১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৪

সরকারি গাড়ির অপব্যবহার ঠেকানো যাচ্ছে না

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে অনমনীয় নীতির হুঁশিয়ারি

সরকারি গাড়ির অপব্যবহার ঠেকানো যাচ্ছে না। এক শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রাধিকার না হয়েও যথেচ্ছভাবে সরকারি গাড়ি নিজে ও পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যবহার করছেন। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো কর্মকর্তা সরকারি ঋণে গাড়ি কিনেছেন, সেই গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকার সরকারের কাছ থেকে নিচ্ছেন। কিন্তু সেই গাড়ি নিজে ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবহার করছেন। বিনা সুদে সরকারি ঋণের টাকা কেনা গাড়ি তারা ভাড়ায় (উবার) দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকরের পক্ষ থেকে এ সব সরকারি চাকুরেদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যলয় থেকে সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে সংশ্লিষ্টদের জন্য ‘অনমনীয় নীতি’ গ্রহণ করা হবে বলে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয় থেকে এই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘এই মর্মে সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের বেশ কিছু কর্মচারী প্রচলিত বিধি ও প্রাধিকার বহির্ভূতভাবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রণালয়/ বিভাগ কর্তৃক যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই বিভিন্ন দফতর/ অধিদফতর/ সংস্থা/ ব্যাংক-বীমা/ কোম্পানি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান হতে অধিযাচন করে গাড়ি আনা হচ্ছে।
এ ছাড়াও প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা-২০২০’ এর আওতায় গাড়ির ঋণ সুবিধাপ্রাপ্ত কোনো কোনো কর্মকর্তা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাবদ সমুদয় অর্থ (৫০ হাজার টাকা) নেয়ার পরও অনৈতিক ও বিধি বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবহার করছেন। অথচ উক্ত নীতিমালার ১৭ অনুচ্ছেদে এরূপ অনিয়মের বিষয়টি বিরত করার পাশাপাশি সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ’

নির্দেশনায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের কিছু কর্মচারীর প্রাধিকার বহির্ভূত গাড়ি ব্যবহারের এরূপ প্রবণতার ফলে একদিকে যেমন প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা ও আর্থিক অপচয় ঘটছে, অন্য দিকে তেমনি নৈতিকতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে সমাজে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সরকারের দায়িত্ব সচেতনতা সম্পর্কে জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার এ ধরনের বিষয়ে অনমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে।

বর্ণিতাবস্থায়, তার মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং আওতাধীন দফতর/সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের প্রাধিকার বহির্ভূত গাড়ি ব্যবহার কঠোরভাবে বারিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

জানা গেছে, এই নির্দেশনা দেয়ার পর সরকারে বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর, মন্ত্রণালয়, সংস্থার পক্ষ থেকে সরকারি গাড়ি অপব্যবহার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা গতকাল এই প্রতিবেদকে বলেছেন, প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়িসেবা নগদায়ন নীতিমালা, ২০২০ (সংশোধিত)’ অনুযায়ী, গাড়ি সুবিধার প্রাধিকারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলতে বোঝাবে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সুপারিশ ক্রমে সরকারের উপসচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়ে কমপক্ষে তিন বছর অতিক্রম করেছেন এমন কর্মকর্তা, সরকারের যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব, সচিব/সিনিয়র সচিব।

এই নীতিমালার আওতায় কর্মকর্তাদের গাড়ি কেনার জন্য সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা সুদবিহীন ঋণ দেয়া হচ্ছে ২০২০ সাল থেকে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এই ধরনের সুবিধার প্রচলন করে গেছেন। কারণ গত ১৫ বছর যে সরকার ক্ষমতায় ছিলেন তাদের জনগণের ভোটের কোনো দরকার ছিল না। তাদের দরকার ছিল প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন। তাই সরকারের এই তিন অঙ্গের চাকুরেদের খুশি করার জন্য এই ধরনের ‘ঘুষ’র এ ব্যবস্থা করেছিলেন।

সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা দেয়ার পরও গাড়ির জ্বালানি তেল, ড্রাইভারের বেতনসহ রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাবদ প্রতি মাসে গাড়ির মালিকদের আরো ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কর্মকর্তাদের অনেকেই এই গাড়ি ব্যবহার করছেন পারিবারিক কাজে। নিজে অফিসের গাড়ি ব্যবহার করেও তুলে নিচ্ছেন রক্ষণাবেক্ষণের পুরো টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যেসব মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পের সংখ্যা বেশি সে সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি গাড়ি অপব্যবহার বেশি করেন। তারা এসব গাড়ি পারিবারিক কাজে ব্যবহার করে থাকেন। এ অনিয়মের সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক, সেতু ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বিভিন্ন প্রকল্পের গাড়ি তারা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করছেন। এসব গাড়ি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা স্ত্রীরা বাজার করতে যাচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে নেয়া-আনার কাজেও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে।

এই অনিয়ম দূর করার জন্য এর আগে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর, ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর এবং ২০২০ সালে ৮ মার্চ সতর্ক করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাছে চিঠি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এই অনিয়মের কথা জানিয়ে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকেও চিঠি পাঠানো হয়েছিল।

সেই চিঠিতে বলা হয়েছিল ‘বর্তমানে লক্ষ করা যাচ্ছে যে, ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা, ২০২০ (সংশোধিত)’-এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু কিছু কর্মকর্তা সুদমুক্ত ঋণের গাড়ি ব্যবহার না করে মন্ত্রণালয় বিভাগের অধীন অধিদফতর, সংস্থা ও উন্নয়ন প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করে অফিস যাতায়াতসহ পারিবারিক কাজে ব্যবহার করছেন। অন্য দিকে কিছু কিছু কর্মকর্তা সরকারি গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই গাড়ি ব্যবহার না করে গাড়ি সেবা নগদায়নের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়বাবদ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করছেন। এতে সরকারের জ্বালানি ও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।’ চিঠিতে আরো বলা হয়, এ বিষয়টি রোধে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতে ও সরকারি গাড়ি অপব্যবহার থেকে বিরত রাখতে ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালা, ২০২০ (সংশোধিত)’ জারি করা হয়েছে। এ নীতিমালার ব্যত্যয়ে ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী অসদাচরণ বলে গণ্য হবে বলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি ও সরকারি যানবাহনের অপব্যবহার রোধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চারটি নির্দেশনা দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, নীতিমালা অনুযায়ী ১০০ শতাংশ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় গ্রহণের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অধীনস্ত দফতর/সংস্থা/উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন ব্যবহার করা যাবে না। কর্মস্থলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সুদমুক্ত ঋণের অর্থে কেনা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অধীন দফতর/সংস্থা/উন্নয়ন প্রকল্পের যানবাহন ব্যবহার করা ‘অসদাচরণ’ বলে গণ্য হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

এতে আরো বলা হয়, এর ব্যত্যয় হলে ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী অসাদাচরণ হিসেবে গণ্য করা বলে ‘প্রাধিকারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি সেবা নগদায়ন নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এরপর সরকারি চাকুরেদের গাড়ি অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়নি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/863290