২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ১:৩৮

শ্রমের হাটে অভাবী মানুষ

ফসল হারিয়ে বিপাকে হাওরবাসী। কাজের সন্ধানে শহরে অভাবী মানুষ। ছবিটি গত বুধবার সকালে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কালীবাড়ি মোড় থেকে তোলা l প্রথম আলো

সুজন মিয়ার বয়স ১৫ কি ১৬। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাবার সঙ্গে কৃষিকাজেই সময় দেয় সে। এ সময়টায় প্রতিবছরের মতো হাওরে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত থাকার কথা ছিল। কিন্তু এই সুজন এখন সুনামগঞ্জ শহরের স্টেশন সড়কের কালীবাড়ি মোড়ে। এখানে শ্রম বিক্রির জন্য জড়ো হয় তার মতো অভাবী মানুষেরা।
সুজনের বাড়ি সদর উপজেলার মোল্লাপাড়া ইউনিয়নের বেতগঞ্জ গ্রামে। দুই ভাই, দুই বোনের মধ্যে সে তৃতীয়। গ্রামের পাশে দেখার হাওরে তাদের তিন একর জমিতে বোরো ধান ছিল। এখন সব পানির নিচে। ধান নেই, ঘরে খাবার নেই। পাঁচ দিন ধরে সে শহরে, কাজ খুঁজছে।
কাল বৃহস্পতিবার সকালে কথা হয় ওর সঙ্গে। বলল, ‘বাবার শরীর খারাপ, ঘরে আটজন মানুষ। বড় ভাইও কাজ খুঁজতেছে। আমিও শহরে কাজের লাগি আইছি। কিন্তু কাজ করছি মাত্র দুই দিন। এখানে মানুষ বেশি। কাজ পাওয়া যায় কম।’ তার দুঃখ, ছোট হওয়ার তার মজুরিও কম।
শুধু সুজন নয়, হাওরে ফসলহানির পর সুনামগঞ্জে শ্রমের হাটে অভাবী মানুষের ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। কালীবাড়ি মোড়ে দেড় শ থেকে দুই শ নারী-পুরুষের ভিড়। সবাই এসেছে শ্রম বিক্রির জন্য।
সদর উপজেলার শেখেরগাঁও গ্রামের উজ্জ্বল মিয়ার (২৪) পরনে প্যান্ট-শার্ট। কখনো শ্রমিকের কাজ করেননি। জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ায় হাতে টাকাপয়সা নেই। তাই শ্রমিকের কাজে নেমেছেন। উজ্জ্বল বলেন, ‘কী আর করব, বাঁচতে অইলে তো কাজ করতে অইব। সবাই তো শহরে আইতেছে। কেউ কেউ কাজ পায়। আবার ১০টা-১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা কইরা কাজ না পাইয়া বাড়িত ফিইরা যায়।’
সুনামগঞ্জ শহরের এই শ্রমের হাটে সুজন, উজ্জ্বল, ইসলামপুরের রুহেনা বেগম, হাজেরা বেগমের আসা নতুন হলেও প্রায় ১০ বছর ধরে আসেন কালীপুর গ্রামের আব্বাস উদ্দিন। তিনি জানান, বৈশাখ মাসে এখানে কখনো এত মানুষ আসেনি। বড়জোর প্রতিদিন ২০-২৫ জন হয়। এবার হাওরের ফসলহানির পর থেকে মানুষের ভিড় বাড়ছে। সদর উপজেলা গৌরারং ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা মজর আলী (৪০) বলেন, ‘কাজ-কাম না পাইয়া অনেক মানুষ সুনামগঞ্জ ছাড়ে। এরা কাজের লাগি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, ভোলাগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব যার। বাসস্ট্যান্ডে রাইত অইলে দেখা যায়।’
সুনামগঞ্জের পরিবহন ব্যবসায়ী হোসেন আহমদ জানালেন, ১০-১৫ দিন থেকে হাওর এলাকার ফসলহারা মানুষজন কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছেন। এ কারণে তাঁদের যাত্রীসংখ্যা বেড়ে গেছে।
ক্ষয়ক্ষতির সর্বশেষ হিসাব
সুনামগঞ্জে এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ১৮৮ কৃষক পরিবার। তবে স্থানীয় কৃষক-জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, হাওরের ৯০ শতাংশ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় তিন লাখ কৃষক পরিবার।
গতকাল বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও আগাম বন্যায় বাঁধ ভেঙে হাওরের বোরো ধানের ক্ষয়ক্ষতির এই চিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। পানি কমলে ক্ষয়ক্ষতি পুরোপুরি নিরূপণ করা হবে।
জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ধরমপাশা উপজেলায়। এখানে মোট জমি আবাদ হয়েছিল ৩১ হাজার ৮০০ হেক্টর, ক্ষতি হয়েছে ২৬ হাজার ২৫০ হেক্টর। এই উপজলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ৪৪ হাজার ২২২ জন।
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১০ এপ্রিল থেকে প্রতিদিন জেলায় খোলাবাজারে ৪২টি বিক্রয়কেন্দ্রে ৮ হাজার ৪০০ মানুষের মধ্যে ১৫ টাকা দরে পাঁচ কেজি করে চাল এবং ১৭ টাকা দরে পাঁচ কেজি আটা বিক্রি হচ্ছে। তবে গতকাল থেকে এসব কেন্দ্রে মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। এর বাইরে আরও এক হাজার মেট্রিক টন চাল বিনা মূল্যে বিতরণের কাজ চলছে। একই সঙ্গে নগদ অর্থ সহায়তা হিসেবে পাওয়া ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিতরণ অব্যাহত আছে। জেলার জামালগঞ্জ ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় ১০০ বান্ডিল ঢেউটিন বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলার ক্ষতিগ্রস্ত দেড় লাখ কৃষক পরিবারকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল এবং নগদ ৫০০ টাকা করে দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
খোলাবাজারে বিক্রির চাল-আটার পরিমাণ বেড়েছে
১০ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ৪২টি বিক্রয়কেন্দ্রে কম দামে চাল ও আটা বিক্রি শুরুর পর দাবি ওঠে শুধু উপজেলা পর্যায়ে নয়, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে বিক্রয়কেন্দ্র চালু এবং চাল-আটার পরিমাণ বৃদ্ধি করার। গতকাল থেকে প্রতিটি কেন্দ্রে ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ জনের কাছে চাল-আটা বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু বিক্রয়কেন্দ্র বাড়েনি। যে কারণে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ এসব চাল ও আটা কিনতে পারছে না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফয়জুর রহমান বলেছেন, বিক্রয়কেন্দ্র বাড়ানোর বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। আশা করি এটি হবে।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1161056/