গতকাল শুক্রবার রাজধানীর গ্রিন রোডের ১৪ তলাবিশিষ্ট আরএইচ হোম সেন্টারের পঞ্চম তলায় আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা -সংগ্রাম
৮ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার, ১০:২২

অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু বাড়ছে অসতর্কতা দায়ী

নাছির উদ্দিন শোয়েব : রাজধানীর উত্তরায় বাসাবাড়িতে অগ্নিকাণ্ডে একই পরিবারের তিনজন মারা যায়। ঝালকাঠিতে লঞ্চে ভয়াবহ আগুন লেগে ৪৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। থার্টিফার্স্ট নাইটে ইংরেজি নতুন বছর উদযাপন করতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই শতাধিক স্থানে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। বাংলামোটরে রাহাত টাওয়ারের ১১ তলায় যমুনা টিভির অফিসে আগুন লাগে। মহাখালীতে প্রাইভেটকারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গতকাল শুক্রবার গ্রিন রোডে একটি বহুতল ভবনে আগুন লাগে। কয়েক দিনের ব্যবধানে পর পর কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরণের অগ্নি আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বাসা বাড়ি, অফিস-আদালত ও যানবাহনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে।

জানা গেছে, ঢাকায় প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। আগুনের ঘটনায় হাজারো মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অসংখ্য পরিবার হারিয়েছেন পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে। অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের পেছনে ছিল মানুষের অসচেতনতা, ঘনবসতি ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ। এমনই দাবি করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। ৮ বিভাগের মধ্যে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে কম ঘটে সিলেটে। নতুন গঠিত ময়মনসিংহ বিভাগেও অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা সিলেটের চেয়ে বেশি। ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে অগ্নিকাণ্ডের ২৪টি কারণের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো- চুলার আগুন, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ, সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো, খোলা বাতির ব্যবহার, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা, যন্ত্রাংশের সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, মিস ফায়ার, চিমনি, রাসায়নিক বিক্রিয়া, বাজি পোড়ানো ইত্যাদি।

সুগন্ধ নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গঠিত কমিটি সম্প্রতি প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে সদরঘাটে কর্মরত নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বি আইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে ২৫ দফা সুপারিশ ও করণীয় দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়েছে, কম লঞ্চ চালিয়ে বেশি মুনাফা অর্জনের ‘রোটেশন’ প্রথা বন্ধের সুপারিশ করেছে কমিটি। মালিকদের এ কৌশলের কারণে প্রয়োজনের তুলনায় কম লঞ্চ থাকে। এ সুযোগে লঞ্চে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হয়। এতে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযান-১০ লঞ্চটি চাঁদপুর ঘাট অতিক্রম করার পর ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। ইঞ্জিনের ত্রুটি সারতে ব্যর্থ হওয়ায় লঞ্চটি আর না চালিয়ে নিরাপদ কোনো ঘাটে আগেই ভেড়ানো উচিত ছিল। অনেক যাত্রী লঞ্চটি ভেড়ানোর অনুরোধও করেছিলেন। কিন্তু মাস্টার ও ইঞ্জিন চালক এ বিষয়ে কর্ণপাত না করে ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চটি চালাতে থাকেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নি কাণ্ডের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এসব কমিটি রিপোর্ট জমা দিলেও অনেক সময় আলার মুখ দেখে না। আবার কমিটিগুলো বিভিন্ন সুপারিশ জমা দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হয় না। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হলে এ দুর্ঘটনা কমে আসতো। রাজধানীর নীমতলি, চুড়িহাট্টা, রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানা, এফআর টাওয়ার কিংবা লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি আলোচিত।

সারাদেশে ২০২০ সালে ১৮ হাজার ১০৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ। ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১৫৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার সম্পদের। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদর দফতর এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। দফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে ১৮ হাজার ১০৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কাগজে-কলমে এতে মোট ১৫৯ কোটি ২৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর আগের বছর ২০১৯ সালে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানী হয় ১৮৪ জনের। এর মধ্যে ১২৫ জন ছিল ঢাকার, ৪৪ জন চট্টগ্রামের, ছয়জন বরিশালের, রংপুরের চারজন, সিলেটের চারজন এবং ময়মনসিংহের একজন। এসব অগ্নিকাণ্ডে সম্পদের ক্ষতি হয় ৩৩০ কোটি ৪১ লাখ ৫৬ হাজার টাকার। ফায়ার সার্ভিস ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান তৈরি করেছে, তাতে দেখা যায় মার্চে দেশে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঢাকায়।

এছাড়াও দেশে আগুনে পুড়ে গত সাত বছরে ৭৫৩ জন নিহত হয়েছে। এই সময় এক লাখ ২৪ হাজার ১৭৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দগ্ধ হয়েছে ৭২ হাজার ৩৮৩ জন। আগুনের এসব ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৫৬৭ কোটি ৫২ লাখ ৬৮ হাজার ৪৬৫ টাকা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের (২০২১) ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। আগুন লাগার প্রায় সব ঘটনাই ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করে। মূলত বিভিন্ন কারখানা, অফিসের বহুতল ভবন, বাসাবাড়ি, দোকানপাট, মহাসড়কের গাড়িতে লাগা আগুনে এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে উঠে এসেছে। বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট, গ্যাসলাইনের ত্রুটি, গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনা (সিএনজি), রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার থেকে ঘটা দুর্ঘটনাসহ (এলপিজি) নানা কারণে এসব অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। ওই মাসে দুই হাজার ৮৬১টি আগুনের ঘটনায় মারা যায় ১৫০ জন। আহত হয় এক হাজারের বেশি মানুষ। প্রাণহানি ছাড়াও গত বছর আগুনের ঘটনায় ৩৩০ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি আগুনের ঘটনা ঘটে ঢাকা বিভাগে। সবচেয়ে কম আগুন লাগে বরিশাল বিভাগে। ঢাকা বিভাগের নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেশি থাকায় আগুনের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে মনে করছেন তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তারা। ফায়ার সার্ভিস গত বছরের পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনো তৈরি করেনি। তবে মৃত্যুর আনুমানিক হিসাব ১২০ বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে বছরের শেষে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ৪৫ জন মারা যাওয়ার হিসাবও আছে।

এ ছাড়া গত ১৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে পুরান ঢাকার বংশাল আলুবাজারে তিতাস গ্যাসের লাইন থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজন দগ্ধ হয়, দগ্ধ হয় আরো চারজন। গত ২৫ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে গ্যাসলাইন লিকেজ বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়েছেন তিনজন। গত ৮ নভেম্বর ভোরে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীতে একটি গ্যারেজে আগুন লাগার কারণ ছিল অটোরিকশার (সিএনজি) গ্যাস সিলিন্ডার। ওই আগুনে ১৪টি সিএনজি চালিত অটোরিকশা পুড়ে যায়।

সর্বশেষ গত ৪ জানুয়ারি উত্তরার চন্ডালভোগ মানিক বস্তি খালপাড় এলাকার টিনশেড ঘরে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যু হয়। মৃতরা হলেন- জাহাঙ্গীর (১৯), রুমা (১৭) ও আফরিন (১৪)। ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার খালেদা খানম বলেন, ভোর ৪ টার সময় আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট ৫টা ৪০ মিনিটে আগুন নির্বাপণ করে। এরপর ঘরে তল্লাশি চালিয়ে ৩জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুনের ঘটনা ঘটতে পারে। তুরাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়াজিউর রহমান জানান, ফায়ার সার্ভিস আগুন নির্বাপণের পর ওই টিনশেড ঘরের ভেতর থেকে তিন জনের লাশ উদ্ধার করে। এদের মধ্যে জাহাঙ্গীর ও রুমা আপন ভাই বোন আর তাদের খালাতো বোন আফরিন। তিনি আরও জানান, ঘটনার সময় বাসার মধ্যে চারজন ছিল। বড় ভাই আলমগীর অগ্নিকাণ্ডের সময় বাইরে বেরিয়ে যায়। নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা সুরুজ মিয়া ও মা আলেয়া বেগম কয়েকদিন আগে তাদের গ্রামের বাড়ি দিনাজপুর বীরগঞ্জে যায়। বর্তমানে ওই বাসায় তারাই ছিল। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যানস) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেছেন, ভবন নির্মাণ, নগরায়ণসহ সবকিছুতেই নিয়ম মানতে হবে। অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়াও এ নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় ফায়ার সার্ভিস আগের চেয়ে আরও সক্ষম হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসে আধুনিক সরঞ্জাম যুক্ত হয়েছে। কর্মীরাও আগের চেয়ে প্রশিক্ষিত।

https://dailysangram.info/post/476824