেই ছিলেন। আমরা একটা ব্রড কনসালটেশন (ব্যাপক আকারে পরামর্শ) করেছিলাম। সেখানে আমাদের আরও দুই উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। হাসান আরিফ স্যার ও আদিলুর রহমান খান। আমাদের দেশের যত আইন বিশেষজ্ঞ আছেন, মানবাধিকার কর্মী আছেন, সাংবাদিক আছেন। আমরা ৫০ থেকে ৬০ জনকে আমন্ত্রণ করেছিলাম। তারা এসেছিলেন। ড্রাফটের ওপর ওনাদের মতামত গ্রহণ করেছি আমরা। দেশী বিদেশী প্রসিদ্ধ আইনজীবী, হিউম্যান রাইটস ওর্গানাইজেশনের কাছে পাঠিয়েছি, জাতিসংঘের যে হিউম্যান রাইটসের যে ফোরাম রয়েছে সেখানেও পাঠিয়েছি, সকলের মতামতের ভিত্তিতে আমরা ড্রাফট করেছি; করার পর উপদেষ্টা পরিষদে উত্থাপন করা হয়েছিল মতামতের জন্য। এটা গৃহীত হয়েছে। তবে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদে। উপদেষ্টা পরিষদ মনে করেছে --- আমরা যে অ্যামেন্টমেন্টটা (সংশোধনটা) করেছিলাম আইনের অ্যামেন্টমেন্ট -- অর্গানাইজেশনকে শাস্তি দেওয়ার বিধানটা ছিল এবং আমাদের প্রস্তাবিত অ্যামেন্টমেন্টে বলা হয়েছিল, যদি কোন অর্গানাইজেশনকে যদি শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে, যদি মনে করে শাস্তি দেওয়া দরকার, তাহলে ট্রাইব্যুনাল শাস্তি দেওয়ার সুপাশি করতে পারবে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে।

তিনি বলেন, আজকে আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের আলোচনাতে বলা হয়েছে, বিচারকে অন্যকোন বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত করতে চাই না। রাজনৈতিক দল বা কোন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন আসলে, এই আইনকে অযথাই প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আমরা সেই সুযোগ দিতে চাই না। আমরা একদম সঠিকভাবে বিচারটা করতে চাই। এজন্য এই প্রবিশনটা বাতিল করা হয়েছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে আরেকটা বিষয় আমরা লুক আউট করেছি, যদি কোন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের জন্য যদি নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হয়; যদি নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে সমাজে, তাহলে আমাদের অন্যান্য আইন রয়েছে, সে সমস্ত আইনে নিষিদ্ধ করার বিধান রয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইনে রয়েছে নির্বাচনী আইনে রয়েছে, ১৯৭৮ পলিটিক্যাল পার্টি অর্ডিন্যান্সে রয়েছে। কাজেই এখানে এই বিধানটা নাই দেখে সেই সুযোগ জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই ধরণের পদক্ষেপ নেওয়ার আর সুযোগ থাকলো না; সেটা না। যুদ্ধাপরাধ বিচার আইনে থাকলো না। কিন্তু অন্যান্য প্রচলিত আইনে দেশে রয়েছে। সেটা আমরা রাজনৈতিক অঙ্গনে যদি গণ দাবি আসে তাহলে আমরা পরে বিবেচনা করবো। এটা এই আইনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয় না।

আইন উপদেষ্টা জানান, এই আইনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে- যেমন ক্রাইম অ্যাগেন্সট হিউমিনিটি এটার ডেফিনেশন, জেনোসাইডের ডেফিনেশন, এটা আমরা রোম স্ট্যাটিউট অবলম্বনে করেছি। যে রোম স্ট্যাটিউডে বাংলাদেশ পক্ষ রাষ্ট্র রয়েছে। সেটা অবলম্বনে করেছি। একদম আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে আমরা ডিফাইন করেছি। আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিধান হচ্ছে এই আইনে যারা অভিযুক্ত পক্ষ আছে-তাদেরকে প্রসিকিউসনের সমান সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত পক্ষকে অনেক বেশি সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে তারা যেকোন সংখ্যক সাক্ষ্য আনতে পারবে। যেকোন সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে। অনেক বেশি বাড়ানো হয়েছে। আরেকটা চমৎকার বিধান, আমরা মনে করি- ভিকটিম প্রটেকশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা এখানে সাক্ষী দিতে আসবেন অথবা ১৬৪ বা যেকোনভাবেই সাক্ষ্য দেন; তাদের পটেকশনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই আইনে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরকে কমপেনসেশন বা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। এবং এই আইনে আরেকটা বিধান করা হয়েছে যে, আমাদের ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছা পোষণ করলে ম্যানডেটরি না (বাধ্যতামূলক না) এই বিচারকার্যটা অডিও ভিডিও রেকর্ডিং করতে পারেন। ওনার যদি মনে করে এটা প্রচার করা দরকার, বা কোন অংশ প্রচার করা দরকার, সেটা প্রচার করবেন। কিন্তু যে পক্ষগুলো আছে, তাদের যে ডিগনিটি তাদের প্রাইভেসি, তাদের যে অধিকার সেদিকে নজর রেখে এটা করা হবে। এই ছিল মোটামুটি বিধান। এখানে আমরা ডেফিনেশনটা খুব ক্লিয়ার করেছি। এখানে তিন ধরনের বাহিনীর বিচারের আওতায় আনার বিধান করা হয়েছে। একটা হচ্ছে ডিসিপ্লেন ফোর্স, আরেকটা হচ্ছে ইনটেলিজেন্স এজেন্সি, আরেকটা হচ্ছে অগজিলারি ফোর্স। এটাকে আমরা খুব ভালো করে ডিফাইন করেছি। আমাদের সংবিধান ও প্রচলিত মানবাধিকার আইনগুলো দেখে আমরা ডিফাইন করেছি। উপদেষ্টা পরিষদে খসরা গৃহীত হয়েছে। গ্যাজেট আকারে প্রকাশিত হলেই তা আইনে পরিণত হবে। আর কিছু বিষয় আগে থেকেই জানেন, এই আইনে বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের বিধান আছে। প্রসিকিউশন ডিফেন্স যে কেউ ইচ্ছা করলে ফরেন ল.ইয়ার নিয়োগ করতে পারবে। আরেকটা চমৎকার বিধান রয়েছেÑ অবজারভারের বিধান। আন্তর্জাতিক বা দেশী সংস্থা যে চায়, বিচার শুদ্ধভাবে হচ্ছে কি-না উনারা উপস্থিত থেকে মনিটরিং এর কাজ করতে পারবে। আমাদের অল আউট একসেস দেওয়া আছে।

https://dailysangram.info/post/573540