২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ১:৩৬

হাওরে উৎকট গন্ধ

হাওরে হাওরে উৎকট গন্ধ। কালচে পানি। অকাল বন্যার বীভৎসতা ভেসে উঠছে এখন। আর তা কৃষকের কান্নাকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরো।

গোয়াইনঘাট (সিলেট) প্রতিনিধি জানান, ফসল হারানো কৃষকের আহাজারি এখনো অব্যাহত আছে। হাওরের পরিবারে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে চালের বাজার মূল্য। হাওরসহ নিম্নাঞ্চলে পানিতে ধান গাছসহ উদ্ভিদ আগাছা পচে পানি নষ্ট হয়ে মাছের মড়ক তো আছেই। সরজমিন বুধবার গোয়াইনঘাট-জৈন্তাপুরে হাওরসমূহে
পরিদর্শন কালে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও সাধারণ এলাকাবাসী ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র তুলে ধরেন। গোয়াইনঘাটের লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের নিয়াগুল গ্রামের কৃষক ইসলাম উদ্দিন জানান, পরিবার পরিজন নিয়ে আগামী রমজানসহ দিনগুলো কিভাবে কাটবে তা নিয়ে শংকিত। শুধু আমি নই এই গ্রামে আমার মত অগণিত কৃষক পরিবারে একই অবস্থা। ডৌবাড়ী ইউনিয়নের নিহাইন সাতকুড়িকান্দি এলাকার কৃষক জহিরুল ইসলাম জানান, চোখে শুধু অন্ধকার দেখছি। ফসল হারানোর ক্ষয়-ক্ষতি কোনোক্রমেই কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়। ঋণ-ধার করে বোরো ধানের ফসল পরিচর্যাসহ ব্যয় ভার মিটিয়ে ছিলাম। রূপায়িত ফসলও ভালো হয়েছিল। আশা ছিল বাম্পার ফলনের। কিন্তু আকষ্মিক পাহাড়ি ঢল আমার সেই স্বপ্নে আঘাত হানে। গোয়াইনঘাটের উপজেলা কৃষি অফিসার এম আনিছুজ্জামান জানান, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ৮৩২০ হেক্টর রোপায়িত ফসলের মধ্যে ৪২০০ হেক্টরের উপরে বোরো ফসল সম্পুর্ণরুপে বিনষ্ট হয়েছে বলা চলে। তবে তার এ পরিসংখ্যান মানতে নারাজ উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, ভোক্তভোগিসহ এলাকাবাসী। তারা জানান, কৃষি অফিসের অনুমান নির্ভর তথ্যে যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ লিপিবদ্ধ হয়েছে তা সঠিক নয়, প্রকৃত অর্থে এ উপজেলায় বোরো ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হবে ন্যূনতম ১০ হাজার হেক্টর জমি।
গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম চৌধুরী জানান, উপজেলাটি ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় পাহাড়ি ঢল ও স্থানীয় বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়া চলতি বোরো মৌসুমে ১৭১ কোটি ৪৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ উপজেলা দিয়ে প্রবহমান নদীগুলো খনন না করা ও হাওরগুলিকে বেড়িবাঁধের আওতায় না আনাই ফসল হানির অন্যতম কারণ।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, মৌলভীবাজার জেলার হাওর কাউয়া দীঘির হাওরে নতুন করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বোরো চাষিরা আধা-কাঁচা ধান কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ ফসল হারিয়ে অন্যের ক্ষেতে এখন কামলা খাটছেন। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয় জানিয়েছে জেলায় এ পর্যন্ত ৩৪ হাজার ৯২২টি কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলায় চলতি বোরো মৌসুমে প্রায় ৫৩ হাজার হেক্টর বোরো আবাদ হয়। আগাম বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে চলতি মৌসুমে ১ম দফায় (৬ এপ্রিল পর্যন্ত) মৌলভীবাজার হাকালুকি,কাউয়া দিঘি ও হাইল হাওরসহ ৬ উপজেলায় ১৭ হাজার ৪৩২ হেক্টর বোরো ফসলের জমি পনির নিচে তলিয়ে যায়। ফলে বোরো চাষিদের স্বপ্ন চাপা পড়ে পানির নিচে। এ দিকে দ্বিতীয় দফায় (১৯-২৫ এপ্রিল) বৃষ্টিপাতের কারণে সদর উপজেলা, শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় আরো ক্ষতি হয়েছে ১০৫০ হেক্টর বোরো ফসলের। কাউয়া দীঘি হাওর সরজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বেঁচে যাওয়া উজানের জমির পাকা ধান কাটার পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত নিচু জমির আধা-কাঁচা ধানও কেটে তুলছেন কৃষকরা।
ওদিকে গো-খাদ্য সংকটে পড়েছেন হাওর পাড়ের কৃষক। গেল ক’দিন থেকে এ সংকট তীব্র হচ্ছে। হাওর তীরের কৃষক গৃহপালিত পশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। বোরো ধান আর মাছ হারিয়ে যেমন তাদের নিজেদের খাদ্য নেই। তেমনি উপোস থাকছে তাদের গরু, মহিষ ও ছাগল। আর হাঁস, মোরগও। সব হারিয়ে হাওর পাড়ের চাষি ও জেলেদের এখন শুধুই হাহাকার। গেল ক’দিন থেকে গো-খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করায় আর ধান রোপণের সময় মহাজন ও এনজিও সংস্থার কাছ থেকে ঋণ আনায় পাওনাদারদের তাগিদ আসছে বার বার। তাছাড়া মৌসুমেও ঘরে এক সের ধান না থাকায় অভাবের তাড়নায় নিজেদের সংসার চালাতে অনেকটা লোকসান দিয়েই বিক্রি করছেন গরু, মহিষ ও ছাগল। শেষ সম্বল এই গৃহপালিত পশুগুলো বিক্রি করে আগামীতে ক্ষেতের জমি চাষ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আহাজারি করছেন চাষিরা। হাকালুকি, কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওর পাড়ের কৃষক হাওরের বোরো ধানের ওপর যেমন নির্ভরশীল তেমনি তাদের পালিত গুরু, মহিষের পুরো বছরের খাবারের ব্যবস্থা হয় এই ধানের তুষ (কুড়া, গুঁড়া) আর খড় থেকে। তুষ থেকে খাদ্য হয় মোরগ ও হাঁসেরও। কিন্তু এবার হাওর তাদের ঠকিয়েছে। তাই হাওর পাড়ের কৃষক পরিবারগুলো নিজেদের খাদ্যের পাশাপাশি গবাদি পশু নিয়ে এখন চরম বিপাকে পড়েছেন। হাকালুকি হাওর পাড়ের গৌড়করণ গ্রামের কৃষক মোস্তফা মিয়া ৩ একর জমিতে বোরো ধান ফলিয়ে ছিলেন জমির সব ধান তলিয়ে গেছে ঢলের পানিতে। এখন ধানও নেই খড়ও নেই। তার ৫টি গরুর মধ্যে ৪টিই বিক্রি করেছেন। অন্যটিরও দামদর চলছে। উত্তর সাদিপুর গ্রামের কৃষক সালাম মিয়া জানান, চারদিকে পানি থাকায় তার ৬টি গরু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। থাকার জায়গা আর খাদ্য সংকটের কারণে তা বিক্রি করতে চাচ্ছেন। মহেশগৌরি গ্রামের কৃষক মধু মিয়া বলেন আমাদের খাদ্য নেই গরুগুলোরও খাদ্য নেই। তার ১১টি গরুর মধ্যে বিক্রি করেছেন ৩টি। বাকি ৩টি বিক্রি করবেন ও ৫টি আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পাঠাবেন আপৎকালীন সময়ের জন্য। মীরশংকর গ্রামের কৃষক তাজউদ্দিন ও সাদিপুর গ্রামের কৃষক বেলাল মিয়া জানালেন তাদের সব ক’টি গরু লোকসান দিয়েই বিক্রি করেছেন। হাওরে থইথই পানি। আশপাশে রাখার মতো কোনো জায়গা নেই। তাই গেল সপ্তাহ দিন থেকে বাড়িতে গরুগুলি এক ঘরে বন্দি। ঘাস নাই খড় নাই। তাদের ক্ষুধার জ্বালার হাক ডাক ভালো লাগে না। অন্য কোথাও থেকে যে খড় কিনব সেই টাকা-পয়সাও নাই। নিজে খাইতে পারছি না আর গো-খাদ্য কিনব কি ভাবে। ওদের আর না খাইয়ে রাখতে চাই না। পোষা প্রাণীগুলোর এমন কষ্ট সহ্য হয় না তাই বিক্রি করে দিলাম। অন্য গৃহস্থের ঘরে গিয়ে যাতে তারা শান্তিতে থাকে।
নিকলী (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, পানিতে তলিয়ে গেছে জমি। চড়া মূল্যেও মিলছে না শ্রমিক। টানা বৃষ্টিতে কাটা ধানে গজিয়ে উঠেছে চারা। শতভাগ ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনায় ধান আর কাটছেন না কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা নিকলীর কৃষকরা। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নিকলী উপজেলার সিংপুর, কারপাশা, দামপাড়া, নিকলী সদর ও ছাতিরচর ইউনিয়নের কৃষকদের দুরবস্থা। ইউনিয়নগুলোর ৮০ ভাগ ফসল তলিয়ে গেছে পানির নিচে। প্রতি মুহূর্তেই পানি বাড়ছে। শ্রমিক নিয়ে পৌঁছার পূর্বেই পানিতে জমি তলিয়ে যাচ্ছে। ধানকাটা মওসুমে পার্শ্ববর্তী জেলা ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দিনমজুররা পানির ভয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজ এলাকায়। স্থানীয় দিনমজুরদের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি দিনমজুরের শ্রম মূল্য দিতে হচ্ছে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। কোনো রকম কেটে আনা ধানও বৃষ্টির কারণে শুকাতে পারছেন না কৃষকরা। স্তূপ করে রাখা ধানে চারা গজিয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে ধান কাটতে কৃষকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অনীহা।
কারপাশা গ্রামের কৃষক সুজন মিয়া বলেন, আমাদের জমি বড় হাওরে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গরু বাছুরের খাদ্য খড়টুকু পর্যন্ত আনতে পারিনি।
তিনি জানান, প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ ৪শ ৫০-৫শ টাকা। পানির মধ্যে একজন শ্রমিক ১মণ থেকে দেড় মণ ধানের জমি একদিনে কাটতে পারে। মাড়াই পর্যন্ত প্রতিমণে খরচ দাঁড়াচ্ছে দেড় হাজার টাকার অধিক। তাও পানিতে নষ্ট হয়ে যাওয়া ধান, যা বাজার মূল্য ৪-৫শ টাকা।
জোয়ানশাহী হাওরের জিরাতি নিকলী নাগারছি হাটি গ্রামের কৃষক জাফরান মিয়া। কাঁদো কাঁদো গলায় জানান, ২০ একর জমি করেছিলাম। ৫ একরের মতো কাটতেই পানি বেড়ে গেছে। বাকি জমি ফেলে রেখেই চলে এসেছি।
মোহরকোণা গ্রামের মোজানল হাওরের জিরাতি কৃষক কফিল উদ্দিন জানান, পরিবারের নারী-পুরুষসহ ৬ জন হাওরে থেকে ৬ একর জমি করেছিলাম। শূন্য হাতে বাড়ি ফিরেছি। লগ্নির টাকা দিচ্ছি অর্ধেক দামে ৪টি গরু বিক্রি করে।
নিকলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুণ অর রশীদ জানান, এ উপজেলার ১৫ হাজার ১২৫ হেক্টর বোরো আবাদি জমির মধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর। পানি বাড়তে থাকায় বাদবাকি জমি কাটাও অনিশ্চিত। তিনি জানান, এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ জমি কৃষক কাটতে পেরেছে। টানা বৃষ্টিপাতের কারণে সেগুলোতে ভ্রুণ গজিয়ে যাওয়ায় পুষ্টিমান ও শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। এসব চালের ভাত খেতে তিতা স্বাদের হবে। হাঁস-মুরগি খেলেও অসুখ হতে পারে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=63299&cat=3/-