১ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার, ১:১১

বাবা বাসায় এলে ছেলের প্রেস্টিজ নষ্ট হয়!

আমার লেখাটা যেদিন প্রকাশ হবার কথা সেদিন ইংরেজি ২০২২ সালের পয়লা তারিখ। তাই সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। তবে এমন দিনে মনখারাপের গল্প দিয়ে লেখা শুরু করায় দুঃখ প্রকাশ করছি।

আজকাল বয়স্ক বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখবার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হচ্ছে। এ শিক্ষকের একটি বাড়ি ছিল ঢাকার পাইকপাড়ায়। সেটা বিক্রি করে ছেলেদের পড়ালেখা করিয়েছেন। ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত। বাড়িঘরও হয়েছে। কিন্তু বাবার জায়গা হয়নি। তাই তিনি এখন বৃদ্ধাশ্রমের মতো “আদর্শ” প্রতিষ্ঠানে।

সন্তানরা সংখ্যায় বেশি হলে বাবার বাসায় একসঙ্গে থাকা সম্ভব নাও হতে পারে। প্রয়োজনবোধেই সন্তানকে বাবার বাসা ছেড়ে অন্যত্র থাকবার ব্যবস্থা করতে হয়। তাই বলে ছেলে সন্তানের বাসায় বাবা-মা এলে বা থাকলে প্রেস্টিজ নষ্ট হবে এটা মানা কঠিন বৈকি। তবে সন্তানের বাসায় থাকবার সংকুলান না হলে বাবা-মায়ের জন্য অন্যত্র ব্যবস্থার চেষ্টা থাকা জরুরি। বিয়েশাদি হওয়া মেয়ের বাসায় থাকা অবশ্য বাবা-মায়ের পক্ষে সম্ভব হয় না। হওয়া সমীচীনও নয়। তবে ব্যতিক্রম থাকতেই পারে।

আজকাল অনেক বউ শ্বশুরশাশুড়ি নিয়ে থাকতে চান না। বাস্তবতার ক্ষেত্রে তা সবসময় সম্ভবও নয়। ধরুন, ছেলে-বউ শহরে একরুমের একটা বাসা নিয়ে বসবাস করে। সেখানে কি বাবা-মা নিয়ে থাকা যায়? যায় না নিশ্চয়ই। কিন্তু সন্তানের চেষ্টা থাকতে হবে, যেন বাবা-মাকে নিয়ে থাকবার মতো বাসার ব্যবস্থা করা যায়। এটা না করে বাবা-মাকে সোজা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো শুধু অসৌজন্য নয়, অমানবিক। অথচ এমনটাই ঘটছে সমাজে। বাবা-মায়েরা সন্তানের কাছে যেন দুর্বহ বোঝা!

একটা হৃদয়ছোঁয়া গল্প বলতে চাই। ফেসবুক থেকে পাওয়া এটি। শুধু “হৃদয়ছোঁয়া” বললেই শেষ হয় না। বলতে হয়, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ নিয়ে গল্প। তাই শুরুতে দুকথার ভূমিকা দিয়ে আমার প্রিয় পাঠকদের জন্য ফেসবুক পোস্টের পুরো গল্পটি তুলে ধরলাম। এতে কারুর উপকার না হলেও সৃষ্টি হতে পারে নতুন উপলব্ধি।

গল্পটা এ রকম :

“বাবা বাসায় হঠাৎ করেই হাজির। আমি বেশ বিব্রত বোধ করলাম। বাসাভর্তি মেহমান।

এর ভেতরেই বাবা একটা পুরোনো ও ময়লা পাঞ্জাবি পরে এসেছে। পাঞ্জাবির এক জায়গায় আবার সেলাই করা। সম্ভবত মা যত্ন করে সেলাই করে দিয়েছে।

বাবা এ দিয়ে সম্ভবত তিনবার আমার বাড়িতে এসেছে। আমি বাবাকে স্টোর রুমে নিয়ে বসালাম। তারপর বেশ চাপা রাগের স্বরে বললাম,

যখন তখন আসবার মানে কী? আমি কোনও সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবো না। এ মাসেই আমার একটা বিদেশ ট্যুর আছে। বেশ কয়েক লাখ টাকা ওখানে খরচ হবে।

বাবা বেশ অবাক হয়ে বললো :

তোমার কাছে তো কোনওদিন সাহায্য চাইনি খোকা!

আমি বললাম,

তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু যখন তখন বাড়িতে আসলে যে আমার প্রেস্টিজ নষ্ট হয়, তা যে কেন এ অশিক্ষিত লোকগুলো বোঝে না। না পারি সইতে, না পারি কইতে। তাই বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই বললাম,

সাহায্য না লাগলে, খামোখা আসছো কেন?

বাবা বললো, তোমার মা আজ সকালে মারা গেছে। আসরবাদ দাফন হবে। মরবার আগে তোমাকে খুব দেখবার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু তুমি ব্যস্ত মানুষ। অসুস্থ মাকে দেখতে যাবার সময় ছিল না তোমার। এখানে এনে যে দেখিয়ে নিয়ে যাবো, তাতে আবার তোমার প্রেস্টিজ নষ্ট হয়। তাই মরবার আগে তোমাকে আর দেখতে পারলো না। যদি তার জানাযাতে যেতে, তাহলে তার আত্মা একটু শান্তি পেতো বলে মনে হয়।

ছেলে বললো,

বাবা কি আমাকে ইচ্ছা করে কটূ কথা শোনাচ্ছো? বয়স হলে মানুষ তো মারা যাবেই। এতে এত আপসেট হবার কী আছে? আজ বাসায় এত মেহমান, যাবো কি করে? লিমার জন্মদিন উপলক্ষে ওর আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবীরা এসেছে। কিন্তু গ্রামে না গেলে, গ্রামের মানুষজনও কথা শোনাবে। গ্রামের লোকজন তো গিবত ছাড়া আর কিছুই পারে না। তাই বাবাকে নিয়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশে ।

আমাদের বাড়ি শহরতলীতে, গ্রামই বলা যায়। আমার নিজস্ব গাড়িতেই গিয়েছিলাম। যখন পৌঁছালাম, তখন লাশ অলরেডি জানাযার জন্য মসজিদে নেয়া হয়েছে। আমাকে দেখে, সবাই সরে দাঁড়ালো। মাতবর চাচা বললো:

রায়হান বাবা, শেষবারের মতো মায়ের মুখখান দেখবা নাকি?

আমি বললাম :

থাক, দরকার নেই। জানাযা শুরু করুন।

মাকে কবর দিয়ে এসে ঘরে এসে বসলাম। কেমন যেন একটু মনখারাপ মনখারাপ লাগছে। হয়তো, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা কান্নাকাটি করছে, সেজন্য। কান্নাকাটি একটা ছোঁয়াচেরোগ। একজনের থেকে আর একজনের ভেতর সংক্রামিত হয়। গ্রামের কেউ কেউ সুর করে কাঁদছে, “ওরে রায়হান, তুই শেষপর্যন্ত আইলি, কিন্তু তোর মা তোরে একটু দেখবার পারলো না।”

বাবা ঘরে ঢুকে সবাইকে অনুরোধ করলো, পাশের ঘরে যাবার জন্য। সবাই চলে গেলে। বাবা একটা নতুন টেবিল ফ্যান বের করে আমার সামনে চালু করে দিল। অনেকক্ষণ পরে একটু আরাম লাগলো। আসলেই গরমে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। দেখি বাবাও ঘেমে গেছে। ফ্যানটা মুভ করে দিলাম। কিন্তু বাবা আবার আমার দিকে ফিক্সড করে দিল। বললো :

এ ফ্যানের বাতাসতো আমার গায়ে লাগাতে পারবো না খোকা। তোমার মা যখন খুব অসুস্থ ছিল, গরমে খুব কষ্ট পেতো। কিন্তু এ ফ্যানটা চালু করতে দিতো না। বলতো, থাক, নষ্ট হয়ে যাবে। খোকা আসলেই ফ্যানটা চালাবো।

বাবা একটু থেমে আবার বলতে লাগলো,

গতবার তুমি যখন আইছিলে, তখন গরম বলে বাড়িতে দুঘন্টাও বসতে পারোনি। তাই তোমার মা তোমার জন্য এ ফ্যানটা কিনে আনিয়েছে। যাতে বাড়ি আসলে, তোমার কষ্ট না হয়।

আমার মার জন্য হঠাৎ করেই খারাপ লাগতে শুরু করলো। বাবা মায়ের পুরোনো বাক্সটা খুললো। একটা পটলা বের করে নিয়ে আসলো। আর একটা খেলনা গাড়ির প্যাকেট। আমার হাতে দিয়ে বললো,

তোমার বাসায় তোমার মা জীবনে একবার গিয়েছিল। তুমি বলেছিলে, তোমার ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ, অনেক টাকা লাগবে। সেই থেকে তোমার মা আমার সঙ্গে সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করে। আমাদের দক্ষিণ মাঠের তিন বিঘা জমি বিক্রি করে দেবার জন্য। উত্তর মাঠের জমিটাতো তোমার পড়াশোনার জন্য বিক্রি করেছিলাম। শেষসম্বল ছিল দক্ষিণ মাঠের জমিটা। তাই আমি রাজি হতাম না। কিন্তু তোমার মায়ের শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। তাই তার শেষইচ্ছা পূরণ করবার জন্য গতমাসে বিক্রি করে দিলাম জমিটা। পনেরো লাখ টাকা পেয়েছি জমিটা বিক্রি করে। তার ভেতর তিন হাজার টাকা দিয়ে ফ্যানটা কিনেছি। আর এক হাজার টাকা দিয়ে এ খেলনাগাড়িটা কিনেছি। বাকি টাকা এ পুটলিতে আছে। তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন মাতবরের ছেলের এমন একটা গাড়ি ছিল। তুমি সারাক্ষণ তোমার মার সঙ্গে ঘ্যান ঘ্যান করতে, এরকম একটা গাড়ির জন্য। তোমার মা খুব কষ্ট পেতো। সামর্থ্য ছিল না বলে, কিনে দিতে পারিনি। যখনই তোমার মা তোমার জন্য খুব মন খারাপ করতো, তখনই বলতো, ছেলেডারে একটা খেলনাগাড়িও কিনে দিতে পারিনি। গাড়িটা যেদিন কিনে আনি, সেদিন যদি তোমার মায়ের খুশিটা দেখতে খোকা! খুব ইচ্ছা ছিল তার, এ টাকা কয়টা আর এ খেলনাগাড়িটা নিজ হাতে তোমারে দেবে। তোমারে অনেকবার খবরও পাঠিয়েছি। কিন্তু তোমার ব্যস্ততার জন্য তুমি আসতে পারোনি। যাই হোক, তার আত্মা নিশ্চয়ই দেখছে।

মনে পড়লো, মা একবারই আমার বাড়িতে গেছে। মনে করেছিলাম, সাহায্য চাইতে পারে। তাই আগে থেকেই, ব্যবসায় লসের গল্প শুনিয়েছিলাম মাকে।

পৃথিবীটা কেমন যেন অর্থহীন লাগছে আমার কাছে। মাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে আমার। কবর খুঁড়ে মাকে তো আর দেখতে পারবো না। আমি বাচ্চা ছেলেদের মতো বাবাকে ধরে কাঁদছি। বাবা পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে: কাঁদে না বাবা। মা তো সবার চিরকাল বাঁচে না।”

বাবা-মা সন্তানের জন্য ছায়া। বটবৃক্ষ। এর তুলনা হয় না। তুলনা করা যায় না। তবে ব্যতিক্রম ঘটতেই পারে। ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। ধর্তব্য নয়। আজকে যারা বাবা-মায়ের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। কালকে তাদের সন্তানেরাও বাবা-মায়ের সঙ্গে অসদাচরণ করবেন। এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতির আচরণ।

বাবারা সন্তানকে কত ভালোবাসে তা ভাষায় ব্যক্ত করা মুশকিল। মাও ভালোবাসে সন্তানকে। তবে আমার নিজের অভিব্যক্তি হচ্ছে বাবার তুলনা কেবল বাবাই। মাকে নদীর সঙ্গে তুলনা করলে বাবাকে তুলনা করতে হবে সাগরের সঙ্গে। মা যদি হয় চাঁদ, তাহলে বাবা অবশ্যই সূর্য। এর অর্থ অবশ্য মাকে ছোট বা খাটো করা নয়। মা মাই। বাবা বাবাই। আর বাবার জন্যই তো মা। বাবা না হলে মা হবে কোত্থেকে? আর এ বাবার উপস্থিতি যখন সন্তানের জন্য অমর্যাদার হয় তখন সেটাকে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে তা আমার মাথায় ঢোকে না। অন্যদেরও ঢোকা উচিত নয়।

https://dailysangram.com/post/476076