৯ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ২:০২

ব্যাংকে আমানত রেখে লাভ পাচ্ছে না গ্রাহক

ব্যাংকে টাকা রেখে লাভ পাচ্ছে না গ্রাহক। ব্যাংকের আমানতের সুদ হার ক্রমেই আরো কমছে। ফলে বাধ্য হয়েই গ্রাহকরা এখন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। দেশের তফসিলী ব্যাংকগুলোর মধ্যে এখন ২২টি ব্যাংকের সুদহারই ৫ শতাংশের নিচে। ফলে ব্যাংকে টাকা রেখে চার্জ কর্তন করার পর কোন লাভই পাচ্ছে না গ্রাহক। 

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পরও ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদহারের নিম্নমুখী প্রবণতা রোধ করা যায়নি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেও এ খাতে আমানতের গড় সুদহার কমেছে দশমিক ১০ শতাংশ। এ সময়ে দেশের ৫৭ ব্যাংকের মধ্যে ৪৪টিই তাদের আমানতের সুদহার কমিয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি আবার ঋণের সুদ যাও কমিয়েছে, তার চেয়ে বেশি মাত্রায় কমিয়েছে আমানতের সুদ।
সূত্র জানায়, বর্তমানে এ খাতের অন্তত ২২টি ব্যাংকের আমানতের সুদ ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। সূত্র বলছে, অতি মুনাফার প্রবণতা ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির অজুহাতে ব্যাংকগুলো আমানতের অনুপাতে ঋণের সুদহার কমাচ্ছে না। এ বিষয়টিকে ব্যাংকের দ্বৈত আচরণ হিসেবে দেখছেন অনেকেই। তাদের এ দ্বৈত আচরণে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতা উভয় গ্রাহকই ঠকছেন। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রেখে কোনো লাভ হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ধারাবাহিক আমানতের সুদ কমায় ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তারা বেশি লাভের আশায় বিকল্প উৎসে টাকা খাটাচ্ছেন। সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে ঝুঁকছেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার অতি মুনাফার লোভে কো-অপারেটিভ সোসাইটির মতো হায়-হায় প্রতিষ্ঠানে টাকা খাটাচ্ছেন। অনেকেই সঞ্চয়ের বদলে অপচয়মূলক কাজে অর্থ ব্যয় করছেন। এতে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করেছে। এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংককেও। আর্থিক খাতের এই অভিভাবক মনে করছে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে দায়-সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে, যা বাঞ্ছনীয় নয়। তাই আমানতের সুদহারের নিম্নমুখী প্রবণতা রোধে সব ব্যাংককে সক্রিয় থাকার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে একটি নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহার ঋণের সুদহারের চেয়ে দ্রুততর হ্রাস পেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আমানতের ওপর সুদহারের অত্যধিক হ্রাস সঞ্চয় প্রবণতাকে ক্ষুণœ করছে এবং সঞ্চয়ের বদলে অপচয়মূলক ভোগ ও অন্যান্য অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহারের প্রবণতার ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। এতে আরও বলা হয়, কোনো অবস্থাতেই ঋণের নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখতে আমানতের সুদহার সংকোচন করা যাবে না। বরং ঋণের সুদহারের নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার জন্য ইন্টামিডিয়েশন স্প্রেড সংকোচন করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়সহ ব্যবস্থাপনা দক্ষতার বিভিন্ন দিকে নজর দিতে হবে। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যাংকই ওই নির্দেশনা পরিপালন করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংকিং খাতে আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ; যা জানুয়ারি মাসে ছিল ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ মাসে দেশের ৫৭ ব্যাংকের মধ্যে ৪৪টি তাদের আমানতের সুদ কমিয়েছে। তবে এ সময়ে ১১টি ব্যাংক তাদের আমানতের সুদ সামান্য বাড়িয়েছে। আর দুইটি ব্যাংকের আমানতের সুদ অপরিবর্তিত ছিল। আবার এ সময়ে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদও প্রত্যাশিত মাত্রায় কমায়নি। ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা জানুয়ারি মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ফলে এক মাসে ঋণের সুদ কমেছে দশমিক ০৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে আমানতের সুদহারের তুলনায় মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এতে ব্যাংকে টাকা রেখে কোনো লাভ হচ্ছে না গ্রাহকের। কারণ বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় তাদের মূল অর্থও ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এতে আমানতকারীরা সঞ্চয়ে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ঋণের সুদহার কমাতে আমানতের সুদহার আর কমানোর প্রয়োজন নেই। বরং ব্যাংকগুলোয় যেসব বাহুল্য খরচ আছে, সেগুলো কমিয়ে আনতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে (টানা চার বছর) ব্যাংকিং খাতে আমানতের সুদহার কমছে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকিং খাতে গড় আমানতের সুদহার ছিল ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি শেষে তা নেমে এসেছে ৫ দশমিক ০৩ শতাংশে। ফলে গত চার বছরে আমানতের সুদহার কমেছে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১৫ ও ২০১৬ সালেই আমানতের সুদহার দ্রুত কমেছে। চলতি বছরেও তা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে তা এমন পর্যায়ে নেমেছে যে, ব্যাংকে টাকা রেখে কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ আমানতের বিপরীতে প্রকৃত যে মুনাফা (সুদহার) পাওয়া যাচ্ছে, তা মূল্যস্ফীতির হারের চেয়েও নিচে রয়েছে।
এছাড়া আমানতের মুনাফায় উৎসে কর, ভ্যাট, আবগারি শুল্ক ও ব্যাংকের সার্ভিস চার্জ কেটে রাখার পর মুনাফা বলে কিছুই থাকছে না। ফলে ব্যাংকে টাকা জমা রেখে সঞ্চয়কারীদের অর্থ আরও ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। এছাড়া ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ধারাবাহিক আমানতের সুদ কমায় ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যেখানে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ১২ শতাংশ; সেখানে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে হয়েছে ১৩ দশমিক ০৯ শতাংশ।

http://www.dailysangram.com/post/279134-