২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৩

হাকালুকিতে পচেছে ধান মরছে মাছ ও হাঁস : ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা

এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে ধান পচে, মাছ ও হাঁস মরে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে গণহারে ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে হাওর এলাকার মানুষের মধ্যে। মৎস্য বিভাগ জানায়, তৃতীয় দিনের মতো চুন ও ওষুধ ছিটানো অব্যাহত রয়েছে। তবে শুক্রবারও হাওরে আগের দিনের কিছু মরা মাছ ভাসতে দেখা গেছে। অকাল বন্যায় হাকালুকি হাওরের ধান নষ্ট হওয়ার পর মাছ ও হাঁস মরে যাওয়ার ঘটনা ছিল সেখানকার মানুষদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। কিন্তু স্থানীয় জনগণের দুর্দশা এখানেই শেষ হয়নি। তারা বলছেন, ওই এলাকায় দূষিত মরা মাছ খেয়ে মরছে পোষা হাঁস। এতে গরিব কৃষকসহ খামারিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। হাকালুকি হাওরের পাশের অনেক মানুষের জীবিকা হাওরে হাঁস পালনের ওপর নিভর্রশীল। হাওরে বিচরণ করা এমন শত শত হাঁস মরে ভেসে উঠছে।


কুলাউড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: সাইফুদ্দিন জানান, হাঁসের মড়ক প্রতিরোধে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হাওরে চিকিৎসক টিম হাঁসের মধ্যে ভ্যাকসিনসহ ওষুধ দেয়ার কাজ শুরু করেছে। পাশাপাশি হাওরে হাঁস না ছাড়ার জন্য খামারিসহ কৃষকদের সচেতনতামূলক পরামর্শ দেয়ার কাজ চলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডুবে যাওয়া ধানে ব্যবহৃত কীটনাশক ও সার পানিতে মিশে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, আধাপাকা ধান ও ধান গাছ পচে পানির গুণাগুণ নষ্ট করেছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। ফলে হাওরাঞ্চলের সর্বত্র মাছ মরে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এই হাওরে খাবার খেয়ে মারা যাচ্ছে হাঁসও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক ড. মামুনুর রশিদ বলেন, বন্যার পানিতে আধপাকা ধান পচে পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিষাক্ত পানি খেয়ে হাঁস মারা যাচ্ছে।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের প্রধান ড. নাসরিন সুলতানাও হাঁস ও মাছের মৃত্যুর জন্য বিষক্রিয়াকেই দায়ী করেছেন। তার মতে ধান পচেই এটা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মরা মাছ বা হাঁস খেলে মানুষের বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের তি হতে পারে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সভাপতি ড. মো: শাহাবউদ্দিন বলেন, পচা মাছ থেকে বের হওয়া অ্যামোনিয়ায় হাওরের পানি মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। মরা মাছ বা পাখি কেউ যেন কোনো অবস্থাতেই খেতে না পারে তার জন্য নজর রাখা দরকার।
হাওরপাড়ের ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির জানান, হাকালুকি হাওর তীরের বিভিন্ন মৎস্যজীবী গ্রামে মাছ ধরা ও খাওয়া বন্ধ করতে জনসচেতনতামূলক সভা করেছে। মৎস্যজীবীদের সব প্রকার মাছ শিকার থেকে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অবশ্য পরিস্থিতি দেখে মৎস্যজীবীরাও মাছ শিকার থেকে বিরত রয়েছেন। দেশের প্রধান এই মিঠা পানির মৎস্য ভাণ্ডারে মাছে একটা বিপর্যয় নামতে পারে।
কুলাউড়া উপজেলা হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৫ এপ্রিল রাতে ঝড়ের পর ভয়াবহ দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ এপ্রিল থেকে কুলাউড়া হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। ১৬ থেকে ২১ এপ্রিল এই ছয় দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে দেড় শতাধিক রোগী। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ১০০ জন এবং বহির্বিভাগে আরো চার শতাধিক ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই হাওরপাড়ের লোকজন।
কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মোহাম্মদ নূরুল হক জানান, গরম সেই সাথে হাওরের পচা পানিতে একটা বিপর্যয় তো হবেই। পচা পানি কোনো কাজেই ব্যবহার করা যাবে না এবং থালা বাসনও ধোয়া যাবে না। হাওরাঞ্চলে ডায়রিয়া পরিস্থিতি এবং গোটা উপজেলার পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রত্যেক ইউনিয়নে মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে।

হাকালুকি হাওর পরিদর্শন করল উচ্চপর্যায়ের সমন্বিত টিম
এ দিকে উচ্চপর্যায়ের সমন্বিত টিমের বৃহস্পতিবার হাকালুকি হাওর পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সাথে কথা বলেন। এ দিকে হাকালুকি হাওর তীরের ছয় ইউনিয়নের বাসিন্দাদের জন্য ২০ টন চাল ও নগদ ৯৫ হাজার টাকা সরকারি বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়েছে। সরেজমিন হাকালুকি হাওর পরিদর্শন টিমে ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সৈয়দ মেহেদি হাসান, মৎস্য অধিদফতরের উপপরিচালক (রিজার্ভ) মো: রমজান আলী, মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকার্তা আ ক ম শফিক-উজ-জামান, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাসুদ, ইউএনও জুড়িসহ মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এ দিকে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী মো: গোলাম রাব্বি জানান, হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়া উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের জন্য সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২০ টন চাল ও নগদ ৯৫ হাজার টাকা অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি সাহায্য হাওরপাড়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/214096