২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ১:৪২

‘জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে’

তিন বিসিএসে নিয়োগ বঞ্চিত দুই শতাধিক

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই প্রার্থীদের চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়। সেখানে কারও বিরুদ্ধে আপত্তি থাকলে কিছুই করার থাকে না। তারপরও অনেক ক্ষেত্রে পুনঃতদন্তে পাঠানো হয় - প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক * কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে ঠুনকো অভিযোগ বা তার দূরসম্পর্কের আত্

জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে’- গোয়েন্দা সংস্থার এমন মন্তব্যে দুই শতাধিক মেধাবী যোগ দিতে পারেননি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস)। দেশের সবচেয়ে কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা- বিসিএসের প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক- এই তিন ধাপ অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আপত্তি থাকায় নিয়োগ পেতে ব্যর্থ হয়েছেন এই মেধাবীরা।


গত তিনটি বিসিএসের (৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম) ফল ও নিয়োগ পর্যালোচনা করে এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এ ছাড়া মামলাজনিত সমস্যা, কাগজপত্রের ঘাটতি, নেতিবাচক স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন, ভুল স্থায়ী ঠিকানা ও সময়মতো মুক্তিযোদ্ধার সনদ দাখিল না করার কারণেও এই তিন বিসিএসে নিয়োগ পাননি আরও অর্ধশতাধিক।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বিসিএসের ওই তিন ধাপ উত্তীর্ণ হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখে এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন দেন গোয়েন্দারা। বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত এ কাজটিই করে থাকে গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু ৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম বিসিএসের ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের পরিবারের কোনো সদস্য স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের রাজনৈতিক দল কিংবা সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হয়েছে। যাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাদের ব্যাপারে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে’।

সূত্র আরও জানায়, বিসিএস পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পর নিয়োগের আগে প্রার্থীদের ব্যাপারে গোয়েন্দাদের দেয়া প্রতিবেদন নিয়ে অতীতে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ৩৫তম বিসিএসের আগে সরকারের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে উত্তীর্ণ প্রার্থীর তথ্য অনুসন্ধান করা হতো। একই প্রার্থী সম্পর্কে দুই গোয়েন্দা সংস্থা দু’ধরনের তথ্য দেয়ার কারণে আগেও নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। ২৮ থেকে ৩৪তম বিসিএস পর্যন্ত ২০৩ জন প্রার্থীর ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। পুনঃতদন্তে অনাপত্তি পাওয়ায় তাদের মধ্যে ১৪৫ জনকে ইতিমধ্যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ৩৫তম বিসিএসের আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়, একটি গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনও উত্তীর্ণদের তথ্য যাচাই করবে। সে অনুযায়ী ৩৫তম বিসিএসের প্রার্থীদের তথ্য যাচাই-বাছাই করেছে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক ২৩ এপ্রিল নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। প্রার্থীদের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রতিবেদন দেন গোয়েন্দারা। তার ভিত্তিতেই চূড়ান্ত নিয়োগ দেয়া হয়। সেখানে কারও বিরুদ্ধে আপত্তি থাকলে আমাদের কিছুই করার থাকে না। তারপরও অনেক ক্ষেত্রে পুনঃতদন্তে পাঠানো হয়। ইতিবাচক প্রতিবেদন পেলে নিয়োগ দেয়া হয়। এটি চলমান প্রক্রিয়া। এখানে কারসাজি বা ইচ্ছাকৃতভাবে কারও প্রতি অবিচার করা হচ্ছে না, যা কিছু হচ্ছে তা প্রচলিত বিধান মেনেই করা হচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো অপরাধ না থাকলে উত্তীর্ণ কোনো প্রার্থীকে বঞ্চিত করা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘ভেগ’ কোনো কারণে কাউকে বঞ্চিত করা ঠিক না। কেউ নাশকতার সঙ্গে জড়িত থাকলে বা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ঘটনা থাকলে তা স্পষ্ট করতে হবে। একজন প্রার্থী কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে ঠুনকো অভিযোগ বা তার দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজনের কেউ যদি সরকার বা স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকেন, সে ক্ষেত্রে ওই প্রার্থীকে নিয়োগবঞ্চিত করতে হবে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর ২ হাজার ১৫৮ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে ৩৫তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে পিএসসি। চলতি বছরের ২ এপ্রিল এ সংক্রান্ত গেজেট জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতে দেখা যায়, পিএসসির সুপারিশকৃত তালিকায় স্থান পাওয়া ৮৫ জনেরই নাম নেই। পরে এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সনদসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হওয়ায় ১৩ এপ্রিল আরও ২০ জনের গেজেট জারি হয়। এদের সবাইকে আগামী ২ মে ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যোগ দিতে বলা হয়েছে। বাকি ৬৫ জনের বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

৩৫তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বঞ্চিত প্রার্থী যুগান্তরকে বলেন, গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তার চাচা বিএনপির প্রার্থী হয়ে চেয়ারম্যান পদে পরাজিত হন। জয়ী স্থানীয় চেয়ারম্যান ও তার লোকজন তার সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য দেয়ার কারণে প্রতিবেদনে আপত্তি দেয়া হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই। শুধু পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দিয়ে দেশ ও জাতির জন্য কিছু করব। সেভাবে নিজেকে গড়েও তুলেছিলাম। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে কিনা জানি না।’

৩৫তম বিসিএসে বঞ্চিত আরেক প্রার্থীর নিকটাত্মীয় (মামা) যুগান্তরের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাজনৈতিক দল দিয়ে একজন বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তার যোগ্যতার বিচার হতে পারে না। যোগ্যতার বলে কঠোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাদের নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেছে পিএসসি। সেখানে বাবা, মামা, চাচা, ভাইসহ আত্মীয়রা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত- এটা কোনো নিয়োগের মানদণ্ড হতে পারে না। পুলিশি যাচাই-বাছাইয়ে এ ধরনের ফরম দেয়া হচ্ছে। প্রার্থী কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিনা বা তার কোনো অযোগ্যতা আছে কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ৩৪তম বিসিএসে দুই হাজার ১৫৯ জনকে সুপারিশ করেছিল পিএসসি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গেজেট জারি করেছিল দুই হাজার ২০ জনের। বাকি ১৩৯ জনের মধ্য থেকে ১০ দফায় ৭৯ জনকে নিয়োগ দেয়া হলেও এখনও ঝুলে রয়েছেন ৬০ জন। এ ছাড়া ৩৩তম বিসিএসে পিএসসি সুপারিশ করেছিল ৮ হাজার ৫২৯ জনকে। কিন্তু গেজেট হয়েছিল ৮ হাজার ১০৫ জনের। বাকি ৪২৪ জনের মধ্যে ১৪ দফায় আরও ২৬৮ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। সুপারিশপ্রাপ্ত ১৫৬ জন এখনও নিয়োগবঞ্চিত।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঞ্চিতদের একজন যুগান্তরকে জানান, ৩২তম বিসিএসে তিনি শিক্ষা ক্যাডার পেয়েছিলেন। সব প্রক্রিয়া শেষে তিনি চাকরিতেও যোগ দেন। পছন্দের প্রশাসন ক্যাডার পেতে ৩৪তম বিসিএসে আবারও অংশ নেন তিনি। এবার তিনি পছন্দের ক্যাডার পেলেও গোয়েন্দাদের আপত্তির কবলে পড়েন। তার গ্রামের বাড়িতে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি তদন্ত করতে গিয়েছিলেন। চাকরির সুবাদে তিনি বাড়িতে না থাকলেও তার মা-বোনের সঙ্গে তাদের কথা হয়। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামে তদন্ত করতে যাওয়ার কারণে উভয় প্রতিনিধি (ভিন্ন ভিন্নভাবে) যাতায়াত খরচ বাবদ দেড় হাজার করে টাকাও নিয়ে আসেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থা অনাপত্তি না দেয়ায় তার নিয়োগ আটকে যায়। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে শিক্ষা ক্যাডার পাওয়া অপর এক প্রার্থীর ক্ষেত্রে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই প্রার্থীও যুগান্তরকে জানান, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে অনাপত্তি পেয়ে তিনি ২০১৫ সালে প্রথম শ্রেণীর পদে (পিটিআই ইন্সট্রাকটর) চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু ৩৪তম বিসিএসে তার ক্ষেত্রে গোয়েন্দারা আপত্তি জানান। পরে অনেক কষ্টে নানা ঘাট ম্যানেজ করে তিনি চাকরিতে যোগ দেন।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/28/120717/