১২ জানুয়ারি ২০২২, বুধবার, ৩:১৬

মূল ঝুঁকি কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংকট

চলতি বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা হবে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সংকট। এ ছাড়া পরিবেশ বিপর্যয়, সাইবার দুর্বলতা, ডিজিটাল বৈষম্যও অর্থনীতির ঝুঁকির তালিকায় থাকছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন-২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে।

গতকাল মঙ্গলবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বের প্রায় এক হাজার বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন খাতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল আন্তর্জাতিক সংস্থাটি ভার্চুয়াল মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। প্রতিবেদনে সংস্থাটি শতাধিক দেশের প্রধান চারটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। এতে অর্থনৈতিক ঝুঁকির পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশগত ঝুঁকির বিষয়ও উঠে এসেছে। কর্মসংস্থান ও জীবিকার পাশাপাশি বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি হচ্ছে কৌশলগত সম্পদের ভূরাজনৈতিকীকরণ। প্রতিবেদনে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ না করে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে স্থাপনা নির্মাণে এশিয়ার বৃহৎ দুটি দেশের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। এই প্রতিযোগিতার সুবিধা হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন বড় প্রকল্পে সহজেই বিনিয়োগ পাচ্ছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চললে উন্নয়নের পরিবেশ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ রকম প্রবৃদ্ধি আরো বৈষম্য সৃষ্টি করবে। বৈষম্য থাকলে সমাজ টেকসই হয় না। জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ চাকরির বাজারের বাইরে থাকলে তাদের অবদান থেকে সমাজ বঞ্চিত হয়। শুধু তারাই নয়, অর্থনীতিও বঞ্চিত হয়। কোনো না কোনো সময় গিয়ে সেই প্রবৃদ্ধি আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না।’

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় ঝুঁকি। যতই প্রবৃদ্ধি হোক না কেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করতে না পারলে আমাদের সব অর্জন ধূলিসাৎ হবে।

ডিজিটাল বৈষম্যও বাড়ছে উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, যারা উচ্চ আয়ের মানুষ তারাই বেশি ডিজিটাল সুবিধা পাচ্ছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বার্থে সামগ্রিক ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক কায়কোবাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির যত প্রসার ঘটছে, বৈষম্যও তত বাড়ছে। যেকোনো প্রযুক্তির বিকাশের প্রথম পর্যায়ে এই বৈষম্য থাকবে। কিন্তু ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলেছে, কভিডের অভিঘাতে বাংলাদেশে কত মানুষের আয় কমেছে বা কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকার এ নিয়ে বিশেষ জরিপ করেনি। আবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব জরিপ করেছে, তার ফলাফল সরকার মেনে নেয়নি।

সানেম ও ব্র্যাক বিআইজিডি গত প্রায় দুই বছরে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য নিয়ে ধারাবাহিক জরিপ করেছে। তাদের জরিপে একটি বিষয় পরিষ্কার, দেশের অনেক মানুষের আয় কমেছে। অনেক মানুষ আবার তুলনামূলকভাবে উচ্চ দক্ষতার কাজ থেকে নিম্ন দক্ষতার কাজ নিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি অনেক মানুষ কভিডের শুরুতে ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে যে গ্রামে গিয়েছিল, তাদের অনেকেই শহরে ফেরেনি।

ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বেকারত্বের সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এতে দেশের দরিদ্র ও অরক্ষিত মানুষ বিপাকে পড়েছে। ফলে এসব মানুষ খাদ্য ব্যয় কমিয়েছেন, যার প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর।

বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের তুলনায় পণ্যমূল্য এখন ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানি সংকট নিয়ে ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের দ্বন্দ্বের কারণে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। তবে এখন সারা বিশ্বে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ সরবরাহ সংকট। অর্থাৎ এই মূল্যস্ফীতি চাহিদাজনিত নয়, বরং সরবরাহজনিত।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরবরাহ সংকট ২০২২ সালেও চলবে। আইএমএফসহ অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা এ বছরের মাঝামাঝি মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিলেও সংস্থাটি সেটি মনে করছে না।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া জাহিদি বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বেশির ভাগ মানুষই আশাহত। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৪ শতাংশ মানুষই বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে। মাত্র ৪ শতাংশ মানুষ আশাবাদী।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2022/01/12/1110111