৮ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার, ১০:১৩

বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’ গড়তে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আহ্বান, বাধা কী?

অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শাহাবুদ্দীন : বড় আশা ছিল বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এ দেশকে ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার। কিন্তু সম্ভব হয়নি তার জীবদ্দশায়। কেন হয়নি তার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে সোনার দেশ গড়তে হলে কাক্সিক্ষত অনেক উপাদানের মধ্যে একটি উপাদান তা হলো সোনার মানুষ। আর সোনার মানুষ তৈরির জন্য যা প্রয়োজন ছিল তার সঠিক প্রয়োগ (Application) না থাকা। তিনি সোনার মানুষ সংগ্রহ করতে না পারায় সোনার বাংলা গড়তে পারেননি। উপরন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতায়ও তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সোনার বাংলা গড়তে তার পিতার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য বক্তব্যে ও প্রচেষ্টায় আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি যেখানে হাত দিচ্ছেন সেখানেই সোনা ফলছে। কিন্তু অনেক কিছুতেই তো তিনি সামাল দিতে পারছেন না। তার পক্ষেও সোনার মানুষ তৈরি করা কি সম্ভব হচ্ছে? তিনিও তো সোনার মানুষ ছাড়া সোনার বাংলা গড়তে পারবেন না। সোনার মানুষ তৈরি করার জন্য কি রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো পরিকল্পনা ও কারখানা আছে? যদি থেকে থাকে তাহলে তার ফল লাভ কেন সম্ভব হচ্ছে না? আর যদি না থেকে থাকে তাহলে প্রথমে সেখানেই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দলের ও দলের বাইরে যারা সরকারে জড়িত আছেন সম্মিলিতভাবে তারা এবং অন্যান্য দলেরও যারা সরকারে আছেন তারা সরকারের সাথে থেকে অথবা নিজ নিজ দলের আদর্শ দিয়েও পৃথকভাবে কল্যাণকর রাষ্ট্র তৈরি করতে চান। এ ক্ষেত্রে সরকারের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল আছে সেসব দলও নিজ নিজ দলের আদর্শ নিয়ে “সোনার বাংলা” নাম নিয়ে না হলেও সুখময়, শান্তির উন্নত দেশ গড়তে চায়।

এখন প্রশ্ন হলো তাহলে কেন সেই সোনার বাংলা, কল্যাণকর দেশ, শান্তির ও উন্নত দেশ তৈরি করা যাচ্ছে না? এ ধরনের দেশ গড়তে বাধা কোথায়? বাধাগুলি কি চিহ্নিত করা হয়েছে? বাধা দূর করার কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী বা দেশের স্বনামধন্য কতিপয় সোনার মানুষই কি পারবেন একটি দেশকে ভালো করে গড়তে অথবা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও আদর্শই কি সোনার দেশ গড়ার জন্য যথেষ্ট? বিএনপি, জাপা, বাম বলে পরিচিত যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে বিদ্যমান তাদের পক্ষেই কি সম্ভব হবে প্রকৃত সোনার বাংলা গড়ার বৈশিষ্ট্য অর্জন করা? পারবে কি তাদের বিভিন্ন দফার কর্মসূচি ও আদর্শ দিয়ে প্রকৃত কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠন করতে?

তাই প্রথমেই আমাদেরকে সোনার বাংলা, কল্যাণ রাষ্ট্র, শান্তির দেশ, সাম্যের সমাজ এর বৈশিষ্ট্য ঠিক করা দরকার। এ ধরনের দেশ পৃথিবীতে কি আছে যেগুলোকে আমরা অনুসরণ করব? না কি আমাদের দেয়া নিজস্ব সংজ্ঞা অনুসারে সোনার বাংলা, শান্তির দেশ গড়তে চাই?
আমরা কি চাই চীন দেশের আদর্শ দিয়ে সোনার বাংলা, নাকি সোভিয়েত আদর্শে অথবা ভারত-আমেরিকার আদর্শে? নাকি জাপান, জার্মান, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, আরব আমিরাতের মধ্যে যে কোনো দেশের আদলে আমরা আমাদের দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে চাই? উল্লেখিত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনগুলো সোনার দেশের বৈশিষ্ট্য বহন করছে তা আমাদের যাচাই করতে হবে। অতঃপর তা সামনে রেখে আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থার পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করতে হবে। উপরিউক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শের পাহাড়সম বৈষম্য বিদ্যমান। আমরা সে ক্ষেত্রে কোন পথ অবলম্বন করব?

ধর্মীয় ক্ষেত্রে খৃস্টান, মুসলিম, বৌদ্ধ, ইহুদি, নাসারা, সনাতন (হিন্দু) ইত্যাদি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে বিভক্ত। আবার রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভিন্ন দল পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, কমিউনিস্ট ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ, ইসলাম, ইত্যাদি মতাদর্শে বিভক্ত। এমন কি মুসলমানরাও রাজনৈতিক মতাদর্শে ইসলাম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মতো ধর্ম ও রাজনৈতিক মতাদর্শে ভিন্নতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েেেছ। বাংলাদেশও এ ভাবাদর্শের বাইরে নয়। শতকরা একশত ভাগ না হলেও রাজনৈতিকভাবে অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠী এর আনুকূল্যে আসক্ত। এহেন পরিস্থিতিতে কি কোনো বিশেষ দল কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা গড়তে পারবে? একটি দল তার আদর্শ দিয়ে মনের মতো করে দেশ গড়তে চাইলে অন্যরা তার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। এ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সরকার যদি শক্তি প্রয়োগ করে তাহলে বিরোধীরাও মোকাবিলা করতে পিছপা হবে না। এ ক্ষেত্রে সরকার একনায়কতন্ত্র কায়েম করলে বা একমাত্র দল গঠন করলে সেটিও হবে গণতন্ত্রের পরিপন্থী। যা সোনার বাংলা গড়ার বিপক্ষে। এভাবে যখনই যে দল ক্ষমতায় গিয়ে দেশ পরিচালনা করতে উপরোক্ত পথ অবলম্বন করবে তখনই উল্লেখিত অবস্থার সম্মুখীন হতেই হবে। তাহলে সোনার বাংলাদেশ গড়ার পথ ও পদ্ধতি কি?

কথার কথা আমরা যদি সবাই মিলে ঐকমত্যে এসে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উন্নত দেশ যেমন আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, জাপান, ফ্রান্স, জার্মান ও ভারতের অনুকরণে দেশটা উন্নত করতে চাই তাহলে কি আমরা বলতে পারব যে, আমরা আমাদের এ দেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে পারব? সোনার দেশের বৈশিষ্ট্য যদি হয় শুধু অর্থনৈতিক চরম উন্নতি, আনবিক শক্তির অধিকারী হওয়া, বিভিন্ন গ্রহে উপগ্রহে গমনাগমন, বিভিন্ন আবিষ্কার, শিল্প বিপ্লব, বৈষম্য রেখে মাথাপিছু জিডিপির চূড়ান্ত উন্নয়ন তাহলে কি আমরা বলতে পারব, আমরা সোনার দেশ গড়তে পারছি? যুদ্ধ সামগ্রী ব্যবহার করে যদি আমরা অন্যদের ঘায়েল করতে পারঙ্গম হয়ে থাকি তাহলে কি আমরা বলতে পারব আমাদের দেশ সোনার দেশে রূপান্তরিত হয়েছে?

উল্লেখিত উপাদানগুলোর আলোকে যদি আমরা সোনার দেশের বৈশিষ্ট্য সংজ্ঞায়িত করতে চাই, তাহলে ঐসব দেশ অবশ্যই সোনার দেশ বলে স্বীকৃত। বাংলাদেশও ঐসব উন্নত দেশের বৈশিষ্ট্যসমূহ অর্জন করতে পারলেই সোনার বাংলাদেশে রূপান্তরিত হতে পারবে।
বিশ্ববাসী জানে ঐসব দেশ উন্নত দেশ এবং তাদের নাগরিকদের অনেক মানবিক গুণাবলী আছে। তাদের সততা তাদের গণতন্ত্র, মানবতা, সত্যবাদিতা, দেশপ্রেম, পরিশ্রম, মিতব্যয়িতা বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও সাংবিধানিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে অনেক উন্নত। কিন্তু নৈতিকতা, দাম্পত্য জীবন, পিতামাতা, সন্তান-সন্ততির সম্পর্ক তাদের বিবিধ অধিকার তথা সামাজিক জীবন কোন পর্যায়ে? তাদের ধর্ষণের ও ফ্রি মিলনের অবস্থা অবৈধ গর্ভধারণ, গর্ভপাত, সমলিঙ্গের দাম্পত্য জীবন মানব ইতিহাসের কোন পর্যায়ে? তাদের দেশেও ধনী-গরিবের বৈষম্য এবং ধর্মীয় জীবনের পরিচয় কেমন? তাদের কোনো কোনো দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অধিকারের সীমাবদ্ধতা কেমন তা বিচার্য। উইঘুর মুসলমান, রাশিয়ায় জারের শাসন আমল, আমেরিকার কালো- সাদার বৈষম্য, ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার লোমহর্ষক কাহিনী, ফ্রান্সে একের পর এক মসজিদ ধ্বংস, স্পেনের মুসলিম হত্যার ইতিহাস, মায়ানমারে টাটকা মুসলিম নিধনের করুণ দৃশ্য, হিরোসিমা নাগাসাকিতে আমেরিকার’ বোমা বিস্ফোরণ, ইরাকে ও আফগানিস্তানের অস্তিত্ব বিলীনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন মানবিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে বিচার করলে আমরা এগুলোকে কি সোনার দেশ বলতে পারব? ঐসব দেশ কি আল্লাহর নির্দেশে রাষ্ট্র চালায়? এ বিষয়ে কি আল্লাহর নিকট আখিরাতে জবাবদিহি আছে? এরপর বিশ্ব সৃষ্টি ও আমাদের পরিচয় কি? সে বিষয়ে মুসলিম হিসেবে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। প্রথমেই চিন্তা করতে হবে তাদের ধর্ম আর আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবন পরিচালনা এক কিনা? এ বিশ্বের স্রষ্টা এক না একাধিক? তাদের ধর্ম আর আমাদের ধর্মের মধ্যে পার্থক্য আছে কিনা? আমাদের ধর্মের ব্যাপকতা ও তাদের ধর্মের সীমারেখা, স্রষ্টার বিধানের কোন পর্যায়? স্রষ্টার দেয়া ধর্ম ব্যাপক অর্থে দীন তথা মানুষের জন্য জীবন বিধান কি একটি না একাধিক? যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ধর্ম থেকে থাকে তাহলে আমাদের আর ঐসব দেশের জীবনযাত্রা প্রণালী একই হবে এবং তারা যেভাবে সোনার দেশ গড়ছে আমরাও সেভাবে সোনার বাংলা গড়তে পারব আর যদি ধর্ম এক না হয় তাহলে তাদের আমাদের অনুসরণের কোনো সুযোগ নেই। কারণ তাদের তামাদ্দুনিক জীবন আর আমাদের তামাদ্দুনিক জীবন আকাশ পাতাল পার্থক্য। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন ও আমাদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য মুসলমানদের রয়েছে আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর দেয়া বিধিবিধান। এ ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ বিপরীতে চলছে। ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ বলেন, ‘ইন্না দ্বীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম’ অর্থঃ আল্লাহর নিকট একমাত্র জীবনবিধান হলো ইসলাম। সূরা আল ইমরান : ১৯।
২. আল্লাহ তার দ্বীনকে মানুষের দুনিয়ায় চলা ও আখেরাতে মুক্তির জন্য সকল বিধিবিধান দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আলইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম ওয়াআতমামতু আলাইকুম নে’মাতি ওয়া রাজিতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনা’।
অর্থ : আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিয়েছি এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পরিপূর্ণ করেছি আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে কবুল করে নিয়েছি। সূরা মায়েদা : ৩।
৩. সকল মানুষ একই উম্মত ছিলেন, সূরা ইউনুস-১৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ওয়ামা কানাল্লাহু ইল্লা উম্মাতাও ওয়াহেদাতান ফাকতালাফু’।
অর্থ : প্রথম সূচনায় মানুষ একই উম্মতভুক্ত ছিল। পরে তারা বিভিন্ন ধরনের আকীদা এবং মত ও পথ রচনা করেছিল।
আল্লাহ আরো বলেন, ‘ওয়ালেকুল্লে উম্মাতির রাসূল’।
অর্থ : প্রত্যেক উম্মতের জন্য একজন রাসূল রয়েছেন।
সকল নবী ছিলেন মুসলমান এবং সকল উম্মতও ছিলেন মুসলমান।
দেখুন সূরা কাছাছ-৫৩, বাকারা : ১২৮, ১৩১, ১৩২, ১৩৩, ২১৩। আলে ইমরান- ৬৭, মায়েদা- ৪৪, ১১১, ইউনুসÑ ৭২-৮৪, ইউসুফ- ১৭, আরাফ- ১২৬, আন নামল- ৩১, ৪২, ৪৪ আয়াত।
৪. ইসলাম ছাড়া আল্লাহ মানুষের তৈরি বিধান গ্রহণ করবেন না। তিনি বলেন, যে ইসলাম ছাড়া অন্য প্রকার আনুগত্যের বিধান চায় তার থেকে সেটা গ্রহণ করা হবে না। সূরা ইমরান : ৮৫।
৫. মানুষের তৈরি মতবাদের ওপর ইসলামকে বিজয়ী করার জন্যই রাসূল (সা.)-এর পৃথিবীতে আগমন।
আল্লাহ বলেন, হুয়াল্লাজি আরসালা রাসূলাহু বিল হুদা ওয়া দ্বীনিল হাক্কে লিইয়ুজহিরাহু আলাদ্বীনি কুল্লিহি ওয়ালাও কারিহাল মুশরিকুন।
অর্থ : তিনি তাঁর রাসূলকে একটি সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ ও সঠিক জীবন বিধান দিয়ে প্রেরণ করেছেন। যেন তিনি (রাসূল) একে দুনিয়ার (প্রচলিত) সবকয়টি জীবনব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করে দিতে পারেন, তা মোশরেকদের কাছে যতই অপছন্দনীয় হোক না কেন। সূরা সফ-৯, সূরা ফাতাহ : ২৮, সূরা তওবার ৩৩ নং আয়াতে একই রূপ কথা বলেছেন আল্লাহ।
৬. আল্লাহর এ জমিনে কার আইন চলবে? সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ।
অর্থ : এ জমিনে আইন বিধান জারি করার অধিকার একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। সূরা ইউসুফ : ৪০।
৭. সৃষ্টি যার আইন তার
আল্লাহ বলেন, ‘আলা লাহুল খালকু ওয়াল আমর।
অর্থ : সৃষ্টি (যেহেতু) তাঁর। (সুতরাং তার ওপর) সার্বভৌম ক্ষমতাও চলবে একমাত্র তাঁর। সূরা আরাফ : ৫৪।
পৃথিবীতে উন্নত দেশগুলো পরিচালনা করতে তারা আল্লাহর বিধিবিধানের কোনো ধার ধারে না। কারণ তারা অনেকেই আল্লাহকে স্বীকার করলেও জীবন বিধান হিসেবে ইসলামের অধীন নয়। আল কুরআন শেষ নবী ও রাসূল (সা.)-এর প্রতিও তারা বিশ্বাস স্থাপন করেনি। তাই তাদের কিছু চমকপ্রদ উন্নয়ন দেখা গেলেও তারা প্রকৃত সোনার দেশ গড়তে পারবে না এবং মুসলিম জাতি হিসেবে আমরা তাদের রাষ্ট্রকে আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণও করতে পারব না।

আমরা মুসলিম। আমাদের পরিচয় আলাদা। আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোন ধরনের সোনার বাংলা গড়তে চাই। ‘নিখাদ’ সোনার দেশ না ‘খাদযুক্ত সোনার’ দেশ? খাদযুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়লে তো আর তাকে প্রকৃত কল্যাণকর রাষ্ট্র বলা যাবে না। দেশে আল্লাহর কথা থাকবে মানুষের তৈরি মতাদর্শও থাকবে। আল্লাহর গোলামীও থাকবে শয়তানের পথও অনুসরণ করব, জায়েজ কাজ করব, নাজায়েজ থেকেও দূরে যাব না, হালাল উপার্জন করব আবার হারাম থেকেও দূরে যেতে পারব না। জীবনের অনেক ক্ষেত্রে শিরকমুক্ত থেকে কবীরা গুনাহ হতে বাঁচব আবার অনেক শিরকের তোয়াক্কা না করে শিরকের মাধ্যমে কবীরা গুনাহও করব। সত্যও বলব, মিথ্যাও ছাড়ব না, পরের কল্যাণ করব দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতও করব। নামাজও পড়ব, রোজাও করব আবার পূজার বেদিতে ফুল দেব। সুদ-ঘুষ খাব আবার মসজিদ-মাদরাসও তৈরি করব। নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলব। সুযোগ পেলে তাদের ধর্ষণ করব। শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক পর্যন্ত ধর্ষণের প্রতি মুহূর্তে মেলা করব। গণতন্ত্রের বুলি আওড়াব অন্যের অধিকার আদায়ে খড়গহস্ত হব। এ দেশকে নিজের আদর্শিক দলের পিতৃভূমি মনে করব, অপরাপর আদর্শের দলের অবস্থানকে পরগাছা মনে করে মূলৎপাটন করব। আমার ধর্মের নাগরিকদের সব অধিকার ভোগ করার সুযোগ থাকবে, অন্য ধর্মের সকল মৌলিক অধিকার খর্ব হবে, তাদের ধনসম্পদ, জমাজমি জবরদখল হবে। এ ধরনের বৈশিষ্ট্য সম্বলিত দেশকে কি সোনার দেশ বলা যাবে? অন্য ধর্মের ধর্মীয় অধিকার পূরণ করতে দেয়া এবং তাদের নিরাপদে থাকার সকল ব্যবস্থা করার জন্য মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ আছে। এটি লঙ্ঘন হলে তাতে সোনার বাংলা গঠনের বৈশিষ্ট্য থাকবে? কারা করে, কেন করে, কে তাদের সুযোগ দেয়, তাদের চরিত্রের পরিবর্তনের কি ব্যবস্থা আছে? দলীয় কারণে দেশের একটি বড় সংখ্যার জনগণ দুর্নীতি থেকে শুরু করে চাকরি-বাকরি করার ও অন্যান্য যত রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বৈধ ও অবৈধভাবে পেয়ে অন্যদের চেয়ে ঢের উন্নত জীবনের অধিকারী হবে অপরদিকে অন্য জনগোষ্ঠী বৈধ অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবে এটা কোন সাম্যতার আচরণ? বিচারকেরা যদি নৈতিকতা হারায়, পুলিশরা যদি কোনো দলের হয়ে যায়, আক্রমণকারীরা যদি আক্রান্ত হওয়াদেরকে আসামীর কাঠগড়ায় তোলার সুযোগ পায় তাহলে কি ইনসাফভিত্তিক সোনার বাংলা গড়া সম্ভব হবে? ব্যাংক ডাকাতি, প্রজেক্টের অর্থ লুটপাট, জুয়া, ক্যাসিনো, ফটকাবাজারি, মদ-ইয়াবাসহ নিষিদ্ধ পানীয় নিয়ে যুবচরিত্র ধ্বংস করার জন্য দেশে বিদ্যমান উল্লেখযোগ্য জনশক্তি যদি জড়িত হয়ে পড়ে তাহলে তাদের নিয়ে সোনার বাংলা কিভাবে আমরা তৈরি করব? চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য, টেন্ডারবাজদের আক্রমণ, সামান্য স্বার্থহানি হলে এমনকি একটু কথা কাটাকাটি হলে খুন থেকে বাঁচার উপায় নেই। এমন চরিত্রের জনশক্তি যদি থাকে, এমনকি স্বার্থের হানি হলে সেখানে নিজের দলের ও আত্মীয়তার পরিচয়ও কাজে আসে না জীবননাশ করা হয়ে থাকে, তাদের দিয়ে কি হবে? প্রতারকে দেশ ভরে গেলে, হোক সেটা অর্থকরীর, মানবপাচার অথবা নারীদের নিয়ে, তার প্রতিবিধান না হলে কি কাক্সিক্ষত দেশ গড়া সম্ভব হবে? এ ধরনের অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা আছে যা প্রকৃত সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে বাধা।

আজ জাতীয় চরিত্র মিথ্যায় অভ্যস্ত, তাতে যদি কারো জীবনও চলে যায় তাতে মিথ্যা ত্যাগ করতে নারাজ। সততা ঢাকা পড়েছে শঠতার জালে। অনৈতিকতা পশুত্বকে হার মানিয়েছে, আমানতের চরিত্র হারিয়ে মুনাফিক হচ্ছে, ভ্রাতৃত্বের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে শত্রুতায় গিয়ে কি আমরা পারব আমাদের সোনার দেশ গড়তে? (চলবে)

https://dailysangram.info/post/476820