১০ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ৯:২২

তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় ২৫ জনকে ॥ হেফাজত ও ক্রসফায়ারে নিহত ৫৯

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ২৫ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে চার জন ফিরে আসে, একজনের লাশ পাওয়া যায়। অন্যদের কোনও খবর এখনও জানেন না তাদের স্বজনরা।

এদিকে, একই সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ও ক্রসফায়ারে ৫৯ জন মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ২০ জন। নিহতদের মধ্যে র্যাবের ক্রসফায়ার ও হেফাজতে নয় জন, পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৪১ জন, ডিবি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ছয় জন, পুলিশ ও র্যাব হেফাজতে দুই জন এবং বান্দরবানের লামায় সেনাবাহিনীর গুলীতে একজন মারা যান।
দেশজুড়ে গুম-খুন, অপহরণ, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে শিগগির পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। একইসঙ্গে উভয় পক্ষের সদস্যদের নিয়ে একটি ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিও গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার পরিচালিত মানবাধিকার বিষয়ক এই সংস্থাটি। দৈনিক সংগ্রামের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য জানিয়েছেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ২৫ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে চার জন ফিরে আসে, একজনের লাশ পাওয়া যায়। অন্যদের কোনও খবর এখনও জানেন না তাদের স্বজনরা। গত ৩১ মার্চ আসকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ও ক্রসফায়ারে ৫৯ জন মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ২০ জন। নিহতদের মধ্যে র্যাবের ক্রসফায়ার ও হেফাজতে নয় জন, পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৪১ জন, ডিবি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ছয় জন, পুলিশ ও র্যাব হেফাজতে দুই জন এবং বান্দরবানের লামায় সেনাবাহিনীর গুলীতে একজন মারা যান।
এর মধ্যে গত ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরার বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপি’র সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি নুরুল আলম নুরুকে। এর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তার লাশ পাওয়া যায় চট্টগ্রামের রাউজানের কর্ণফুলি নদীর তীরে। নুরুর ভাগ্নে জাহিদুল আলম অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজন ব্যক্তি মামাকে (নুরু) তুলে নিয়ে যায় ওই দিন দিবাগত রাত পৌঁনে ১২টার দিকে। পরদিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জানতে পারি, কর্ণফুলী নদীর তীরে তার লাশ পড়ে আছে। অথচ পুলিশ বলছে তারা কিছুই জানে না। তদন্ত করে বিষয়টি জানতে হবে। এটা কেমন করে হয়?’ ইতিমধ্যে এই ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত করতে অনীহা প্রকাশ করেছে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘পুলিশের পরিচয়ে এতগুলো লোককে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। স্থানীয়রা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়েই তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটা পুলিশকেই খতিয়ে দেখতে হবে। তদন্ত করে তাদের বের করতে হবে যে পুলিশ সদস্যরাই তাদের তুলে নিয়ে গেছে কিনা। তেমনটি হয়ে থাকলে তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আর অন্য কেউ তাদের তুলে নিয়ে গেলেও পুলিশেরই খুঁজে বের করতে হবে যে কারা তাদের তুলে নিয়ে গেছে। দায়িত্বটা পুলিশেরই। মানুষকে শান্তিতে বসবাস করার পরিবেশটা পুলিশকেই তৈরি করে দিতে হবে।’
কাজী রিয়াজুল হক আরও বলেন, ‘বারবার ঘটনা ঘটছে। আর পুলিশ অস্বীকার করছে। এ ক্ষেত্রে কারও না কারও দায়বদ্ধতা তো রয়েছেই। সেই বিষয়টি নিয়ে কমিশন ভাবছে। এ বিষয়গুলোকে আমরা একটা দায়বদ্ধতার জায়গায় নিতে চাই। আমরা চাই মানুষ যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারে। আমরা একটি ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করার চেষ্টা করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেওয়া ব্যক্তিদের প্রকৃতপক্ষে কারা তুলে নিচ্ছে, তা আমরা জানতে চাই।’
ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ কিংবা এনকাউন্টারের বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘এগুলো কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে আলোচনা হয়েছে। এ সপ্তাহে সম্ভব না হলে আগামী সপ্তাহের মধ্যে পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়গুলো নিয়ে বৈঠক করব।’
গুম-খুন ছাড়াও ক্রসফায়ার বন্দুকযুদ্ধ কিভাবে কমিয়ে আনা যায়, সেটা নিয়েও প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে বলে জানান রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, ‘আমরা পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করব। বৈঠকে তাদের বলা হবে, মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে আপনাদের কাজ করতে হবে।’ তাছাড়া মানবাধিকার যে লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে পুলিশকে কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা হবে বলে জানান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে রিয়াজুল হক বলেন , আমাদের কাছে প্রচুর অবিযোগ আসছে । এগুলোর সত্যতা যাচাই করতে গেলেই একটা মিশন দরকার । সে প্রয়োজন বোধ থেকেই ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি করার ওপর জোর দিচ্ছি । কমিশন চেষ্টা করছে , কিভাবে এসব ঘটনাগুলো ঘটছে , কারা জড়িত-এসব ব্যাপারে মোটামুটি একটা বিহিত করা । তাই সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই কমিশন পুলিশের সাথে বসে একটি রুপরেখা তৈরী করবে । যাতে দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় ।

http://www.dailysangram.com/post/279223-