২২ মার্চ ২০২৩, বুধবার, ৮:১২

সংযমের রমজানেও ঢালাও অসংযম

‘আরও বেশি করে কেনেন। এখনও বেগুনের কেজি ৮০ টাকায় আছে। রোজা ঢুকলেই কেজি ১০০ ছাড়াবে।’ রাজধানীর জিগাতলা বউবাজারের ক্রেতার কানে এভাবেই ‘পরামর্শ’ ঢাললেন সবজি বিক্রেতা তাজুল ইসলাম। লেবুর হালি ৪০ টাকা শুনে ভিরমি খেলেন আরেক ক্রেতা। সঙ্গে সঙ্গে বিক্রেতা মোতালেব হোসেনের বক্রোক্তি, ‘এটাই বেশি মনে অয়! শুইনা রাখেন– রোজায় ৮০ হইব।’
বাজারে দামের আগুনে পুড়তে থাকা ক্রেতা রোজার দিন দশেক আগে থেকেই শুনছেন, সামনে দাম আরও বাড়বে। কী কারণে বাড়বে? এর জবাবে বেশি করে বেগুন কেনার পরামর্শ দেওয়া তাজুল বললেন, রোজায় সবার বেগুনি লাগবে। বেগুনের চাহিদা বাড়বে। তাই দামও বাড়বে। লেবু বিক্রেতা মোতালেবের জবাব, ইফতারে শরবতের চাহিদা বাড়ে, তাই লেবুরও দাম ছুটবে।
অর্থনীতির পুরোনো সূত্র– জোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হলে দাম বাড়ে। সেই রসায়নে রোজা এলে বেড়ে যায় সব সদাইয়ের দরদাম। যদিও গত মঙ্গলবারই সুদূর আরব আমিরাত থেকে খবর এসেছে, রমজান উপলক্ষে দেশটির সব সুপারশপে ১০ হাজার রকমের খাদ্যপণ্য ৭৫ শতাংশ ছাড়ে কিনতে পারবেন ক্রেতা। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অনেক মানুষ গর্ব করেন। ইসলামের বিধান মেনে অধিকাংশ মানুষ রোজা রাখলেও রমজান এলে নিত্যপণ্যের দাম এখানে উল্টো বাড়ে!

কেন বাড়ে? সাধারণ মানুষের কাছে এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছে সমকাল।
উত্তর সরল। রোজার মানে সংযম হলেও ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষই অসংযত। বিত্তবান ক্রেতা কেনেন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্য। তাতে বাজারে পড়ে জোগানের টান। আবার বিক্রেতার কাছে রোজা মানে ‘ব্যবসার মাস’। চাহিদা বেশি, তাই দাম যা হোক, প্রয়োজন মেটাতে ধনী-গরিব সব ক্রেতা কিনতে বাধ্য।

ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন, রমজানের শিক্ষার উল্টো পথে চলছে বাংলাদেশ। শুধু নিত্যপণ্যের দাম নয়, ঈদের ছুতায় উপঢৌকন বা ঘুষের রেটও থাকে বাড়তি! যার ঘুষ নেওয়ার ক্ষমতা নেই, তিনিও ঈদের ধুয়া তুলে চান বকশিশ। যাঁর পেশিশক্তি আছে, তাঁর ঈদ উদযাপনের অনুঘটক চাঁদা।

এ প্রসঙ্গে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা রুহুল আমিন বলেন, ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি রমজান। তা মেনে রোজা রাখলেও রমজান মানে যে সংযম, তা মানছে না কেউ। রোজা মানে শুধু দিনভর উপোস নয়; রোজার মর্মার্থ, জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংযমী হতে হবে। কম খেতে হবে। ভোগবিলাস ত্যাগ করতে হবে। লোভ-লিপ্সা, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতে হবে। করতে হবে দান ও ক্ষমা।

তিনি আরও বলেন, কী দিয়ে ইফতার করতে হবে? সাহাবিদের এমন প্রশ্নে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছিলেন, ‘একটি খেজুর দিয়ে, এক গ্লাস দুধ বা শরবত দিয়ে অথবা এক গ্লাস সাধারণ পানি দিয়ে হলেও সমান সওয়াব পাওয়া যাবে।’ এই হাদিসে স্পষ্ট, ইফতার খুবই সাধারণ এবং পরিমাণে সামান্য।

অন্যায্য দাম বাড়ানোকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) জুলুম আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর উম্মত হিসেবে তাঁকে অনুসরণ করা মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। তবে বাংলাদেশে রোজার মাসের ছবি পুরো উল্টো। ইফতার ও সেহরিতে ভূরিভোজ রীতিতে পরিণত হয়েছে। ত্যাগ নয়, ভোগের মাসে পরিণত হয় রমজান। নিম্ন মধ্যবিত্তও সামর্থ্যের বেশি খরচা করেন রোজায়। আর এর সুযোগ নেন ব্যবসায়ীরা। রোজায় দামের পাগলা ঘোড়া ছোটে।

ইসলাম রমজানে দান ও দয়ায় গুরুত্ব দিলেও বাংলাদেশের রোজাদারের অধিকাংশ রহম করেন না। রোজা রাখলেও ব্যবসায়ীরা দামে ছাড় দূরে থাক, যতটা পারেন বাড়িয়ে দেন। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও আলোচনা হয় রোজার বাজারদর নিয়ে। এর আগের দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও সভা হয়। মজুতদারি ও অন্যায্য দাম বাড়ানো ঠেকাতে অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিক্রেতাদের বশ মানাতে না পারলেও প্রয়োজনের বেশি না কিনতে ক্রেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। আগের বছরগুলোতেও একই পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

গত বছর জিলাপির দাম ছিল মানভেদে ১২০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। ধানমন্ডির রানা ফুডসের বিক্রেতা মিজানুল ইসলামের ধারণা, এবার রোজায় ২০০ টাকার কমে জিলাপি মিলবে না। কারণ, চিনির দাম ৮০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা কেজি। চিনির দাম কেজিতে ৪০ টাকা বাড়ায় জিলাপির দাম ৮০ টাকা কেন বাড়বে? এক কেজি জিলাপিতে তো এক কেজি চিনি লাগে না। এর জবাবে তিনি বলেন, ময়দা ও তেলের দামও বেড়েছে।

অন্য মাসের চেয়ে রমজানে চাল, ডাল, তেল, আটা, ছোলা, চিনি, মাছ, মাংসের মতো নিত্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। তবে কতটা বাড়ে– এ তথ্য পাওয়া যায়নি। ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি করা পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে আমদানি হয় না এমন জিনিসের দামও বসে নেই। যেমন– ব্রয়লার মুরগির দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

ক্রেতারা কতটা বেশি কেনেন রমজানে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে এই প্রতিবেদক যান জিগাতলার ট্যানারি মোড় বাজারে। দেখা গেল, এক ক্রেতা কিনলেন একসঙ্গে ১০ লিটার সয়াবিন তেল। তিনি জানান, ছয়জনের সংসারে অন্য মাসে পাঁচ-ছয় লিটার তেল লাগে। রোজা ও ঈদের রান্না বেশি। তাই ১০ লিটার কিনলেন, পরে দাম বাড়বে– এ শঙ্কায়।

একই বাজারের মুরগি বিক্রেতা আবুল কাসেম জানান, মার্চের শুরুতে বিক্রি একেবারে কমে গিয়েছিল। তিন-চার দিন ধরে বেড়েছে। রোজায় দাম বাড়ার আশঙ্কায় ব্রয়লার, সোনালিসহ সব ধরনের মুরগিই ক্রেতারা বেশি কিনছেন। এতে বরং দাম আরও বাড়ছে। চাহিদা বাড়ায় পাইকাররা দাম বাড়িয়েছেন। ১০ রোজার পর দাম কমতে পারে। ঈদের আগে কয়েক দিন আবার বাড়বে। তবে ঈদের পর কমবে। তাঁর কথা শুনে বেড়িবাঁধের পাইকারি আড়তে গেলে সেখানকার বিক্রেতারা বললেন, খামারে দাম বেড়েছে।
শুধু যে নিত্যপণ্য নয়, রোজায় চাঁদাও বেড়েছে। ঢাকা কলেজের বিপরীতে ফুটপাতে টি-শার্ট বিক্রেতা জানান, দিনে সমিতি, পুলিশ, নেতা মিলিয়ে ১৫০ টাকা দেন। রোজায় দিতে হবে দিনে ৬০০ টাকা। তবু চোর-পুলিশ খেলতে হবে। কারণ, যানজট নিরসনে দোকান উচ্ছেদ হবে। তা ঠেকাতেও টাকা লাগবে। বাড়তি টাকা আসবে কোথা থেকে– প্রশ্নে তিনি বলেন, এই এক মাসই তো ব্যবসা। বসতে না দিলে সারাবছর উপোস করতে হবে। চাঁদার পেছনে যে টাকা যাবে, জিনিসের দাম বাড়িয়ে তুলতে হবে।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, রমজান সংযমের মাস হলেও ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সেই বিষয়ে নজর থাকে না। ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য থাকে, রমজানে পুরো বছরের লাভ তাঁর ঘরে তুলতে হবে। আর ভোক্তারা সংযম পরিহার করে অধিক ভোজন, অধিক ক্রয়ে অনেক সময় ব্যস্ত থাকেন। যার কারণে সরবরাহ ও জোগানে সংকট সৃষ্টি হয়। আর সংকটকে কাজে লাগিয়ে কিছু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, শুধু মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া বিশ্বের কোথাও রোজার সময় ভোগ্যপণ্যের দামে ছাড় দেওয়া হয় না। মধ্যপ্রাচ্যে মাথাপিছু আয় ১ লাখ ডলারের বেশি। পণ্যে তাদের কর দিতে হয় না। এ কারণে তারা ছাড় দিতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর। যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি হয়, এর বেশিরভাগই অমুসলিম দেশ। তারাও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তাদের লক্ষ্য থাকে, রোজায় মুসলিম দেশগুলোতে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা দ্বিগুণ হবে। তাই রোজার আগে পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেয়। ফলে ব্যবসায়ীদের আমদানি খরচ বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেন। তাঁরা ১০ টাকায় পণ্য কিনে ৮ টাকা বিক্রি করতে পারবেন না। তাঁদেরও মুনাফা করতে হবে। অন্যদিকে ক্রেতারাও মনে করেন, রোজায় খাওয়ার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। তাই প্রয়োজনের বেশি কেনেন। অনেকে অপচয়ও করেন।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ভোক্তারা যাতে কোনো প্রতারণার শিকার না হন, সে জন্য অধিদপ্তর সব সময় কাজ করে আসছে। রোজা ঘিরে তদারকি জোরদার করা হবে। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। তবে রোজায় ক্রেতারাও কৃচ্ছ্রসাধন করেন না। এ সময় ক্রেতাদেরও প্রয়োজনের বেশি কেনাকাটা করা ঠিক নয়।

https://samakal.com/bangladesh/article/2303163546