২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ১:৩৫

পরিবহন শ্রমিকদের বঞ্চনার জীবন

বাস চালক আবদুল কুদ্দুস। রুগ্ন দেহ, ভগ্ন শরীর। পরনে ময়লা-ছেঁড়া শার্ট-প্যান্ট। গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে সতর্কাবস্থায়। বয়স ৪৫ বছর। জীবন কেমন চলছে জানতে চাইতেই তার চোখে-মুখে ফুটে উঠলো বিষণ্নতার ছাপ।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, জীবনের চাওয়া-পাওয়া, সুখ-শান্তি, সবকিছু ভুলে কঠিন কষ্টে দিন পার করছি। বঞ্চনার শিকার হচ্ছি মালিকদের কাছে। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করেও স্ত্রী-সন্তানের মুখে ভালো-মন্দ খাবার জুটাতে পারছি না। দীর্ঘদিন গাড়ি চালিয়ে এখনো দিন এনে দিন খাচ্ছি। অন্য পেশার লোকের মতো জীবনে কোনো সঞ্চয় বা সম্পদ অর্জন করতে পারিনি। বেশির ভাগ পরিবহন শ্রমিকেরই একই দশা বলে জানালেন তিনি।
শুধু কুদ্দুস নয়। একে একে বাস ও অটোরিকশার অন্তত ১০ জন চালকের সঙ্গে কথা বলে সবার জীবনই কষ্টে মোড়ানো। জীবনের কষ্টে যেন কারো চেয়ে কারো যেন কমতি নেই। গাড়ি মালিকের শোষণ ও বঞ্চনায় হতাশার সাগরে ডুবে থেকেও যেন তাই ভুলে আছেন তারা। মালিকরা আদায় করছে দেড়-দুইগুণ বাড়তি ভাড়া। প্রাপ্য বেতন না দিয়ে পরিবহন শ্রমিকদের শোষণ করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম হলেও ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা। তারপরও চলছে না তাদের পরিবার। অনেক ক্ষেত্রে ভাড়া না দিয়ে কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়ে শ্রমিকদের অমানবিকভাবে বিনাবিশ্রামে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। দেয়া হচ্ছে না শ্রমিকের চিকিৎসা ব্যয়। সব সময় জীবনের ঝুঁকিতে থাকা পরিবহন শ্রমিকরা দুর্ঘটনার শিকার হলেও দেয়া হচ্ছে না চিকিৎসা খরচ।
কুদ্দুসের পিতা বরিশাল থেকে দীর্ঘদিন আগে ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। তৃতীয় সন্তান কুদ্দুস ১৩ বছর বয়সে গাড়ির হেলপারের কাজ নেন। সেখানেই কেটেছে তার ১৫ বছর। এরপর থেকে গত ১৮ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন। এখন চালান ৬ নম্বর রুটের একটি বাস। কমলাপুর-পীরজঙ্গি মাজার-বনানী-গুলশান রুটে। দীর্ঘদিন ধরে এক মালিকের গাড়ি চালান তিনি। ওই রুটে দিনে একবার করে যাওয়া-আসার মোট ৪ ট্রিপে মালিককে দিতে হয় ৯ হাজার টাকা। এর বাইরে দিনে ১ হাজার ১০০ টাকা রুট খরচ, অপর দুই সহকারী নিয়ে তিনজনের খাবারের খরচ ৩০০। রাত দিন ২৪ ঘণ্টার অবর্ণনীয় পরিশ্রমের মূল্য হিসেবে প্রতি ট্রিপের জন্য পাচ্ছেন ২০০ টাকা করে। এতে প্রতিজন দিনে ৪ ট্রিপে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকার মতো বেতন পান। আর নির্ঘুম রাত কাটানোর পরদিনই থাকতে হয় পূর্ণ বিশ্রামে। অর্থাৎ এক দিনের আয়ে চলতে হচ্ছে দু’দিন। পরের দিন একই বাস চালান অপর তিন চালক-হেলপার। আর মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে মাসের ১৫ কর্মদিন থেকে আরো কয়েক দিনের আয় খোয়া যায়। আবার এর মধ্যে শুক্রবার ও শনিবার অফিস বন্ধের দু’দিন আয়ও কম। আবার অফিস খোলার দিন যানজট। ফলে নানা শোষণ-বঞ্চনা ও প্রতিবন্ধকতায় অল্প আয়ে অনেকটা ধারদেনায় খেয়ে-কম খেয়ে দিন কাটছে।
এ অবস্থায় মাসে তার আয় ১৫ থেকে ২০ হাজার। তাতেও না চলায় স্ত্রী কুলসুমও একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তার আড়াই হাজার টাকা বেতনের পুরুটায় যায় মান্ডা এলাকায় ঘর ভাড়ায়। আর আমার টাকায় হাট-বাজারসহ নাইনে পড়ুয়া বড় মেয়ে কহিনুর ও থ্রি’তে পড়ুয়া সুমার পড়ার খরচের পেছনে। তার বয়স ৪৫ বলাতে কয়েকজন যাত্রী আপত্তি তুলে ৬০-৬৫ হবে বলে মন্তব্য করেন। জবাবে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বলেন, এই ইঞ্জিনের গরম, রোদের গরম, যাত্রীদের ঝামেলা, ধুলাবালি খাওয়া, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক না থাকা, সব সময় গভীর মনোযোগে সতর্ক থাকা- এসব কারণে কম বয়সেই চালকরা চুল-দাড়ি পেকে বুড়িয়ে যায়। চালকের কষ্টগাথা শুনে সাইফুর রহমান নামে এক যাত্রী বলেন, আসলে আমরা চালক-হেলপারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে কটু কথা বলি। তাদের বাস্তবতা বুঝে যাত্রীদেরও মানবিক হওয়া উচিত।
তবে বাসা ভাড়া দেয়ার ঝামেলা না থাকলেও প্রায় অভিন্ন কষ্ট হাজারীবাগের বাসিন্দা একই রুটের বাসচালক বাবুল আহমেদেরও (৫৬)। ২৪ বছর বয়সে হেলপারের কাজ শুরু করে ১০ বছর কেটেছে সে কাজে। পরের ২২ বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন। তবে ৩২ বছরের পেশাগত জীবনে বাড়িঘর বা তেমন কিছু করতে পারেননি। নেই তেমন সঞ্চয়ও। তার দুই মেয়ে কানিজ ফাতেমা ও মেহবুবা সুলতানার বিয়ে দিয়েছেন। এখন স্ত্রী রাজিয়া বেগম ও একমাত্র ছেলে রাসেলকে নিয়ে সংসার। কিন্তু সচ্ছলতা বলতে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন। তার উপরে মালিকরাও তাদের বিভিন্ন সময় লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে এবং রাস্তায় নামায় বলে জানান তিনি।
বাবুল বলেন, আমরা পরিবহন শ্রমিকরা মালিকের শোষণের শিকার হচ্ছি। ট্রাফিক পুলিশ ও যাত্রীদের কাছে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। বেশি আয় তো দূরের কথা, যানজটের কারণে নির্ধারিত ট্রিপগুলো মারতে না পারলে উল্টো পকেট থেকে টাকা দিতে হয়। এ অবস্থায় বর্তমানে পরিবহন শ্রমিকরা জীবনের নিরাপত্তায় সঞ্চয় বা সম্পদও গড়তে পারছে না। ফলে পরিবহন শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
শফিকুল ইসলাম নামে এক গাড়ি মালিক বলেন, আমি ৫৬ লাখ টাকায় গাড়ি কিনে রাস্তায় দিয়ে কত টাকা পাচ্ছি। এর থেকে তো গাড়ির গ্যাসসহ অন্যান্য খরচ বহন করতে হচ্ছে। প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা গাড়ির ভাড়া নেয়ার বিষয়টি দেখছেন, কিন্তু সেখান থেকে আমরা অন্যান্য খরচ বহন করছি তাও তো দেখতে হবে। খরচ দেয়ার পর ওই টাকার অর্ধেকও টিকে না।
অটোরিকশায় মালিকদের শোষণ যেন আরো বেশি। গাড়ি মালিকরা ৯০০ টাকা করে প্রতিদিন ভাড়া পাওয়ার কথা থাকলেও চালকদের কাছ থেকে আদায় করছে ৯০০ থেকে ১৪০০ টাকা পর্যন্ত। আবার ওই ৯০০ টাকা থেকে প্রতিদিন ২০০ টাকা করে গ্যাস বিল শোধ করার কথা থাকলেও সেখানে চলছে শুভঙ্করের ফাঁকি। মালিকরা ওই টাকা চালকদের শোধ করছে না। ফলে চালকদের ওপর চেপেছে তাও। এতে চালকরাও যাত্রীর কাছ থেকে হরহামেশাই মিটারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করছে। ধীরে ধীরে মিটারের পরিবর্তে দরকষাকষির রেওয়াজ ফিরে আসছে। শোষণ ও বঞ্চনায় পরিবার নিয়ে অভাব-অনটনে রয়েছে এই মধ্য বা নিম্ন আয়ের পেশাজীবী গাড়ি চালকরা।
অটোরিকশা ঢাকা মেট্রো থ-১১-৮৬৩৯ নম্বর গাড়ির চালক মো. মুজিবুর রহমান আগে রিকশা চালাতেন। ১০ বছর ধরে অটোরিকশা চালান। এক মালিকের গাড়ি চালাচ্ছেন ৮ বছর ধরে। প্রতিদিন দেড় থেকে দু’হাজার টাকা আয় তার। এর থেকে ২৫০ টাকা গ্যাস বিল, ২০০ টাকা খাওয়া, বিভিন্ন পয়েন্টে অপেক্ষার জন্য ১০ থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা, লাইন খরচ ও ট্রাফিক পুলিশকে চাঁদাসহ রাস্তায় কয়েক খাতে খরচ আছে। তিনি বলেন, ভাই আমাদের কষ্টের কোনো শেষ নেই। কোন কষ্ট রেখে কোনটা বলি। প্রতিমাসে আমার অন্তত ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা আয় হলে কোনোমতে চলতে পারি। সেখানে আয় হয় ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। ফলে প্রতিমাসের শেষে দেনায় পড়তে হয়। আমার কাছে এক ব্যক্তির পাওনা ৮০ হাজার টাকা শোধ করতে পারছি না অন্তত ৭ বছর ধরে। স্ত্রী ময়নাও কোনো রোজগার করে না। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে না পারায় পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে চাইছি। কিন্তু সে রাজি হচ্ছে না। পড়াশোনা করতে চায়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া দ্বিতীয় মেয়ে শিউলি আক্তারের পড়াশোনার খরচ চালাতেও এখন গায়ে লাগছে। আর ২ বছরের ছোট ছেলে নূর মোহাম্মদের তো এখন স্কুলের যাওয়ার বয়সই হয়নি। আমার সন্তানদের জীবনই এখন অনিশ্চিত। অথচ তা মালিকরা বুঝে না। আমাদের দিয়ে কামিয়ে নেয়ার ধান্ধায় থাকে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, গাড়ি মালিকরা নানাভাবে চালক ও পরিবহন শ্রমিকদের শোষণ করে যাচ্ছে। পরিবহন শ্রমিকদের তাদের ন্যায্য অধিকার না দিয়ে অমানবিকভাবে তাদের বাড়তি রোজগারের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ এই শ্রমে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটানো হচ্ছে। এটা চরম অমানবিক। কিন্তু মালিকরা নানা খোঁড়া অজুহাতে কেবল পুঁজির জোরে মানবতাকে লঙ্ঘন করছে। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থান প্রয়োজন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=63243&cat=6/