৯ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১:৪৩

হাওরে ঘোর দুর্দিন

সরেজমিন

পানি বাড়ছে, এটা জানাই আছে। তবু শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে পানি বাড়ছে কি-না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য গ্রামের প্রান্তে এলেন আবদুস ছমেদ খাঁ। দেখেশুনে জানালেন, 'অননে (এখন) আর মেঘ (বৃষ্টি) নাই, তা-ও হানি (পানি) বাড়ার জোর কমতাছে না।' প্রতি রাতেই গ্রামের প্রান্তে বানের পানির কাছাকাছি শুকনো কোনো জায়গায় একটা পাথর ফেলে রাখেন তিনি। তারপর সকাল থেকে চলে পানি বাড়া-কমা নিয়ে তার গবেষণা। ৮০ বছর ছুঁই-ছুঁই ছমেদ খাঁ জানেন, পানি কমলেও তেমন লাভ নেই। ১ এপ্রিল থেকে টগার হাওরে অকাল বন্যার যে প্রাবল্য শুরু হয়েছে, তা এখন বাড়া-কমার গণিতকে ছাড়িয়ে গেছে, ধানের সব জমিই পানির নিচে।

টগার হাওর-সংলগ্ন গ্রামগুলোর একটি সাড়ারকোনার পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখা গেল বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ ঢাকা পড়ে আছে বানের পানির নিচে। চৈত্রের এমন দিনে যখন ধান পাকার


গন্ধে গ্রাম ম-ম করার কথা, কৃষকের মনে থাকার কথা নতুন ধান গোলায় তোলার স্বপ্ন, তখন তারা কান্নায়

ভেঙে পড়ছেন। বন্যার অকালবোধনে চাপাপড়া টগার হাওরের দুই হাজার হেক্টর জমির এক খণ্ডও অবশিষ্ট নেই, যেখান থেকে ধান তোলা যাবে। এ হাওরটি সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার সবচেয়ে বড় দুটি হাওরের একটি।

শুক্রবার সকালে মোহনগঞ্জ রেলস্টেশনে নেমে ধর্মপাশার টগার হাওরের দিকে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল সরকারি বিভিন্ন সূত্রে 'কিছু জমি এখনও বানের পানিতে ভেসে যায়নি' বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা হয়তো সত্য। ধর্মপাশা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত টগার হাওরের পথেও সড়কের দু'ধারে কিছু ধানের জমি চোখে পড়ল। তবে সহকর্মী সমকালের ধর্মপাশা প্রতিনিধি এনামুল হক জানালেন, 'এই জমিগুলো বিশাল সমুদ্রে এক ফোঁটা শিশিরবিন্দুর মতো জেগে আছে।'

ইঞ্জিনচালিত নৌকায় টগার হাওরে যাওয়ার পথে বলরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমারঞ্জন সরকার মলয়ের সঙ্গে আলাপে এনামুলের বলা সমুদ্রে শিশিরবিন্দু সম্পর্কিত তথ্যের যথার্থতা বোঝা গেল। মলয়দেরও প্রায় ১৫ একর জমি এখন পানির নিচে, যেখান থেকে কমপক্ষে ৭০০ মণ ধান পেতে পারতেন। মলয়ের স্ত্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তার অন্য দুই ভাই ভালো চাকরি-বাকরি করেন। আসন্ন দুর্দিনে তারা তাই টিকে থাকতে পারবেন। কিন্তু তার কাকার ছেলে অজিত সরকারের হয়েছে মাথায় বাজ পড়ার অবস্থা।

অজিত এবার চাষ করেছিলেন ১৬ একর জমি। এই জমির বেশিরভাগই বর্গা নিয়েছেন তিনি। 'বর্গা' বলতে সাধারণত ফসলের ভাগাভাগির পুরনো রীতি এখন আর প্রচলিত নেই। অজিত অন্যের জমি নিয়েছেন নগদ টাকার বিনিময়ে একসনা চাষের শর্তে, যেখানে বছরে একটি ফসল হয়, তা এই বোরো ধান।

বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগ হলো হাওরাঞ্চল। সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া_ এই সাতটি প্রশাসনিক জেলার বিভিন্ন অংশে বিস্তৃত এই হাওর। তবে সুনামগঞ্জের প্রায় সবটাই হাওরাঞ্চল। এই জেলার এক ধর্মপাশাতেই রয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে ৭৮টি হাওর। উপজেলা কৃষি অফিসের হিসাব অনুযায়ী, ধর্মপাশার এই হাওরগুলোতে রয়েছে ২৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শোয়েব আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হাওরের ২৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির মধ্যে ২৩ হাজার ৮১৮ হেক্টর পানিতে তলিয়ে গেছে।

যে ৮২ হেক্টর জমি এখনও তলিয়ে যায়নি, খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেগুলো মধ্যনগর ইউনিয়নের একটি হাওরের। তবে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার জানালেন, ওই জমিগুলোও ডুবোডুবো। আর দু-চার দিন সময় পেলে হয়তো আধা-পাকা ধান কেটে আনতে পারবেন চাষিরা। তৃণমূল পর্যায়ের এই জনপ্রতিনিধি জানালেন, হাওরে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন তিনি। বললেন, গত বছরও ধান পাকার আগে আগে বন্যা এসেছিল। চাষিরা কাঁচা-পাকা ওই ধান কেটে এনে বছরের খোরাকি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। তবে এখন আর সম্পন্ন গৃহস্থের গোলায়ও খোরাকির ধান অবশিষ্ট নেই।

সাড়ারকোনা গ্রামের অজিত সরকারের সঙ্গে আলাপেও এ ধারণা পাওয়া গিয়েছিল। হাওরের বেশিরভাগ কৃষক অন্তত এক বছরের খোরাকি গোলায় জমা রাখলেও অজিত কখনই খোরাকির ধান গোলায় ধরে রাখেন না। অজিত যে ১৬ একর জমি চাষ করেন, তাতে ৮০০ মণের মতো ধান পান। ধান তোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই ধান বিক্রি করে দেন। তারপর একই গ্রামের পঙ্কজ সরকারের সঙ্গে মিলে শুরু করেন ধান কেনাবেচার ব্যবসা। এবার জমি বর্গা নিতে অজিতের খরচ হয়েছিল ৭৫ হাজার টাকা। চাষের জন্য লেগেছে আরও প্রায় দুই লাখ। ধারণা করেছিলেন, ধান বিক্রি করে লাখ পাঁচেক টাকা পাবেন। সেই টাকার পুরোটাই তিনি বিনিয়োগ করতেন তার ধান কেনাবেচার ব্যবসায়। অজিত ও পঙ্কজের ধান তোলা ও কেনাবেচার সঙ্গে আরও অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক হিসেবে যুক্ত হন। এবার তাদেরও কারোর কাজ জুটবে না।

অবশ্য অন্যের কথা ভাবার অবকাশ এখন অজিতদের কারোরই নেই। তারা বরং নিজের অস্তিত্ব রক্ষার্থে লড়াইয়ের মুখোমুখি। এরই মধ্যে অজিত তার গোয়ালের ছয়টি গরুর চারটি বিক্রি করে দিয়েছেন। অজিত জানালেন, বৃহস্পতিবার ধর্মপাশার গরুর হাটে এত গরু এসেছিল, যা তিনি আগে আর দেখেননি।

সাড়ারকোনা যেন একখণ্ড হাওর, যেখান থেকে পাওয়া গেল বাংলাদেশের ছয় ভাগের এক ভাগ যে হাওরাঞ্চল, সেখানে আসন্ন দুর্যোগ পরিস্থিতির ধারণা। ওই গ্রামের মোহাম্মদ ইউনুস চাষ করেছিলেন ২০ একর জমি। হাজার মণ ধান যার গোলায় ওঠার কথা আর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে, সেই ইউনুসের দিন কাটছে এনজিওর দেনা শোধ করার আতঙ্কে। তিনি জানান, ভাটি এলাকায় ঘরে-ঘরে এখন আর্তনাদ। কয়েকদিন পর যে ধান উঠত, তা দিয়েই ঘরের অন্নের সংস্থান হতো। কিন্তু এখনই কিনে খেতে হচ্ছে। সারা বছর কীভাবে চলবে, তা ভাবতেও পারেন না তিনি। ওই গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষক মোর্তোজ আলী এবার চাষ করেছিলেন ৩০ একর জমি। ব্যাংকের কাছে, এনজিওর কাছে রয়ে গেছে তার দেনা। মোর্তোজ বললেন, 'যারার (যাদের) কিচ্ছু নাই, হেরা (তারা) তো জাল লইয়া পানিত নামতে পারব। আমি কিতা (কি) করাম (করব)?' তবে মোর্তোজ আলীর ছোট ভাই আবদুল মজিদ তালুকদার বললেন, জাল নিয়ে মাছ ধরার জন্য পানিতে নামা এখন আর আগের মতো সহজ নয়। হাওরে বানের পানি ঢোকার পর হাওর হয়ে যায় খাসজমি। তাছাড়া এমনিতেও হাওরের মাঝে মাঝে কিছু জলাবিল আছে, যেগুলো সরকার ইজারা দিয়ে থাকে। ওইসব বিলের ইজারাদাররা হাওর ভেসে যাওয়ার পর শুরু করে দৌরাত্ম্য। ফলে সাধারণ মানুষ আর হাওরে মাছ ধরার জন্য নামতে পারেন না।

পেশায় আইনজীবী আবদুল মজিদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মাছ ধরার নামে তার এমপি, চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের দৌরাত্ম্যের কথা যেন জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি আমরা। তাহলে হাওরের ফসলবঞ্চিত মানুষ বাঁচার শেষ কুঠিটি ধরে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে পারবেন। পারলে প্রধানমন্ত্রী যেন কৃষিঋণ মওকুফ এবং এনজিওগুলো যেন তাদের এক বছর পর ঋণ শোধ করার সুযোগ দেয়।

ফেরার পথে চোখে পড়ল জাল নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন হাওরের মানুষ। এখন যাদের ধান কাটার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ছিল, তারা হয়তো হাওরের পানিতে অনেক মাছ আসবে এমন আশায় বুক বাঁধছেন।

 

http://bangla.samakal.net/2017/04/09/283845#sthash.3zC0MxBJ.dpuf