২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ১:৫২

বন্যার অজুহাতে অস্থির চালের বাজার

বন্যার অজুহাতে এবার অস্তির চালের বাজার। কোন কারণ ছাড়াই সিন্ডিকেট চক্র চালের দাম বাড়িয়ে চলেছে। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ রাইস মিল মালিকরা চাল গুদামে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। মোটা চাল থেকে শুরু করে চিকন চাল পর্যন্ত সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩-৫ টাকা। এতে বিপাকে পড়েছে মধ্য ও নিম্ম আয়ের লোকেরা। বিএসটি’র ট্রাক সেলেও বাজার নিয়ন্ত্রন হচ্ছে না। নিম্ম আয়ের মানুষদের অভিযোগ ট্রাক সেলে আটা পেলেও চাল পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজধানীর পাইকারি এবং খুচরা দোকান ঘুরে দেখা গেছে গত ২-৩ দিনে বস্তা প্রতি চালের দাম বেড়েছে ১৫০-১৭০ টাকা। তবে, মোটা চালের তুলনায় চিকন চালের দাম বেড়েছে বেশি। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিভিন্ন জেলায় বন্যার কারণে চাল আমদানি কম।
জানা গেছে, হাওর অঞ্চলের কৃষকরা তেমন চাল বিক্রি করতে পারে না। তাদের উৎপাদিত চাল দিয়ে তাদের সংসার চলে মাত্র। মূল বাণিজ্যিকভাবে ধান উৎপাদন হয়ে থাকে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটর, চাপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, পাবনা এবং বরিশালের কিছু অংশে। এসব এলাকায় এখনও বন্যায় ফসল হানির কোন খবর পাওয়া যায়নি। অথচ হাওর অঞ্চলের বন্যার অজুহাতে ইতোমধ্যেই চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মিল মালিকরা।
মালিকরা বলছেন, এখনও ধানের ভরা মওসুম চলছে। অথচ বাজারে তেমন কোন ধান বেচাকেনা নেই। আর সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকরা বলছেন, ধান কাটা এখনও চলছে। এ ধান শুকিয়ে পরে বাজারে বিক্রি করা হবে। এর পরেও বাজারে নতুন ধানের প্রভাব পড়বে। নতুন ধানের উপর ভিত্তি করে চালের দাম কমতে আরও ১৫ দিন লাগতে পারে।
অভিযোগ রয়েছে, মিল মালিকরা চালের দাম বাড়ানোর ইচ্ছা করলেই চাল বিক্রি বন্ধ করে তা মজুদ রাখেন। এতে করে বাজারে চাহিদা বেড়ে যায় এবং সরবরাহ কমে যায়। ফলে কোন কারন ছাড়াই চাল দাম বাড়িয়ে থাকেন পাইকারি আড়তদাররা। আর এর প্রভাব পড়তে থাকে খুচরা বাজারে।
এদিকে চালের দাম বাড়ার জন্য খুচরা, পাইকারি ও মিলাররা একে অপরকে দায়ী করছেন। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণে তারাও বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। আবার পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকরা চালের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন, একই সঙ্গে দামও বাড়িয়েছেন। ফলে তাদের কাছ থেকে বেশি দামে চাল কেনার কারণে বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাবু বাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতা ঢাকা রাইস সিন্ডিকেটের মালিক মনির হোসেন বলেন, গ্রামে এখন ধান পাওয়া যাচ্ছে না। সব ধান বড় বড় কোম্পানিগুলো কিনে গুদামজাত করেছে। যে কারণে মিলাররা ধান কিনতে পারছে না। ধানের সংকটের কারণে বাজারে চালের দাম বেড়েছে।
এখনও মিল মালিকরা বন্যার অজুহাতে নিজেদের গুদামের চাল বেশি দামে বিক্রি করতেই বন্যাকে পুঁজি করছে। এটি তাদের ব্যবসায়িক কৌশল। সরকার যদি উপর থেকে নিয়মিত মনিটরিং করতে পারতো তাহলে বাজার নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। কারন হিসেবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, কোন মিল মালিক বছরের শুরুতে কত টন ধান গুদামজাত করেছে তার হিসার রয়েছে। কোন মাসে কত চাল বিক্রি করলো তারও হিসাব রয়েছে। এ হিসাব সরকার চাইলেই বাজার নিয়ন্ত্রন সম্ভব।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কুমিল্লা রাইস এজেন্সির সারোয়ার বলেন, মিল মালিকরা মওসুমের সময়ে কম দামে ধান কিনে মজুদ করেছেন। আর এখন মওসুমের শেষে বাজারে ধান কম থাকায় চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের কৌশলের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে হাওর অঞ্চলের বন্যা। অথচ কৃষকরা বলছেন নতুন ধান এখনও মাড়াই শেষ হয়নি। বাজারে উঠতে আরও কমপক্ষে ১৫ দিন সময় লাগবে। এ ধান মিল মালিকরা ক্রয় করে চাল করে বাজারে বিক্রি করতে সময় লাগবে আরও কমপক্ষে এক দেড় মাস।
তিনি দাবি করেন, মোটা চালের দাম কেজি প্রতি ৩ থেকে সাড়ে ৩ টাকা বেড়েছে। চিকন চাল বেড়েছে কেজিতে ৪ থেকে সাড়ে ৪ টাকা।
চাল ব্যবসায়ী মানিক সাহা বলেন, ১৫ দিনের ব্যবধানে চালের বাজারে আগুন। গুদামে কোন চাল নেই, চাল আমদানি হচ্ছে না, সে কারণে বাজারে চাল পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। বাজার চাহিদাও বেড়েছে। বেশি টাকা দিয়েও আমরা চাল পাচ্ছি না। মিল মালিকরা বলছেন বন্যার কারনে চালের স্বভাবিক সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। বন্যায় অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। অনেক কৃষককে এবার চাল কিনে খেতে হবে। নতুন ধান এলেও এবার চালের দাম তেমন কমবে না।
তার দেওয়া হিসাবে, ১৫ দিন আগেও জিরা নাজির প্রতি কেজি বিক্রি হতো ৩৯ টাকায় যা এখন ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়ে ৪৩-৪৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইজাম প্রতি কেজি ৪ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৪ টাকায়। অরিজিনাল নাজির চালও প্রতি কেজি ৬ টাকা বেড়েছে। মিনিকেট চাল কেজি প্রতি ৭ ও বিআর২৮-চাল কেজি প্রতি বেড়েছে ৬ টাকা।
হঠাৎ করে চালের দাম বৃদ্ধি কেন? ব্যবসায়ী মানিক বলেন, মিলের মালিকরা পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল আমদানি করছেন না, পাইকারীভাবে চাল বেশি টাকায় কিনে আনায় চালের দাম বেড়ে গেছে। সামনে রোজা তাই চালের দামে আরো প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
চালের দাম বৃদ্ধির কয়েকটি কারণ বলেছেন কুমিল্লা রাইস এজেন্সির মালিক সারোয়ার।তিনি বলেন, অনেক জেলার ধান বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। অগ্রহায়ণেও ফসল ডুবে যাওয়ায় চালের সংকট। ভারত থেকেও চাল আমদানি বন্ধ থাকাও একটি কারণ বলে দাবি করেন তিনি।
এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার খোলা ট্রাকে চাল এবং আটা বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে এর কোন প্রভাব নেই। সাধারন ক্রেতাদের অভিযোগ ট্রাক সেলে আটা পাওয়া গেলেও চাল পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু ডিলাররা বলছেন, গ্রাহকদের অভিযোগ সত্য নয়। কারন হিসেবে তারা বলছেন, চালের চাহিদা অনেক বেশি। আর আটার চাহিদা কম। তাই ট্রাকের চাল বিক্রি করতে ৩ ঘন্টা সময় লাগলেও আটা বিক্রি করতে সময় লাগে আট ঘন্টা। শেষের দিকে আসা গ্রাহকরা চাল না পেয়ে এমন অভিযোগ করে থাকেন।
টিসিবি বলছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে তারা নিয়মিত ট্রাক সেল করছেন। আর ট্রাকের চালের দাম আগের চেয়ে অনেক কমেছে। আগের মোটা চাল বিক্রি হতো ২৩ টাকায়। এখনও তা বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকায়। চালের মান ভাল হলে গ্রাহক অনেক থাকেন আর মান খারাপ হলে গ্রাহক কমে যায়। তবে বাজারে তেমন কোন প্রভাব নেই।

 

http://www.dailysangram.com/post/281687-