৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১১:৩৭

সরকার অচলের ষড়যন্ত্র

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে ভারত গেলেও পতিত শেখ হাসিনার দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র থেমে নেই। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের গোয়েন্দা বাহিনী ‘র’ মদদে হাসিনা নির্দেশনা দিচ্ছেন আর তার নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে অবস্থানরত তাঁবেদাররা বিভিন্ন সেক্টরে নানা ফর্মেটে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে অচল করার সর্বশেষ ট্রাম্প কার্ড গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতাকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। নানা দাবি-দাওয়ার অজুহাত তুলে শ্রমিকদের কারখানা থেকে রাজপথে নামিয়েছে এবং শ্রমিকদের আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বাইরে থেকে মাস্তান ঢুকিয়ে জাহাঙ্গীর বাহিনী তাণ্ডব-ভাঙচুর চালাচ্ছে। তবে গার্মেন্টস মালিক ও শ্রমিকরা বলছেন, তারা হাসিনার পাতানো ফাঁদে কোনোভাবেই পা দেবেন না। ইতোমধ্যে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা কামনা করেছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর দেশের দ্বিতীয় বিজয় উদযাপনের এক মাস হবে আজ। গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পলায়নের পর দ্বিতীয় স্বাধীনতার ১ মাস উপলক্ষে সারাদেশে শহিদী মার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। স্বৈরাচার হাসিনা দিল্লিতে থেকেই এক মাস ধরে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আর ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছে হাসিনার দোসর ভারত। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে শুরুতে জুডিশিয়্যাল ক্যু, সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা প্রচারণা, ১৫ ও ২১ আগস্টে ঢাকায় ১০ লাখ লোকের সমাগম করে সরকারকে ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র, সরকারি কর্মচারীদের দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে রাস্তায় নামিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও আনসার বাহিনী দিয়ে সচিবালয় ঘেরাও ষড়যন্ত্রে সফল হতে না পেরে এখন সর্বশেষ শ্রমিকদের দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সরকার অচল করে দেয়ার অপচেষ্টায় নেমেছে। ঢাকার সাভার, গাজীপুরের ওষুধ ও গার্মেন্টস কারখানা বন্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে শেখ হাসিনা এবং তার রাজনৈতিক মুরুব্বী ভারতীয় এজেন্টরা। তারই সর্বশেষ অপচেষ্টা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিক্ষোভ। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে রয়েছে গাজীপুর সিটির সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বাহিনী গাজীপুর-আশুলিয়া ও টঙ্গীতে তাণ্ডব চালিয়েছে। ৫ আগস্টের আগে হত্যা-খুনে মেতে উঠেছিল জাহাঙ্গীর বাহিনী। তারই পৃষ্ঠপোষকতায় এখন শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর নানামুখী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বর্তমান সরকারকে ফেলে দিতে ভারত একের পর পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু কোনোভাবেই কিছু হচ্ছে না দেখে এবার শ্রমিক অসন্তোষে লিপ্ত হয়েছে। অসন্তোষ তৈরি করে দেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাতকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সময়ে যারা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিগত হিসাব ও বিদেশযাত্রা বা অন্য কোনো উপায়ে ব্যবস্থা নেয়া যাতে পারে। তবে কোনোভাবেই যাতে ওই সব ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষতি না হয়। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিকের জীবন ও পরিবার নির্ভরশীল। তাই অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এ দিকটায় খেয়াল রাখতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. আবু আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের মতো ইস্যু দিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই সফল হবে না। ভারত বা অন্য কারো উস্কানি থাকলেও ছাত্র-জনতার এই অর্জনকে কোনোভাবেই অন্য খাতে প্রবাহিত করতে পারবে না, যা সম্ভবও নয়। তিনি বলেন, আমাদের দেশের শ্রমিকরা আন্দোলনপ্রিয়। অনেক দিন পর স্বাধীনতা পেয়েছে তাই হয়তো আন্দোলন করেেছ। এর মাধ্যমে শ্রমিকরা তাদের নিজেদের ইমেজ নিজেরাই নষ্ট করছে। শ্রমিকরা যে ভুল করছে খুব শিগগিরই তারা তা বুঝতে পারবে।

গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে নানামুখী ষড়যন্ত্রে সফল হতে না পেয়ে এবার শমিক অসন্তোষের মাধ্যমে দেশের শ্রমঘন শিল্প এবং রফতানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক খাতকে টার্গেট করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্বে অল্প দিনেই দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও শিল্প গ্রুপের পাচারের অর্থ ফেরতের আশ্বাস এসেছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলো বড় অঙ্কের অর্থ সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ৫৭ বাংলাদেশির শাস্তি মওকুফ করেছে। রেমিট্যান্সে গতি ফিরেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। প্রশাসনের কার্যক্রমে গতি ফিরেছে, আইন-আদালত নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী চলছে। অপরদিকে দেশের আর্থিক খাতে সুশাসন-জবাবদিহিতা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিয়ে নতুন বোর্ড গঠন করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে স্বাভাবিকতা ফিরেছে এবং গ্রাহকের আস্থা বাড়ছে। শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে। হাসিনা রেজিমের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের মেয়াদ ১ মাস হতে না হতেই দেশ উন্নয়ন মহাসড়কে ফিরেছে। আর তাই ষড়যন্ত্রকারীরা আনসার বিদ্রোহে সফল হতে না পেরে এখন শ্রমিক অসন্তোষের মাধ্যমে সরকারকে ব্যর্থ করার নতুন মিশনে নেমেছে।

এদিকে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তৈরী পোশাক কারখানাগুলোতে যে শ্রমিক অসন্তোষ এবং বিশৃঙ্খলা করছে এর সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগই বহিরাগত। যদিও ইতোমধ্যে বিষয়টিকে কঠোর হাতে দমনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন একাধিক উপদেষ্টা। গতকাল তৈরী পোশাক শিল্প খাত ও শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন উপদেষ্টারা। তারা ভারতীয় ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান গ্রহণের কথা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে গার্মেন্টস মালিক ও প্রকৃত শ্রমিকদের দিল্লির ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা না দেয়ার আহবান জানিয়েছেন।

আবশ্য পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলেছে, তারা কারো ফাঁদে পা দেবে না। আজ বৃহস্পতিবার থেকে বন্ধ কারখানাগুলো আবার খুলে দেয়া হবে। গতকাল শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে সাভারের আশুলিয়ায় প্রায় ৮০টি গার্মেন্টস কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল।

গতকাল তৈরী পোশাক শিল্পখাত ও শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে জরুরি বৈঠক শেষে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, সাভারের আশুলিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষে জড়িত বেশিরভাগই বহিরাগত। দেশের অর্থনীতি ও শ্রমিকদের রক্ষায় কঠোর অবস্থান নেয়া হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ার করেছেন। তিনি বলেন, প্রকৃত শ্রমিকরা এ ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। যেখানে তার জীবিকা, সেখানে সে (শ্রমিক) ধ্বংস করবে না। আপনারা খেয়াল করে থাকবেন, যেগুলো ভাইব্রেন্ট (গুরুত্বপূর্ণ) কারখানা, কুমিল্লায় প্রাণ কোম্পানির কারখানা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রাণ কোম্পানিতে কোনোদিন শ্রমিক বিশৃঙ্খলা ছিল না। কিন্তু এই কোম্পানি যেহেতু দিনকে দিন বিশ্ব ছেয়ে ফেলছে, তাহলে এটা যদি নষ্ট হয়, তাহলে এ খাতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বন্ধ হয়ে যাবে। শ্রমিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনারা (শ্রমিকরা) বাধা দেন, আপনারা বাধা দিলে আমরাও আপনাদের সঙ্গে থাকব। এমনভাবে তারা মিশে আছে যে, তাদের সেগরিগেট (আলাদা) করা ডিফিকাল্ট (কঠিন) হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, স্থানীয় কারখানা নষ্ট হয়ে যাবে, তাহলে কার লাভ হবে? কাজেই শ্রমিকরা কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অ্যাকশন (পদক্ষেপ) শুরু হবে জানিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে আমরা মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে একাধিক সভা করেছি। সকল শ্রমিক নেতাদের কাছ থেকে আমরা এটাই জানতে পেরেছি, এখন যে আন্দোলনগুলো হচ্ছে, শ্রমিক নেতারা এই আন্দোলনের প্রকৃতিটা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ এখানে কোনো নির্দিষ্ট দাবি ও নির্দিষ্ট দফা পাওয়া যাচ্ছে না। যারা সাধারণত শ্রমিক আন্দোলনগুলো করে থাকেন, তারাও সেখানে সেভাবে নেই। বহিরাগত লোকজনের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় মালিকপক্ষ বেতন দিতে দেরি করছে, এজন্য আন্দোলন হচ্ছে। কয়েকটি স্পেসিফিক ফ্যাক্টরি আছে সেখানে মালিকপক্ষ পালিয়ে গেছেন। সেখানে কিছুটা অসন্তোষ হয়েছে। শ্রমিক নেতারাই আমাকে বললেন যে, তারা দেখেছেন যে হেলমেট ও হাফপ্যান্ট পরা যারা টোকাই, যাদের টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য ভাড়া করা হয়, তাদের সেখানে দেখা গেছে।

জানতে চাইলে তৈরী পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপাকে ফেলতে নানামুখী অপতৎপরতা চলছে। বহিরাগতদের দিয়ে কারখানায় অস্থিরতা ছড়ানো হচ্ছে। তবে এটি সফল হবে না। আমাদের পোশাক খাতে অস্থিরতা মানেই ভারতের পোয়াবারো। ওদের ব্যবসা বাড়বে। ইতোমধ্যে ভারত সরকার পোশাক খাতের ব্যবসা বাড়াতে নানা প্রণোদনা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে। বর্তমান অস্থিরতায় ভারতের ইন্ধন আছে কি না তা আশা করি আমরা দ্রুতই বের করতে পারব।

https://dailyinqilab.com/national/article/683828