২৯ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ৮:৪৮

ভাঙা বেড়িবাঁধ উপকূলে আতঙ্ক

৫-৬ মাসই ডুবে যায় চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্র আগ্রাবাদ : মজবুত শহর রক্ষা বাঁধের বিকল্প নেই : ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ

অতীত থেকেই দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। এসব দুর্যোগে অগণিত প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু ঝড়- জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়েও যারা বেঁচে যায় তাদের যেন মরণদশা। ঝড়- জলোচ্ছ্বাস যখন হয় না তখনও নিয়মিত প্রবল জোয়ারে বসতভিটা, ধানি জমি, ফাউন্দি ক্ষেত, লবণের মাঠ, চিংড়ি ঘের, পুকুর কিংবা দোকানপাট বঙ্গোপসাগরের লোনা পানির সাথে মিলেমিশে একাকার। উপকূলে জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা থেকে কখনো মুক্তি মিলে না। কোটি কোটি চর, উপকূল, দ্বীপাঞ্চলবাসীর চরম অনিশ্চয়তা ও দুর্ভোগের পেছনে মূল কারণটি হলো সমুদ্র উপকূলভাগ সুরক্ষা দেয়ার জন্য জরুরি অপরিহার্য বেড়িবাঁধে অবহেলা। অথচ সাগর উপকূলে মজবুত বেড়িবাঁধ অপরিহার্য। এ মুহূর্তে সবখানেই ক্ষতবিক্ষত, নড়বড়ে ও বিধ্বস্ত অবস্থায় কোনোমতে টিকে আছে বেড়িবাঁধ। উপকূলীয় অনেক জনপদে বেড়িবাঁধ ব্যবহৃত হয় স্থানীয় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু বাঁধ বিধ্বস্ত এমনকি অনেক জায়গায় চিহ্নও হারিয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন প্রায়। টেকনাফ-শাহপরীর দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম-নোয়াখালী-ভোলা-বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তটরেখায় বেড়িবাঁধের নাজুকদশা। ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ দিয়ে সাগরের লোনাপানি এখন এপাশ-ওপাশ ঢেউ খেলছে। বঙ্গোপসাগরের করাল গ্রাসের মুখে রয়েছে ২১টি উপকূলীয় জেলার অন্তত সাড়ে ৪ কোটি মানুষ। এ অবস্থায় অরক্ষিত রয়েছে সমগ্র উপকূল। আর এতে উপকূলবাসীর মনে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ-অসন্তোষ আরও বাড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে সম্ভাব্য যে কোনো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানলে তখন কোটি কোটি মানুষের জানমাল রক্ষা পাবে কীভাবে এমনটি ভেবে উপকূলজুড়ে বিরাজ করছে দুর্যোগ আতঙ্ক।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর এ যাবত দেশি-বিদেশি বরাদ্দ বাবদ চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকুন্ড, স›দ্বীপ, পতেঙ্গা, কাট্টলী, হালিশহর, কক্সবাজার সদরসহ কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, টেকনাফ, নোয়াখালীর হাতিয়া, ভোলাসহ সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা হরিলুট হয়েছে। মানসম্মত কাজ হয়নি। সেই বাঁধ টেকেনি। ফেরেনি উপকূলবাসীর ভাগ্য। উপকূলজুড়ে অতীতে সবুজ বন তথা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ছিল, এখন তা আর নেই। বনদস্যু ও ভূমিদস্যু উভয় চক্র মিলে নির্বিচারে নিধন করছে উপকূলের ‘সবুজ বেষ্টনি’। বেড়িবাঁধের মতো অপরিহার্য প্রতিরক্ষাব্যুহ না থাকায় দুর্যোগে বিপদই উপকূলবাসীর নিত্যসঙ্গী। আড়াই হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে অধিকাংশই বর্তমানে জরাজীর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে।
নাজুকদশায় বেড়িবাঁধ
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের দ্বীপাঞ্চল ও উপকূলে ৩৫ শতাংশ স্থানে বেড়িবাঁধের চিহ্ন প্রায় মুছে গেছে। উপকূলের ৪৫ ভাগ বেড়িবাঁধ কম-বেশি বিধ্বস্ত ও নড়বড়ে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও জোড়াতালির মেরামতের নামে বছর বছর চলছে সীমাহীন দুর্নীতি। এর পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) একশ্রেণীর অসৎ প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদার মিলে গড়ে উঠেছে একটি সংঘবদ্ধ লুটেরা চক্র। ওরা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হলেও দেশের উপকূলে ‘স্থায়ী’ বেড়িবাঁধ আজো হয়নি। জোড়াতালির ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ পরিণত হয়েছে উপকূলবাসীর মরণফাঁদ। এতে ঝড়- জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের আতঙ্ক নিয়েই দিনাতিপাত করতে হয় উপকূলবাসীকে। স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে উপকূলবাসীর জীবন-জীবিকা হুমকির সম্মুখীন। কেননা কৃষি-খামার, ফসলি জমি, লবণের মাঠ, চিংড়িসহ মাছের ঘের, পুকুর, সবজি ক্ষেতসহ গ্রামীণ অর্থনীতি এমনকি বসতভিটা সবকিছুই উত্তাল সাগরের করাল গ্রাসের মুখে রয়েছে। ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ দিয়ে আবার কোথাও বেড়িবাঁধের চিহ্নও না থাকার কারণে সাগরের লোনা পানি গ্রাম-জনপদ ও ফসলের জমি প্লাবিত করছে নিয়মিত জোয়ার-ভাটায়। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, সংস্কার কাজের মান নিয়ে উপযুক্ত তদারকি, যাচাই, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কোনো বালাই ছিল না। তাই বেড়িবাঁধ টেকেনি। বিরান হয়ে গেছে সাগরের পেটে।
বেড়িবাঁধ যায়, নতুন কাজ আসে! নামেমাত্র কাজ করেই বিল তুলে নিয়ে সটকে পড়ে ঠিকাদার। পেছনে কর্তাদের যোগসাজশ। বেড়িবাঁধের কাজ পালাক্রমে বছর বছর এভাবেই চলছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের সময় তা যথেষ্ট উঁচু করে নির্মিত হয় না। সামুদ্রিক জোয়ারের সমান উঁচু করে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা হচ্ছে। এতে করে জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধ অতিক্রম করে ফসলি জমি, লবণ মাঠ ও লোকালয় ভাসিয়ে দিচ্ছে। যথেষ্ট উঁচু ও মজবুত করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ সম্পন্ন না করার কারণে দুর্যোগের সময় তা উপকূলবাসীকে সুরক্ষা দিতে পারছে না। বাস্তবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে বেড়িবাঁধ।
অরক্ষিত চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ
দেশের প্রথম ও একমাত্র বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে অবস্থিত। আগ্রাবাদ শুধু চট্টগ্রামেরই নয়; দেশের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ, কর্মব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা। অথচ সেখানেই ঢলের মতো জোয়ার এসে হাঁটু পানি জমে থাকে। অনেকগুলো ‘পাড়া’ (যেমন- বেপারি পাড়া, মিস্ত্রি পাড়া, পানওয়ালা পাড়া) নিয়ে গঠিত চট্টগ্রামের ঘনবসতিপূর্ণ ও আদি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বৃহত্তর আগ্রাবাদ এলাকা বছরের ৫-৬ মাসই পানিতে ডুবে থাকে। মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হলেই আগ্রাবাদে সৃষ্টি হয় মারাত্মক পানিবদ্ধতা। তবে বৃষ্টি না হলেও নিয়মিত সামুদ্রিক জোয়ারের পানিতে ডুবভাসি করছে আগ্রাবাদ। কোথাও কোমর, কোথাও হাঁটু সমান পানি বা কাদাপানি। যদিও আগ্রাবাদের অবস্থান নগরীর দক্ষিণ ও পশ্চিমের সমুদ্র উপকূলভাগ থেকে যথেষ্ট ভেতরের দিকে।
বর্ষণ ও জোয়ারে আগ্রাবাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক-বীমা পাড়া, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, সরকারি কমার্স কলেজসহ অধিকাংশ স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, বিপণীকেন্দ্র, হাট-বাজার, গুদাম, সড়ক অলিগলি প্লাবিত হয়। অনেক সময় ২-৩ দিনেও পানি নামে না। বরং থমকে থাকে। এতে করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকার। এলাকাবাসীর দুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে। এক সময়ে বনেদী পাড়া হিসেবে পরিচিত ছিল সিডিএ আবাসিক এলাকা। অহরহ পানিবদ্ধতায় ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে অনেকেই আগ্রাবাদে দীর্ঘদিনের বসবাস ছেড়ে দিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
অর্ধশত ‘পাড়া’ ও বাণিজ্যিক এলাকা নিয়ে গঠিত আগ্রাবাদ ছাড়াও এর কাছাকাছি বৃহত্তর পতেঙ্গা, কাটগড়, বৃহত্তর হালিশহর, পাহাড়তলী-সাগরিকা, উত্তর ও দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় জোয়ারের পানিতে সৃষ্ট পানিবদ্ধতা স্থায়ী সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এ কারণে লাখ লাখ মানুষের অশেষ দুর্গতি যেন নিয়তি হয়ে গেছে। এই এলাকায় অবস্থিত দেশের প্রথম ইপিজেড হুমকির মুখোমুখি রয়েছে। তাছাড়া এসব এলাকায় গড়ে ওঠা গার্মেন্টসহ কয়েকশ’ বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা, চট্টগ্রাম বন্দরের পরিপূরক স্থাপনা, ব্যবসা-বাণিজ্য খাতের প্রতিষ্ঠান রয়েছে পানিবদ্ধতা সংকটের কবলে। তাছাড়া যেভাবে জোয়ার ও পানিবদ্ধতা বিস্তার লাভ করছে এতে পতেঙ্গাসহ আরও বিস্তীর্ণ এলাকা বছরের উল্লেখযোগ্য সময় ডুবে যেতে পারে। আর সেসব এলাকায় প্রতিষ্ঠিত রয়েছে দেশের প্রধান জ্বালানি তেলের স্থাপনা, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, অফডক, বিভিন্ন প্রতিরক্ষা স্থাপনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের স¤প্রসারণ প্রকল্পস্থল বে-টার্মিনাল এলাকাসহ পর্যটনকেন্দ্র। আগ্রাবাদে ঘন ঘন পানিবদ্ধতার সংকট নিরসনে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এক বছর আগে মহেশখালের উপর একটি বাঁধ দেয়া হয়। কিন্তু এতে সমস্যার সুরাহা তো হয়নি; বরং নতুন নতুন এলাকা ডুবে যাওয়া ও পরিবেশ দূষণের প্রেক্ষিতে স্থানীয় এলাকবাসী মহেশখাল বাঁধ উচ্ছেদের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা আগ্রাবাদ এলাকায় খালগুলোর মুখে স্থায়ী সুইচ গেইট নির্মাণ এবং স্থায়ী শহর রক্ষা বাঁধের দাবিতে মানববন্ধন, সমাবেশ করেছে।
দেশের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বৃহত্তর আগ্রাবাদ এলাকাসহ এর সংলগ্ন বৃহত্তর পতেঙ্গা হালিশহর, কাট্টলী এলাকাগুলো বর্ষণ ও জোয়ারে ঘন ঘন পানিবদ্ধতার ‘ক্রনিক’ সমস্যার মূলে রয়েছে চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধের দীর্ঘদিনের নাজুকদশা। বাঁধ মাঝেমধ্যে জোড়াতালি মেরামত করা হলেও তা খুবই অপর্যাপ্ত। বন্দরনগরীর উত্তর-পশ্চিমে ফৌজদারহাট থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে পতেঙ্গা পর্যন্ত সামুদ্রিক জোয়ারের আনুপাতিক হারে উঁচু ও মজবুত একটি যুগোপযোগী শহর রক্ষা বাঁধের দাবিটি বহু পুরনো হলেও তা উপেক্ষিত। বর্তমান শহর রক্ষা বাঁধটি জরাজীর্ণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় কাছাকাছি নিচু ও ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। যার ফলে নিয়মিত সামুদ্রিক জোয়ার হলেই নগরীর দক্ষিণ ও পশ্চিমের উপকূলীয় এলাকাগুলোর ভাঙাচোরা বেড়িবাঁধ অতিক্রম করে পানি হু হু করে বৃহত্তর আগ্রাবাদ এলাকা পর্যন্ত ডুবিয়ে দেয়। এতে সৃষ্টি হয় পানিবদ্ধতার। যা কয়েক দিন ধরে জিইয়ে থাকে। পানিবন্দি হয়ে পড়ে নগরের কেন্দ্রস্থলের লাখো মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অথচ টেকসই, উঁচু শহর রক্ষা বাঁধ তথা বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলে বৃহত্তর আগ্রাবাদ, পতেঙ্গা, হালিশহরসহ নগরীর ব্যাপক অংশের পানিবদ্ধতার সংকট অনায়াসে নিরসন হতো। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করতে হবে উপযুক্ত পরিকল্পনা সহকারে।
তবে চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধের মতো ব্যাপক ধরনের প্রকল্প যেহেতু সিটি কর্পোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, সেহেতু এর জন্য সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে বিশিষ্ট নাগরিকরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তাদের শঙ্কা, অন্যথায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, বিনিয়োগ সম্ভাবনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান জানান, দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে আগ্রাবাদে জোয়ারের পানিবদ্ধতা সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান জরুরি। এরজন্য চট্টগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ মজবুত ও যথেষ্ট উঁচু করে নির্মাণ আশু প্রয়োজন। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাদার্ন ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি এম আলী আশরাফ বলেন, আগ্রাবাদসহ চট্টগ্রাম মহানগরীর উপকূলবর্তী এলাকাগুলো জোয়ারে পানিবদ্ধতায় ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতির শিকার। এসব এলাকা কার্যকরভাবে পানিবদ্ধতা মুক্ত করতে হলে যুগোপযোগী টেকসই শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের বিকল্প নেই। বিশ্ব বাণিজ্যকেন্দ্র’র উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি মাহববুল আলম বলেন, আগ্রাবাদ এলাকায় পানিবদ্ধতা সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর সুপরিকল্পিত ও স্থায়ী সমাধান দরকার। জোয়ার ও পানিবদ্ধতার কারণে আগ্রাবাদে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। স্থায়ী শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ নিশ্চিত হলেই এ সংকট দূর হবে।
‘মোকাম্মেল কমিটি’র সুপারিশ উপেক্ষা
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াসের ধ্বংসযজ্ঞের পর দুর্যোগ-প্রবণ সমুদ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলবাসীর জানমাল সুরক্ষায় অগ্রাধিকার পরিকল্পনার ভিত্তিতে উপযুক্ত অবকাঠামো সুবিধাদি গড়ে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে সমন্বিত একটি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এর আওতায় তৎকালীন সচিব এম মোকাম্মেল হকের নেতৃত্বে গঠিত সরকারি উচ্চপর্যায়ের কমিটি কর্তৃক প্রণীত হয় দীর্ঘ প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা। এতে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বারোপ করা হয় উপকূলের নিরাপত্তা-সুরক্ষায় পরিকল্পিতভাবে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের বিষয়টি। এরপর রয়েছে বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন সাইক্লোন সেন্টার স্থাপন, সহজ ও বোধগম্য আবহাওয়া সতর্ক সংকেত প্রচলন, দুর্যোগ সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, উপকূলভাগে এনজিও কার্যক্রমে সুষ্ঠু সমন্বয়, দুর্যোগকালীন খাদ্যশস্য ও গবাদিপশু রক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি খাতওয়ারী সমস্যাবলী চিহ্নিত করে টেকসই উন্নয়ন।
বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে মাঠপর্যায়ে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ শেষে স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদে সরকারের করণীয় সম্পর্কে ‘মোকাম্মেল কমিটি’ প্রণীত ১৭ দফা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশমালা গত ২৬ বছরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। সমুদ্রবন্দর, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চল অরক্ষিত রয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়েছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবর্ণনীয় দুঃখ-যাতনায় তাদের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বঙ্গোপসাগর ঘেরা দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলে বসবাসরত সাড়ে ৪ কোটি জনগোষ্ঠির জন্য বেড়িবাঁধ, সাইক্লোন সেন্টারসহ পর্যাপ্ত নিরাপদ অবকাঠামো আজো গড়ে উঠেনি। কৃষি-খামার, চিংড়িসহ সামুদ্রিক মৎস্য, লবণ, মুক্তা, প্রবাল, ঝিনুক, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদরাজি এবং সেখানে অবস্থিত বন্দরসমূহ প্রতিনিয়ত দুর্যোগে ঝুঁকিতে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, বরিশাল ও খুলনায় সাগরের সাথে লাগোয়া দ্বীপ ও চরগুলো ক্রমেই পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর অধিক ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ জোন হওয়ার কারণে ঘন ঘন লঘুচাপ, নিম্নচাপ সৃষ্টি হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াস ছাড়াও আগের চেয়ে অধিক উচ্চতায় জোয়ার হানা দিচ্ছে বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলে। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে প্রাণপণ লড়াই করে কোনমতে টিকে আছে লড়াকু উপকূলবাসী।
ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ
আজ (শনিবার) ভয়াল সেই ২৯ এপ্রিল। শতাব্দীর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে ধ্বংসযজ্ঞের দুঃসহ স্মৃতি বিজড়িত দিন। ২৬ বছর আগে ১৯৯১ সালের সেই কালোরাতে সর্বনাশা গর্কির আঘাতে দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলভাগে কক্সবাজার থেকে ভোলা পর্যন্ত বিশাল জনপদ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ২৯ এপ্রিল রাত ৯টা থেকে পরদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় এবং একইসঙ্গে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। সেই প্রলয়ংকরী গর্কির ধ্বংস চিহ্ন দুই যুগ পর আজও মুছে যায়নি প্রত্যন্ত উপকূলের অনেক জায়গায়। প্রচন্ড সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের ছোবলে সরকারি হিসাবে নরনারী শিশুবৃদ্ধসহ ১ লাখ ৩৪ হাজার আর বেসরকারি হিসাব মতে কমপক্ষে ২ লাখ বনিআদম অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করে। আহত হয় দু’লাখেরও বেশি মানুষ। এরমধ্যে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে কয়েক হাজার। দেড় লাখ গবাদিপশু ভেসে যায় সাগরে। প্রায় ১০ লাখ বসতঘর কম-বেশি বিধ্বস্ত হয়। ’৯১-এর ২৯ এপ্রিলের দুর্যোগে ক্ষতির শিকার হয় প্রায় ১ কোটি উপকূলবাসী। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের সহায়-সম্বলের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
সেই ঘূর্ণিঝড়ে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম মহানগরী ও এর সংলগ্ন পতেঙ্গা বিমান বন্দর, বিমান ও নৌঘাঁটি, হালিশহর, কাট্টলী তছনছ হয়ে যায়। বৃহত্তর চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, স›দ্বীপ, উড়িরচর, সীতাকুন্ড থেকে কক্সবাজার শহরসহ কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, ধলঘাট, মাতারবাড়ি, বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধানত হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ, রামগতি, ভোলার চরফ্যাসন, তজুমদ্দিন, লালমোহনসহ দেশের সমগ্র দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব সমুদ্র উপকূলভাগ এবং দক্ষিণাঞ্চলের একাংশ তছনছ হয়ে যায়। মানুষের লাশের মিছিলে গবাদিপশুর মৃতদেহ একাকার হয়ে যায়। পিতা-মাতা হারিয়ে উপকূলজুড়ে অগণিত শিশু-কিশোর এতিম হয়ে পড়ে। স্বচ্ছল গৃহস্থী লক্ষাধিক পরিবার বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে পথের ফকিরে পরিণত হয়।
’৯১-এর ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিদুর্গত উপকূলীয় এলাকাসমূহে মানবিক ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য নগদ অর্থসহ দেশি-বিদেশি সাহায্য সহায়তা আসে বানের স্রোতের মতো। চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়ায় বাংলাদেশের দুর্গত জনগণকে। কিন্তু বেপরোয়া দুর্নীতি, আত্মসাতের মধ্যদিয়ে বিদেশি সাহায্যের অধিকাংশই লুটপাট হয়। এর তেমন কোন সুফল পায়নি উপকূলবাসী।
এদিকে সেই গর্কির ছোবলে অসংখ্য আপনজন হারানোর দুঃসহ শোকে এখনও স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে চর, উপকূল, দ্বীপাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি ঘরের মানুষজন। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসের ভয়াল দিনটি স্মরণে আজ বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-সমিতি কোরআনখানি, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, বিশেষ মোনাজাত, নিহতদের কবর জিয়ারত ও ফাতেহা পাঠ, সেমিনার, শোকর্যালি, আলোচনা সভাসহ বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। উপকূলব্যাপী ওয়ার্ড-ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলাওয়ারী বিভিন্ন সংগঠন দিনটি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে পালন করবে।

শোক গুমরে, ওঠে আনোয়ারাবাসীর
আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা : ২৯ এপ্রিল’৯১-এর ভয়াল স্মৃতি নিয়ে এখনও শোক গুমরে ওঠে উপকূলীয় উপজেলা স্বজন হারানো আনোয়ারাবাসীর। আনোয়ারায় সেদিন অন্তত ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। তাদের সহায়-সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২৬ বছর পরও অতীতের দুঃসহ স্মৃতি মুছে ফেলতে পারেনি উপক‚লবাসী। প্রতিবছরের মতো এবারও আনোয়ারা উপক‚লীয় উন্নয়ন ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংগঠন-সমিতি, শোকার্ত পরিবারবর্গের উদ্যোগে কবর জিয়ারত, কোরআন খানি, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলসহ বিভিন্ন আয়োজনে দিনটি পালন করা হবে। এখনো অরক্ষিত রয়েছে উপক‚লীয় বিস্তীর্ণ এলাকা এবং এই অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর আনোয়ারায় যেসব সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়, তা এখন ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। উপজেলার উপক‚লীয় ইউনিয়ন রায়পুর ও জুঁইদন্ডীর প্রায় ১০ কিলোমিটারেরও বেশি বেড়িবাঁধ চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতি অমাবস্যা-পূর্ণিমায় সাগরের জোয়ারের পানি প্রবেশ করে লোকালয়ে। এ নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভের শেষ নেই। কোন সংকেত দেয়া হলে তারা আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন, আর যেন ভয়াল ২৯ এপ্রিল না আসে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোকায়সার উদ্দিন জানান, আনোয়ারার ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য আড়াই শ’ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এসব কাজের মাধ্যমে রায়পুর ও জুঁইদন্ডীসহ উপক‚লীয় এলাকার সমস্যা কেটে যাবে। রায়পুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ জানে আলম বলেন, প্রতিবছর বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য পাউবো কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও তার সিকিভাগ কাজও হয় না। এতে করে উপক‚লের মানুষ ঝুঁকি নিয়ে রয়েছে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/77347/