১ জানুয়ারি ২০২২, শনিবার, ৯:৪৪

মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরমতম বছর ২০২১

বিচারবহির্ভূত হত্যা ৮০ : সীমান্ত হত্যা ১৮, ধর্ষণ ১৩১৮

মানবাধিকার বিদায়ী বছরে বিষয়টি মানুষের সহ্য ক্ষমতা অতিক্রম করেছে। বর্তমান অবস্থাকে বর্বরতার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সব মিলিয়ে ২০২১ সালকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরমতম বছর বলা যায়। এ পরিস্থিতি থেকে উন্নতি ঘটাতে মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সমন্বয়ে একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করা যেতে পারে। যারা গত এক যুগের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দেখবে। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান লিটন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গত পাঁচ বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিবেচনায় এ মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে ২০২১ সালের বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী, নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামাল, জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির, সহকারী সমন্বয়কারী অনির্বাণ সাহা প্রমুখ।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮০ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৫১ জন।

ক্রসফায়ারের সমর্থনে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের বক্তব্যের সমালোচনা করে আসক বলে, তাদের এ ধরনের বক্তব্য প্রকারান্তরে বিচারবহির্ভূত হত্যা বা ক্রসফায়ারকেই উৎসাহিত করে। এটি প্রকৃতপক্ষে দেশের সংবিধান প্রদত্ত মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার হরণসহ আইনে আশ্রয় লাভসংক্রান্ত সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী। একই সাথে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার ব্যবস্থায় প্রদত্ত বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকারের সাথে সাংঘর্ষিক। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ২০২১ সালে নিহত হয়েছেন আটজন। এর মধ্যে গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শারীরিক নির্যাতনে ছয়জন, হার্ট অ্যাটাকে একজন ও গ্রেফতারের আগে শারীরিক নির্যাতনে একজন নিহত হয়েছেন। এ সময় দেশের কারাগারগুলোতে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৮১ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৯ জন, হাজতি ৫২ জন।

সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ হন সাতজন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ছয়জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন একজন। ২০২১ সালে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএসফের গুলিতে ১৮ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। বছরজুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা ঘটনায় গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২৮ জন।

আসকের উপস্থাপিত তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে সারাদেশে ধর্ষণ ও সঙ্ঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩২১ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ১২৮ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ৭৭ পুরুষ। উত্ত্যক্তকরণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিন নারী ও পাঁচ পুরুষসহ খুন হয়েছেন মোট আটজন।

পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৪০ নারী। যার মধ্যে নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন ৩৭২ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ১৪২ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১০ নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যার শিকার হন ৭২ নারী ও আত্মহত্যা করেন ১৩ নারী। সালিস ও ফতোয়ার মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১২ নারী।

এ দিকে শারীরিক নির্যাতনের কারণে মৃত্যু, ধর্ষণের পরে হত্যা, ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা, অপহরণ ও নিখোঁজের পর হত্যাসহ বিভিন্ন কারণে নিহত হয়েছে মোট ৫৯৬ শিশু। বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৪২৬ শিশু। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৭৪ শিশু, যৌন হয়রানির শিকার হয় ১৮৫ শিশু, বলৎকারের শিকার হয়েছে ৭৮ শিশু।

আসক জানায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ, ক্ষমতাসীন দলের সাথে বিরোধী দলের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ মোট ৯৩২টি রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে মোট ১৫৭ জন, আহত হয়েছে ১০ হাজার ৮৩৩ জন। ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৭২টি সঙ্ঘাতের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৭২ জন, আহত হয়েছে সাত হাজার ২০১ জন। এ ছাড়া পৌর ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন ঘিরে ৮৩টি ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও ৭৮৮ জন আহত হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারির ঘটনা ঘটেছে ২০ বার।

আসকের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০৪টি মূর্তি, পূজামণ্ডপ, মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৮৪টি বাড়িঘর ও ৫০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনজন নিহত এবং কমপক্ষে ৩০০ জন আহত হয়েছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একটি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

বছরটিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে কমপক্ষে ১১৩৪টি। নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২১০ সাংবাদিক। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে ১৬ জনসহ মোট ১৮ বাংলাদেশী সীমান্ত হত্যার শিকার হয়েছে। গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ২৮ জন। মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতির জন্য সংবাদ সম্মেলনে আসকের পক্ষ থেকে ১২ টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/633501