২৮ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ১২:৫৪

বেশি দামে ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানি প্রসঙ্গে

গত বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা কমিটির এক সভায় ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির যে সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে তার বিরুদ্ধে সকল মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। গতকাল দৈনিক সংগ্রামহ জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাইতেও এই মূল্যহার প্রতি ইউনিটে গড়ে ২৯ পয়সা বেশি। আদানি পাওয়ার লিমিটেড নামের ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৮৯ পয়সা দরে আমদানির এ সিদ্ধান্তের কারণে ১৬শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে আগামী ২৫ বছরের সরকারের ব্যয় হবে এক লাখ ৯০ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। কেন দেশের চাইতে বেশি মূল্যে কেনা হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, ভারতের এই বিদ্যুৎ আনতে হবে ঝাড়খ- রাজ্যের এমন এক এলাকা থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। এ ৯০ কিলোমিটারের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, করপোরেট ট্যাক্স ও অক্সিলিয়ারি কনজাম্পশনের কারণেই বেশি দাম দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এর পর রয়েছে সীমান্ত থেকে বগুড়া পর্যন্ত ১৪০ কিালোমিটার দীর্ঘ চারশ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ব্যয়। এসব খরচের হিসাব ধরেই ভারতীয় বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করেছে সরকার।


উল্লেখ্য, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানির ব্যাপারে লক্ষ্যণীয়ভাবে তৎপরতা চালিয়ে এসেছে। সে তৎপরতার ফলশ্রুতিতে প্রথমে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে দু’দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতার একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীকালে ওই চুক্তির ভিত্তিতে ২০১৫ সালের আগস্টে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ রফতানির জন্য ভারতীয় কোম্পানিটি আটশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপযোগী একটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি। এরই মধ্যে গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটি সরকারের কাছে সমন্বিত কারিগরি ও বাণিজ্যিক প্রস্তাব পেশ করে। প্রস্তাবটি নিয়ে সরকারের ভেতরে আলাপ-আলোচনা করা হলেও এর বিস্তারিত বাইরে প্রকাশ করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ দেশীয় কোনো কোম্পানি সরবরাহ করতে পারবে কি না তা যেমন খোঁজ করা হয়নি তেমনি ওপেন বা মুক্ত টেন্ডারেরও আয়োজন করেনি সরকার। এতেই পরিষ্কার হয়েছিল, ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের কাছ থেকে আমদানি করার ব্যাপারে এমন কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছেÑ যার কারণে সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সরকারকে লুকোচুরি করতে হয়েছে।


ভারত থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে যে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে আমরা তাকে খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে করি। কারণ, বেশির ভাগ প্রকাশিত রিপোর্টে ইউনিট প্রতি ২৯ পয়সার কথা বলা হলেও এসবের পাশাপাশি রয়েছে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো আরো কিছু তথ্য। যেমন জানা গেছে, প্রকৃত দাম তথা টাকার পরিমাণ নির্ভর করবে মার্কিন ডলারের বাজার দরের ওপর। ডলারের দাম বাড়লে ভারতীয় বিদ্যুতের দামও বাড়বে। তেমন অবস্থায় এখন যা ভাবা বা বলা হচ্ছে বাস্তবে গ্রাহকদের তার চাইতে অনেক বেশি মূল্য গুণতে হবে। বিষয়টি অবশ্যই ভেবে দেখা উচিত ছিল। কারণ, বিগত মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে মার্কিন ডলারের দাম পাঁচ টাকারও বেশি বেড়ে গেছে। স্বাভাবিভাবেই এর প্রভাব পড়বে ভারতেও। ফলে ভারতীয় কোম্পানি বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেবে রাতারাতি। উল্লেখ্য, চুক্তিতে কিন্তু টাকা বা রুপির কথা বলা হয়নি। বরং দাম নির্ধারণ করা হয়েছে মার্কিন ডলারের ভিত্তিতে। সুতরাং ভারতীয় কোম্পানিকে বলতেও হবে না, দাম বাড়াতে হবে এমনিতেই।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে বিদ্যুতের বিরামহীন সরবরাহ পাওয়ার বিষয়টি। কারণ, যান্ত্রিক ত্রুটির ফলে যে কোনো সময় উৎপাদন যেমন বাধাগ্রস্ত হতে পারে, তেমনি কোনো অজুহাত দেখিয়ে ভারতীয় কোম্পানি নিজেও সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ করতে বা কমিয়ে দিতে পারে। এ ধরনের বিষয়ে বাংলাদেশের স্বার্থে চুক্তিতে কোনো গ্যারান্টি ক্লজ রাখা হয়েছে কি না এবং রাখা হলেও ভারতীয় কোম্পানিকে বাধ্য করার কোনো ব্যবস্থা রয়েছে কি নাÑ এ ধরনের কোনো বিষয়েই সরকার জনগণকে কিছু জানতে দেয়নি। আশংকার বড় কারণ হলো, চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে। ভারত সরকারের সঙ্গে নয়। সে কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সব সময় অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত ভীতিকর অন্য একটি তথ্য হলো, প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে বিদ্যুতের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাবে অন্তত ২৪ শতাংশ, যা কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্যই শুভ হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া ভারতের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সংকটসহ দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ককেও বিবেচনায় রাখা দরকার। কারণ, বাংলাদেশে কখনো সরকার পরিবর্তন হলে এবং সে সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে দ্বন্দ্ব বা তিক্ততার সৃষ্টি হলে বাংলাদেশকে নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।
এভাবে বিভিন্ন সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নেয়া হলে স্বীকার করতে হবে যে, ভারতের কোনো কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। সরকারের উচিত দেশের অভ্যন্তরে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা।

http://www.dailysangram.com/post/281729