৯ জানুয়ারি ২০২২, রবিবার, ১০:৪৬

প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি : কার টাকা? গৌরী সেনের? না জনগণের?

আসিফ আরসালান : গত বেশ কিছুদিন হল লেখালেখিতে তেমন আর ইন্টারেস্ট পাই না। দিনের পর দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। কলামিস্টরা কলাম লেখেন কেন? ভাষ্যকাররা ভাষ্য লেখেন কেন? তাদের প্রধানত দু’টো উদ্দেশ্য থাকে। ভালো লেখা হলে সেটি পাঠকপ্রিয়তা তথা জনপ্রিয়তা পায়। অনেক মানুষ তার লেখা পড়ে। কেউ প্রশংসা করে। কেউ সমালোচনা করে। একজন কলামিস্টের জন্য প্রশংসা ও সমালোচনা দু’টোই ভাল লাগে। গঠনমূলক সমালোচনায় লেখক বা ভাষ্যকার উপকৃত হন।

দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল, তার লেখা সরকার বা বড় বড় রাজনৈতিক দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তাদের ভুলভ্রান্তি থাকলে তারা নিজেদের সংশোধন করে নেবেন। এই প্রসঙ্গে আমি কয়েকজন বিখ্যাত সাংবাদিকের নামোল্লেখ করছি। এরা হলেন আমেরিকার ওয়াল্টার লিপম্যান, ফরিদ জাকারিয়া, ভারতের কুলদীপ নায়ার, ইন্দোর মালহোত্রা, নিহাল সিং। পাকিস্তানের জেড এ সুলেরী মুজাহিদ হোসেন। ডন পত্রিকার আলতাফ হোসেনের কথা আর বললাম না। কারণ লেখনি এবং সম্পাদনার উচ্চ মানের জন্য তিনি দেশটির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন এবং যতদূর মনে পড়ে, সেই দেশটির কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছিলেন। কুলদীপ নায়ারকে গ্রেট বৃটেনে ভারতের হাইকমিশনার করা হয়েছিল।

ভারতের খুশবন্ত সিংয়ের নাম আমি ইচ্ছে করেই নেইনি। তার ইংরেজি খুব সমৃদ্ধ। কিন্তু তার সাহিত্যকর্ম কুৎসিত, নোংরা, অশ্লীল এবং পর্নোগ্রাফি বললে অত্যুক্তি হবে না। আমেরিকার ক্রিশ্চিয়ানা আমানপুরি নামক সিএনএনের মহিলা সাংবাদিক তো সাংবাদিকতার জগতে আজ এক জীবন্ত কিংবদন্তি।

অবিভক্ত ভারতে প্রথমে মুসলমানদের স্বাধীকার আন্দোলন এবং পরবর্তীতে স্বাধীন মাতৃভূমির সংগ্রামে মাওলানা আকরাম খান এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অবিভক্ত ভারতে কাজী নজরুল ইসলামও বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সাবেক পূর্বপাকিস্তানে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবিতে যে বলিষ্ঠভাবে কলম চালিয়ে গেছেন তার জন্য আজও তিনি মানুষের স্মৃতিতে ভাস্বর। আলতাফ হোসেন যেমন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছায়াসঙ্গী ছিলেন, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াও তেমনি বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী হয়ে ছিলেন। পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক আব্দুস সালাম বাংলাদেশের সাংবাদিক জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ডেভিড বার্গমান নৃতাত্বিক ভাবে ইহুদি হলেও বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে একটি আলোচিত নাম। বিশেষ কারণে গত ৪ বছর হল ইংল্যান্ডে বাস করছেন।
দেশ এবং বিদেশের বিখ্যাত সাংবাদিকের সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি এতক্ষণ দিলাম। এ কারণেই দিলাম যে এরা যা লিখতেন, যা সুপারিশ করতেন বা যেসব সমালোচনা করতেন, সরকার সে গুলো নোটিশে নিতেন।

॥ দুই ॥
বহু বছর আগে আমি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার জনসংযোগ বিভাগের প্রধান ছিলাম। সেই সুবাদে শুধুমাত্র নিজের সংস্থারই নয়, অন্যান্য অটোনোমাস বডি এবং সচিবালয়ের তথ্য বিভাগের কার্যক্রম দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে। পরে অবশ্য জনসংযোগ বিভাগ থেকে প্রথমে প্রশাসন বিভাগ এবং পরে ঋণ প্রদান এবং পুনরুদ্ধার বিভাগে বদলি হই। যখন জনসংযোগ বিভাগে ছিলাম তখন দৈনিক পত্র-পত্রিকার ক্লিপিং সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠাতাম। প্রকাশিত সংবাদের অভিযোগ জেনুইন হলে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হত এবং ক্ষেত্র বিশেষে সংশ্লিষ্ট অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্ত ইনিশিয়েট করা হত। অবশ্য এর বিপরীত কাজও যে হত না তাও নয়।

সংস্থা প্রধান চাইতেন তার সংবাদ এবং ছবি ঘন ঘন দৈনিক পত্রিকায় ছাপানো হোক। এমনি এক ব্যক্তি আমার সংস্থায় প্রধান হয়ে আসার পর যখন ঘন ঘন তার ছবি ছাপাতে বলতেন তখন আমি অসহায় এবং বিরক্ত হয়ে তদবির করে অন্য বিভাগে যাই। কারণ তার অধিকাংশ খবরেরই কোন নিউজ ভ্যালু ছিল না।

সরকার প্রধান, সেটা তিনি প্রধানমন্ত্রী হন বা প্রেসিডেন্ট হন, তার কিন্তু একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রেস উইং থাকে। তারা নিশ্চয়ই দেশের বার্নিং ইস্যু বা জনদুর্ভোগের বিষয়গুলো প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনেন। কিন্তু সরকার প্রধান কি সে গুলো কগনিজেন্সে নেন? জানি না। নিলে পরে এত Enforced disappearance, গুম খুন ইত্যাদির অভিযোগ কেন? শুধুমাত্র মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং রাজস্ব মন্ত্রণালয়ই তো এসব অভিযোগ করেনি, ২০১২ সাল থেকে তো দেশের এবং বিদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোও তো এসব অভিযোগ করে যাচ্ছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এসব অভিযোগ উঠতে উঠতে এখন মার্কিন স্যাংশনে গড়িয়েছে। এই যে শত শত কোটি নয়, হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ প্রতিনিয়ত পত্রিকায় উঠছে, সেগুলোরই বা কি প্রতিবিধান করা হচ্ছে?

॥ তিন ॥
কথার পৃষ্ঠে কথা বাড়ে। এক কথা থেকে আরেক কথায় যেতে হয়। অভিযোগ বিস্তর। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো? সরকারের প্রকল্প ব্যয় নিয়ে যদি কথা বলতে হয় তা হলে একটি পুরানা কথা মনে পড়ে। ছোটকালে শুনতাম, “কোম্পানি কে মাল/দরিয়া মে ঢাল।” আর এখন? সেটি হয়েছে “সরকারকে মাল/দরিয়া মে ঢাল।” এখানে দরিয়া বলতে ঠিকাদারদের যোগ সাজশে সরকারের রাঘব বোয়ালদের পকেটে যাচ্ছে। এ সব আমাদের কথা নয়। এখন তো আবার মিছিল মিটিং করা যায় না। মানববন্ধনে বা সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মধ্যেই বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। পত্র পত্রিকার স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হলেও সেই সীমাবদ্ধতার ফাঁক ফোকর গলিয়ে এসব অভিযোগ বেরিয়ে আসছে।

‘ডেইলি স্টার’ এবং ‘প্রথম আলোকে’ কেউ সরকার বিরোধী বলে না। তাই বলে তাদেরকে সরকার বা আওয়ামী লীগ পন্থীও বলা হয় না। সেই ডেইলি স্টারে ৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবর বের হয়েছে। খবরটির শিরোনাম, New year, Old problems. অর্থাৎ “নতুন বছরে পুরাতন সমস্যা”। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ বা একনেকের বৈঠকে ব্যয় সংশোধনের জন্য ৭ টি প্রকল্প উত্থাপন করা হয়। এই ৭টি প্রকল্পের মূল ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৯৯ কোটি টাকা। সংশোধিত ব্যয় ধরা হয় ১৪ হাজার ৬১ কোটি টাকা। বেপজা অর্থনৈতিক এলাকা। মূল ব্যয় ৭৫০ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত সংশোধিত ব্যয় ১ হাজার ৩ শ’ ২ কোটি ৯১ লক্ষ টাকা। প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার কথা ২০২১ সালে। ২০২১ সাল পার হয়ে গেছে। এখন প্রস্তাবিত সমাপ্তির সময় ২০২৩ সাল। আশ্রায়ন-২ প্রকল্প। অনুমোদিত প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার ১৬৯ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার সময় ২০১৪ সালের জুন মাস। সংশোধিত বাস্তবায়নের সময় ২০২৩ সালের জুন মাস। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের ৯ বছর পর প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। তাও যদি হয়। এই অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণে প্রকল্প ব্যয়ও অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। মূল প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি করে বর্ধিত ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ১০ গুণ, অর্থাৎ ১১ হাজার ১৪২ কোটি ৮ লক্ষ টাকা। আরো এ ধরনের প্রকল্প আছে। কিন্তু পরিসংখ্যানের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে দর্শক আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন তাই আর অন্যান্য প্রকল্পের তথ্য পরিসংখ্যান উল্লেখ করা থেকে বিরত রইলাম।

আমরা শেষ করছি পদ্মা সেতু দিয়ে। প্রকল্পটি প্রথম অনুমোদিত হয় ২০০৭ সালে। এস্টিমেটেড প্রজেক্ট কস্ট ছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। ৪ বছর পর প্রকল্প ব্যয় প্রথম সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ব্যয় ছিল ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ৫ বছর পর দ্বিতীয় বার প্রকল্প ব্যয় সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ব্যয় হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।

২০১৮ সালে প্রকল্প ব্যয় পুনরায় সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ব্যয় ধরা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এটি আসলে তৃতীয় সংশোধনী। কিন্তু তৃতীয় সংশোধনী না বলে বলা হয় বিশেষ সংশোধনী। দেখা যায় যে এই তিন দফা সংশোধনীতে প্রকল্প ব্যয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধি ২০ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এই বৃদ্ধির টাকা কে যোগাচ্ছে? গৌরী সেন না জনগণ?
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/476893