২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৯:৫৭

হার্টের রিং : আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে এক্সেসরিজ

সরকার কিছুসংখ্যক করোনারি স্ট্যান্টের (হার্টের রিং) দাম নির্ধারণ করলেও এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আসেনি রিং বাণিজ্য। রিং লাগানোর প্রয়োজনীয় এক্সেসরিজ বিক্রি হচ্ছে আগের দামেই। দাম নির্ধারণের পর জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে রোগীদের রিং পরানোর হার অনেক কমে গেছে। কিছুদিন আগেও যেখানে গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ জন রোগীর রিং পরানো হতো সেখানে বর্তমানে লাগানো হচ্ছে ৪ থেকে ৫ জনের। অথচ ঘটনা উল্টো হওয়ার কথা ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হৃদরোগ হাসপাতালের একাধিক কার্ডিওলজিস্ট যুগান্তরকে জানান, সরকারিভাবে হার্টের রিংয়ের মূল্য নির্ধারণের পর কতিপয় চিকিৎসক এ কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। নির্ধারিত দামে রিং বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা চিকিৎসক ও টেকনোলজিস্টদের আগের মতো কমিশন দিতে পারছেন না। এটিই তাদের নিরুৎসাহের প্রধান কারণ। হৃদরোগ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দাম নির্ধারণের পর রোববার হাসপাতালের ৫টি ক্যাথল্যাবে সারা দিনে মাত্র ৩ জন রোগীর হার্টে ৪টি রিং পরানো হয়। ৩ নম্বর ক্যাথল্যাবে ২ জন রোগীর হার্টে ২টি এবং ৫ নম্বর ক্যাথল্যবে ১ জন রোগীর হার্টে ২টি রিং লাগানো হয়। সোমবার লাগানো হয় ৪টি রিং। এর পরদিন মঙ্গলবার ৬টি এবং বুধবার ৮টি রিং লাগানো হয়।
নাম প্রকাশ না করে চিকিৎসকরা জানান, সপ্তাহ দেড়েক আগেও সরকারি বিশেষায়িত এ হাসপাতালের ৫টি ক্যাথল্যাব একদিনের জন্যও ফাঁকা থাকত না। হার্টব্লকে আক্রান্ত রোগীদের ক্যাথল্যাবে রিং লাগানোর জন্য সিরিয়াল দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হতো। চিকিৎসকদের মধ্যেও ক্যাথল্যাব পাওয়া নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। কিন্তু হঠাৎ করে চিকিৎসকদের উৎসাহে ভাটা পড়েছে। তারা জানান, নির্ধারিত দাম আগের চেয়ে কম হওয়ায় কমিশন অনেকটাই কমে গেছে। তাই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে সরকারি উদ্যোগে রিংয়ের দাম কমানো হলেও এখন পর্যন্ত আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে রিং লাগাতে প্রয়োজনীয় এক্সেসরিজ। বিশেষ করে ওয়্যার, বেলুন এবং রক্তনালি প্রসারণকারী ওষুধ। চিকিৎসকরা জানান, একজন রোগীর হার্টে রিং পরাতে হলে কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার এক্সেসরিজ প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে একটি বেলুনের দাম পড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, ওয়্যারের দাম ৭ হাজার টাকা এবং ওষুধের দাম পাড়ে ১৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। চিকিৎসকরা মনে করেন রিংয়ের মতো এসবের দামও কমানো সম্ভব।
এদিকে হৃদরোগ হাসপাতালের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দাম নির্ধারণের পরও থেমে নেই কমিশনভোগী চক্র। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই এ হাসপাতালে আবারও চুপিসারে শুরু হয়েছে রিং বাণিজ্য। বুধবার একজন সহযোগী অধ্যাপক দু’জন রোগীকে দুটি রিং পরান। এর মধ্যে ১টা অ্যাবোর্ট জে-৯। যার বর্তমান দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা। অথচ দাম নির্ধারণের আগে ছিল ৯০ হাজার টাকা। অপরটি একই কোম্পানির জেইএক্স সিরিজের। এটির দাম ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। অথচ আগে দাম ছিল ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। একই মানের কমদামি রিং না পরিয়ে ওই চিকিৎসক রোগীকে এই রিং কিনতে বাধ্য করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, রিংয়ের দাম নির্ধারণের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুটি টিম গঠন করা হয়েছে। টিম দুটি রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখছে নতুন মূল্য তালিকা টানানো হয়েছে কিনা, নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে পোস্টার সাইজের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এটা সম্পন্ন হলে সব হাসপাতালের দর্শনীয় স্থানে টানিয়ে দেয়া হবে।
কিছু অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কিছু অনিয়মের তথ্য আমাদের কাছেও আছে। যেহেতু কিছু দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ দীর্ঘদিন এই অপচর্চা করে আসছে, তাই তাদের থামাতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে নিয়ন্ত্রণে আসতে হবেই।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর নির্ধারিত বর্তমান মূল্য তালিকায় দেখা যায়, এখানে সর্বনিন্ম দাম ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৯৪৬ টাকা ২৪ পয়সা এবং সর্বোচ্চ এক লাখ ৪৯ হাজার ৪৮৮ টাকা ৭০ পয়সা। মূল্য নির্ধারণের আগের তালিকা ও পরের তালিকা থেকে দেখা যায়, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এশিয়া প্যাসিফিক মেডিকেলস লি. মূল্য নির্ধারণের আগে কোরোফ্লিক্স রিং বিক্রি করত ৮০ হাজার টাকা। মূল্য নির্ধারণের পর এর দাম ধরা হয়েছে ৭৩ হাজার ১২৫ টাকা ৬৫ পয়সা। একইভাবে মেসার্স ইউনিমেড লি. আল্টিমাস্টার (ডিইএস) রিং বিক্রি করত ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। মূল্য নির্ধারণের পর দাম হয়েছে ৬১ হাজার ৯০০ টাকা। লাইফলাইন ইন্টারন্যাশনাল তাদের কম্বো বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার্ড সিরোলিমাস ইলুটিং রিং বিক্রি করত ৮০ হাজার টাকা, বর্তমান মূল্য ৬১ হাজার ২৮৪ টাকা ৮৮ পয়সা। গ্লোবাল কর্পোরেশন তাদের আমদানিকৃত এফডিএ স্বীকৃত বেশ কয়েকটি রিং বিক্রি করত যথাক্রমে দেড় লাখ টাকা, এক লাখ ২৫ হাজার টাকা, এক লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ৮০ হাজার টাকা। বর্তমানে এগুলোর দাম নির্ধারণ হয়েছে যথাক্রমে এক লাখ ৪১ হাজার ৩৪৫ টাকা ৯৮ পয়সা, এক লাখ ৮ হাজার ১৬০ টাকা ৪০ পয়সা ও ৯২ হাজার ১৮২ টাকা ১৬ পয়সা। ওরিয়েন্ট এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট কো. লি. আগে বিক্রি করত দেড় লাখ, এক লাখ ২৫ হাজার, এক লাখ ২০ হাজার এবং ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে তাদের দুটি রিংয়ের দাম ধরা হয়েছে যথাক্রমে এক লাখ ৪৩ হাজার ৪৯ টাকা ৫৭ পয়সা ও এক লাখ ৭ হাজার ৮৬১ টাকা ৩৯ পয়সা। কার্ডিয়াক কেয়ার লি. আগে তাদের আমাদানিকৃত বিভিন্ন রিং বিক্রি করত যথাক্রমে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা, দেড় লাখ টাকা, এক লাখ ২৫ হাজার টাকা ও এক লাখ ২০ হাজার টাকা। বর্তমানে তাদের দুটি রিংয়ের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৪৯ হাজার ৮৯১ টাকা ৭ পয়সা ও ১ লাখ ১৪ হাজার ১৯০ টাকা ৮৮ পয়সা। মেডি গ্রাফিক ট্রেডিংয়ের চারটি রিং বিক্রি হতো এক লাখ ৮০ হাজার টাকা, দেড় লাখ টাকা, এক লাখ ২৫ হাজার টাকা ও এক লাখ ২০ হাজার টাকা। বর্তমানে তাদের চারটি রিংয়ের দাম নির্ধারণ হয়েছে যথাক্রমে এক লাখ ৪৯ হাজার ৪৮৮ টাকা ৭৪ পয়সা, ৯৪ হাজার ১৭৯ টাকা ৪৪ পয়সা, ৬৯ হাজার ৫৯৭ টাকা ৫৩ পয়সা এবং ২৫ হাজার টাকা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আফজাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, চিকিৎসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে সরকার নির্ধারিত মূল্যে রোগীদের হার্টের রিং পরাতে। অন্যথায় অভিযুক্তদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, দেশে হার্টের রিং বিক্রিতে মার্কআপ মূল্য (পণ্যে করসহ অন্যান্য খরচ ও ধার্যকৃত সর্বোচ্চ মূল্যহারের ব্যবধান) নির্ধারণ করা হয় ২০১২-১৩ অর্থবছরে। কিন্তু রোগীদের কাছে রিং বিক্রিতে এ মার্কআপ মূল্য অনুসরণ করেননি বিক্রেতারা। একশ্রেণীর চিকিৎসকের সঙ্গে যোগসাজশে এতদিন ধরে রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে করোনারি স্টান্ট আমদানি শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত। এতে কোনো ধরনের অগ্রিম আয়করও পরিশোধ করতে হয় না। এর বাইরে ৪ শতাংশ অগ্রিম শুল্ক-ভ্যাট পরিশোধ করে নির্ধারিত মার্কআপসহ সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১ দশমিক ৫৫১৫১৬। অর্থাৎ পণ্যের প্রতি ১ টাকা আমদানি মূল্যের বিপরীতে এর সর্বোচ্চ মূল্য ধরা যাবে ১ টাকা ৫৫ পয়সা। কিন্তু তা অনুসরণ না করে ইচ্ছামতো মূল্যে রিং বিক্রি করেছে আমদানিকারকরা।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/29/121021/