২৩ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ৯:২৭

৫২টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ১৭টিই বন্ধ

গ্যাসসহ নানা সংকটের কারণে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতে করে একদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার প্রবণতা যেমন বাড়ছে তেমনি চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ পাচ্ছে না গ্রাহক। অনেক স্থানে ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং বাড়ছে। আবার পল্লী এলাকায় বৃষ্টি শুরু হলেই বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ গ্রাহকরা রয়েছে অনেক বিড়ম্বনায়। অপরদিকে গ্যাসভিক্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো একের পর এক বন্ধ হওয়ার কারণে আগামী রমযান মাসে চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে পিডিবি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে ৫২টি। এগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা সাত হাজার ১৬৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাস সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে ১৭ টি কেন্দ্র। ফলে সক্ষমতা থাকলেও এক হাজার ৮২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে আগামী রোযায় চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশংকা রয়েছে। ওই সময় লোডশেডিং বাড়ার সংশয় প্রকাশকরছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে আগামী রমযান মাসে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়। রোযার মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিস্থিতি পর্যালোচনায় করা হয়। এছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহের সার্বিক অবস্থা, গ্যাস সরবরাহ ও ঘাটতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে রোযায় লোডশেডিং মোকাবিলায় গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন, গ্যাস সংকটে দেশের ১৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২৮টি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। সংকট মোকাবেলায় জরুরী ভিত্তিতে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস, এলএনজি আমদানীর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সাথে নতুন করে ১০৮টি কুপ খননের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত কয়েক বছর ধরে রোযায় বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধি ও গ্রীষ্মে রোযা হওয়ায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াই এর মূল কারণ। এর ধারাবাহিকতায় এ বছরও চাহিদা বাড়বে। উৎপাদন সক্ষমতা এর চেয়ে বেশি হলেও গ্যাস সংকটে তা পূরণ করা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। ফলে লোডশেডিংয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
বৈঠকে জানানো হয়, ২০১২ সালে রোযায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ছয় হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৯০০ মেগাওয়াট, ২০১৪ সালে সাত হাজার ৫০০, ২০১৫ সালে ৮ হাজার ১২২ ও ২০১৬ সালে নয় হাজার ৩৬ মেগাওয়াট। আর ২০১৭ সালে রোযায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে ১০ হাজার ২০০ মেগাওয়াট হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ চাহিদা পূরণে কমপক্ষে দৈনিক এক হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দরকার হবে। তবে গত মাসে সর্বোচ্চ ৯৩৭ ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।
এদিকে বর্তমানে ১৭টি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে টঙ্গীর ১০৫ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটিতে প্রয়োজন ২৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে পুরো কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে আছে। একইভাবে বন্ধ শিকলবাহার ৪০ মেগাওয়াট, বাঘাবাড়ির ১৭১, শিকলবাহা পিকিং প্লান্টের ১৫০ এবং সিলেটের ১৪২ ও ২০ মেগাওয়াট কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আছে। আর আংশিক বন্ধ আছে আরপিসিএল সিসিপিপি, সিদ্ধিরগঞ্জ, হরিপুর পাওয়ার, চট্টগ্রামের ইউনিট ১ ও ২ এবং শাহজীবাজারের ৮ ও ৯নং প্লান্টের।
সূত্র জানায়, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ঘোড়াশাল ৩ ও ৫নং ইউনিট এবং আশুগঞ্জের ২নং ইউনিট বন্ধ রয়েছে। এগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৪১৩ মেগাওয়াট। গত মাসে বন্ধ রাখা কেন্দ্রগুলো কবে নাগাদ চালু হবে তাও নিশ্চিত নয়।মাত্র কয়েকবছর আগেই দেশের ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল গ্যাস নির্ভর। সংকট বাড়তে থাকায় গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন নেমে এসেছে ৬৪ শতাংশে। ঘোড়াশাল, চট্টগ্রাম, শিকলবাহা, আশুগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, হরিপুর, টঙ্গিসহ বিভিন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৭ টি ইউনিট গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না।
গত ১৩ মার্চ দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য এক হাজার ১৯৮ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দরকার। তবে সরবরাহ করা হয় ৮৮৭ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে এক হাজার ৮২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল। আর ৪ মার্চ সর্বোচ্চ ৯৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয় গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী রোযায় লোডশেডিং হবে। যদিও আগামী রোযায় ১০ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ১১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের।
পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ দাবী করেন, এ বছর রোযায় বিদ্যুতের চাহিদা ১০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও গত ২০ এপ্রিল সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট উৎপাদন রেকর্ড করা হয়েছে। তবে রোযার চাহিদা পূরণে সক্ষমতা রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি কেন্দ্রগুলো।
তিনি বলেন, গ্যাস সংকটে কয়েকটি কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া তিনটি কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলছে। তবে রোযায় লোডশেডিং যাতে না হয় সেজন্য গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে পেট্রোবাংলাকে অনুরোধ করা হয়েছে। এখনও নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। গ্যাস সরবরাহ ঠিক থাকলে রোযায় কোনো লোডশেডিং হবে না বলেই আশা করা যায়।
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসেবে, ১৩শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলে দেশের সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু রেখে উৎপাদন হতো ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু এখন উৎপাদন সীমিত থাকছে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে। গ্যাস অনুসন্ধানে দেশের স্থলভাগে ১০৮টি কুপ খননের কাজ শুরু করলেও সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে হতাশ মন্ত্রণালয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলছে, আগামী বছরের মধ্যে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি এলে সংকট কিছুটা কমবে। তবে, নিশ্চিত করেই বলা যায় আগামী বছরের মার্চে আসছে ৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি।

http://www.dailysangram.com/post/280917-